—ফাইল চিত্র।
সেই ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর প্রথম ভোটপ্রচার এ দেশের রাজনীতির একটি মাইলফলক। সেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দলের প্রধান মুখ নির্বাচনী প্রচারে নেমে সরাসরি মুসলমানদের নাম করে, তাঁদের সম্পর্কে বিদ্বেষের তির ছুড়েছিলেন। তা-ও মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসে। বাইশ বছর পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সেই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পুরনো অবতারে ফিরলেন। এবং দেখা গেল, তাঁর আক্রমণের বিষয় একেবারেই বদলায়নি।
২০০২-এর সেপ্টেম্বর থেকে গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর ‘গৌরব যাত্রা’ শুরু হয়েছিল। তিনি প্রথমেই গুজরাতের মুসলমানদের সঙ্গে পাকিস্তান, পারভেজ মুশারফ, পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের যোগাযোগ টেনেছিলেন। প্রকাশ্য জনসভায় মুসলমানদের বংশবৃদ্ধি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা সে বারই প্রথম। ‘হাম পাঁচ, হামারে পচ্চিস’ বলে হাসতে হাসতে মুসলমানদের সন্তান উৎপাদন নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন তিনি। গুজরাতের হিংসার পরে মুসলমানদের ত্রাণ শিবিরকে তিনি ‘সন্তান উৎপাদনের কারখানা’ বলে তকমা দিয়েছিলেন।
যে কোনও ওষুধই বছরের পর বছর চলতে থাকলে তার প্রভাব কমে যায়। রাজনীতিতেও একই কথা প্রযোজ্য। একই রাজনৈতিক দাওয়াই প্রতি ভোটে কাজ দেয় না। রাজনীতিকদের তাই নতুন কৌশল নিতে হয়। নতুন বিতর্ক তুলে দিতে হয়। বা নতুন মোড়কে পুরনো কথা বলতে হয়।
নরেন্দ্র মোদী এখানেই ব্যতিক্রম। তিনি বাইশ বছর আগের কথাই একেবারে আদি অকৃত্রিম ভাবে আমজনতার সামনে তুলে ধরেছেন। কোনও রাখঢাক না করে সরাসরি মুসলমানদের নিশানা করেছেন। প্রশ্ন হল, একই কৌশলে কত বার কাজ হবে?
২০০২-এর গুজরাতের ভোটপ্রচার থেকেই ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য নরেন্দ্র মোদীর ‘সুনাম’ ছড়িয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হিসেবে তাঁর ‘ব্র্যান্ড’ তৈরির প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়ে যায়। বাইশ বছর পেরিয়ে এসে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মরসুমে নরেন্দ্র মোদী ফের মুসলমানদের সম্পর্কে দু’টি বিশেষণ প্রয়োগ করলেন। এক, যারা বেশি বেশি সন্তান উৎপাদন করে। দুই, অনুপ্রবেশকারী। সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই প্রচার করে, মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক দিন হিন্দুদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদী ফের সেই মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্ক ও বিদ্বেষ বা ‘ইসলামোফোবিয়া’-কে সামনে এনেই ভোটের সময় ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চাইছেন।
বাইশ বছর আগে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে অস্ত্রে নরেন্দ্র মোদী সাফল্য পেয়েছিলেন, বাইশ বছর পরের ভারতে তিনি যদি সেই মুসলিম-বিদ্বেