পনেরো মিনিটের অপারেশন।
চাকার নীচে রাস্তায় শোয়া যুবকের মুখ, বলপূর্বক টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় যুবতীর অশ্রুধোয়া বিভ্রান্ত চাহনি। এরা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়ে, শিক্ষিত কর্ম-প্রার্থী। মধ্যরাতে আয়োজিত এই হিংস্র পনেরো মিনিটের অপারেশন আমাদেরই সন্তানদের পাঁজর ভেঙে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে। দেখেশুনে মনে হয় কোথায় বাস করছি। এ সব আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি থেকে সহজে মোছা যাবে না। কিন্তু কেবল এই স্মৃতি দিয়ে কি কাজ হবে? চার বছর পর ইভিএম মেশিনে প্রতিবিম্বিত হওয়ার মতো গভীরতা, বিস্তার কোনওটাই এই স্মৃতির নেই। তার চেয়ে অনেক জরুরি সরকারের কাছে এখনই জানতে চাওয়া, শিক্ষাব্যবস্থার উপর ধারাবাহিক নির্মম আক্রমণের কারণ কী? জনসাধারণের ক্ষোভ উপেক্ষা করতে পারে না নির্বাচিত সরকার। নির্বাচন আসতে দেরি থাকলেও পারে না।
প্রশাসনিক অদক্ষতা, বিশৃঙ্খলা আমাদের গা-সওয়া হয়েছে বহু বছর হল। কিন্তু ধারাবাহিক নির্মমতার যে প্রবাহে অবগাহন বাংলায় আমাদের প্রতি দিনের কৃত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার তুলনা অতীতে পাইনি। মালবাজারে আকস্মিক বানে যাঁরা ভেসে গেলেন, নিঁখোজ হলেন, তাঁদের সংখ্যা জানার আগেই ঘোষিত হল কার্নিভালের নিয়মাবলি। একটি সম্প্রদায়ের দীর্ঘতম ছুটি-সমন্বিত উৎসব-শেষের পর একটি কার্নিভালের পিছনে বিশেষ যুক্তি থাকতে পারে না। এর চেয়ে অনেক জরুরি মানুষকে কাজে ফেরানো।
কলকাতা ও সব জেলায় এর জন্য সাজো সাজো রব। পুজোর আগে এক বার দুর্গাপুজোর হেরিটেজ স্টেটাস লাভের আনন্দে একটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন উৎসব হয়েছিল। তার জন্য স্কুল কলেজ অফিস সর্বত্র ছুটি ঘোষণা করে যে সময় ও টাকার অপচয় হয়েছিল, তার আদেখলেপনার স্মৃতি মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। জলপাইগুড়ির মৃত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা হচ্ছে যখন বাকি রাজ্য উল্লাসে মাতছে। এত উল্লাসের প্রয়োজন কী? প্রয়োজনটা বোধ হয় পরিকল্পিত। বিনোদন দিয়ে চেতনার কণ্ঠরোধ কোনও আকস্মিকতা নয়।
কার্নিভালে অবশ্যই দলে দলে মানুষ গেলেন, বাজনা বাদ্যি রোশনাই হল। কারণ, মোচ্ছবের সংস্কৃতি এখন আমাদের রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। “আনন্দ করো, যে কোনও মূল্যে। এ দিক ও দিক দেখো না। বিবেককে উকো দিয়ে চেঁছে দাও তবেই তুমি সুখী হবে।” সুখী হলে অনেক কিছু না-দেখা গা-সওয়া হয়ে যায়। নানাবিধ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত রাজনীতিকদের কারাবাস, জামিন, তাঁদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় বুলেটিন পড়ে আমাদের গত কয়েক মাস কেটেছে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা বিষয়ে সন্দিহান হয়েও বলা যায়, এই পরিস্থিতিতে জনতার কাছে জবাবদিহির দায় নির্বাচিত সরকারেরও থাকে। তা করার কোনও চেষ্টা চোখে পড়েনি। সমান্তরাল ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দীর্ঘতম অবস্থানের চেহারা নিয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিযুক্ত যাঁরা, তাঁরা ক্লাসরুমে। আর মেধাতালিকায় প্রকৃতপক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁরা পথে। এই অবিচারও এই ভাবেই চলত যদি না বিচারব্যবস্থার হস্তক্ষেপ ঘটত।
নিযুক্তি তালিকা প্রস্তুত হতে হতে পুজো এসে গেল। এই সময় ২০১৪ সালে পরীক্ষা-উত্তীর্ণ টেট প্রার্থীরা পথে বসলেন। তার পর নিযুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন আরম্ভ হল। তাঁদের সঙ্গে বসে আলোচনার কোনও রাস্তা বার করা হল না, ধর্মঘট বেআইনি ঘোষণা করতে যাওয়া হল কোর্টে। তার পর এই মধ্যরাতের নির্বিচার নিষ্ঠুরতা। এক দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে নিযুক্তির পুরো ব্যাপারটির মধ্যেই কোনও স্বচ্ছতা নেই। মেধাতালিকা বার বার প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে কোর্টে। তালিকায় নাম আছে, নম্বর নেই। বিপুল দুর্নীতির ফলে প্রায় পুরো দফতরের শিক্ষাকর্তারা কারা দফতরে। এতেও যে সরকার টেট-প্রার্থীদের নিযুক্তি সম্বন্ধীয় তথ্য দেওয়ার দরকার মনে করল না, তাঁদের অহঙ্কার ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। এমনই শক্তিমান কি তাঁরা যে সত্যের কোনও বিধি-বিধান মানবেন না?
না কি তাঁরা অমানবিকতার এক সম্মেলক সঙ্গীতে দোহার হয়ে গেছেন? কারও ম্লান মুখ, কারও খিদে, কারও মৃত্যু তাঁদের অন্তরে ছায়া ফেলে না আর? ছোটবেলায় পড়া গল্পে যেমন এক রাজ্যের সব মানুষ রাক্ষস হয়ে গিয়েছিল, আমরাও কি তেমন দানবত্ব অর্জন করেছি? আমাদের বুঝতে হবে, এ সব আঘাতের প্রবাহ কিন্তু আকস্মিক বা দৈব নয়। সুন্দর ভাবে পরিকল্পিত।
আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি, বেশ কিছু দিন হল শিক্ষা তার প্রাথমিকতার অধিকার হারিয়েছে। মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষার স্বীকৃতি লুপ্ত হয়ে চলেছে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে। করোনা কালের দু’বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়ারা পড়াশোনা করেছে নামমাত্র। অথচ, দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের কেবল স্মার্টফোনের ভরসায় বসিয়ে না রেখে রাজ্য সরকারের নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে উপগ্রহ মারফত সঞ্চালনা ব্যবস্থা দিয়ে পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত টেলিভিশনের মনিটর দিয়ে পড়ানো যেত। তা নিয়ে কোনও আলোচনাই হল না। যে শিক্ষকরা নিজেদের চেষ্টায় পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও কোনও আলোচনার চেষ্টা হল না। স্কুল বন্ধ রাখার পর্বটি বাংলায় কত দিন ধরে কত ভাবে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে, আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনি। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির দৃষ্টান্ত উপচে পড়ার পরও তুমুল নৈঃশব্দ্য। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার কোনও উদ্যোগ করা গেল না। গত দশ বছরে স্কুল ও লাইব্রেরি সর্বক্ষেত্রে নিয়োগ প্রায় শূন্য। গ্রাম থেকে বদলি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা চলে আসছেন শহরে। গ্রামের স্কুলগুলি শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা এই ঘটনা বলার সঙ্গে যুক্ত হল বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধার প্রভাবশালীদের ঘর থেকে। নতুন ভাবে নিযুক্তির যে চেষ্টা আরম্ভ হয়েছে তা মন্দের ভাল। কিন্তু জনসমক্ষে তথ্য না থাকায় বার বার টেনে ধরছে অতীতের হিসাব। ২০১৪ সালের টেট-পরীক্ষার্থীদের মধ্যে কত জনের নিয়োগ হয়েছিল, তার তথ্য নেই। আছে কেবল পরীক্ষার্থীদের তথ্যের অধিকারে করা প্রশ্নের উত্তর। তাঁদের অনেকে দু’বার ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। তার ফল কী হল? সেই প্যানেল কেন বাতিল? এর উত্তর সরকারকে দিতে হবে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। উত্তর এল না। হল পর্ষদের দায়ের করা কেস এবং মধ্যরাতের বর্বরতা।
আসলে আমাদের কাছে শিক্ষা তার প্রাথমিকতা হারিয়েছে। না হলে মিড-ডে মিলের বাজেট না বাড়িয়ে ভর্তুকির প্রকল্পগুলির বাড়বাড়ন্ত এত সহজ হত না। ছেলেমেয়েগুলি সপ্তাহে এক দিন ডিমের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ তা দেওয়া যায় না। গত আড়াই বছরের স্কুল বন্ধ পর্বে নিয়মিত রান্না করা খাবারের বদলে চাল ডাল আলুর রেশন দেওয়া হচ্ছিল। এমনিতেই তাতে পুষ্টির যথেষ্ট ঘাটতি হয়েছে।
বিজ্ঞান ও গবেষণায় ভারতের শীর্ষে যে রাজ্য, তাকে তেলেভাজা বিক্রির পথ দেখানোর মধ্যে কেবল মানসিক দৈন্য নেই, আছে চেতনাকে ভয় পাওয়ার এক বাস্তব।
আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। দুর্নীতি বা সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে নির্বাচনে পরাজয় ঘটা আসলে এখন আর বাস্তবে ঘটে না। এই দুটোই মানুষকে আড়াআড়ি বিভক্ত করে দেয়, ভোট ভাগ হয়ে যায়। শিক্ষা নিয়োগের পৃথিবীতে, এক দিকে দাঁড়িয়ে যায় পরীক্ষা-উত্তীর্ণ প্রার্থীরা, অন্য দিকে দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচিত কর্মীরা। আরও বহু প্রার্থী আছেন যাঁরা দুর্নীতির সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না, কেবল উপযুক্ত সময়সুযোগের অভাবে পেরে ওঠেননি। এই ত্রিধাবিভক্ত দুনিয়ায় দুর্নীতির সমর্থকরাই হয়তো সংখ্যায় বেশি। কাজের ক্ষেত্রেও দেখেছি দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসকের শিষ্য-ভক্তরাই সংখ্যায় বেশি। কারণ, দুর্নীতির ভাগ পান অনেকেই। শিক্ষা ও শিক্ষিত সমাজের উপর ক্রমান্বয়ে আঘাতকে রুখতে গেলে নির্বাচনের পথ চেয়ে বসে না থেকে, রোজকার জীবনযাপনে আসুক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দাবি করার আন্দোলন। প্রাথমিক শিক্ষা, মিড-ডে মিল, সরকারি শিক্ষার হাল ফেরানো, অবাধ বেসরকারিকরণের মোকাবিলা, শিক্ষকদের স্বচ্ছ নিযুক্তি, স্কুলে যথেষ্ট সংখ্যায় শিক্ষক— এ সবই এই দাবির অন্তর্গত। কেবল নির্বাচন নয়, দৈনন্দিনের লড়াইয়ের মধ্যে এই দাবিকে আনতে পারলে ভর্তুকি ও বিনোদনলোলুপ জনতারও বোধগম্য হবে, আদৌ এই পৃথিবী তাদের শিশুদের বাসযোগ্য থাকবে কি না। তখনই মানুষকে ভাগ করে ক্ষমতা জয়ের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করা সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy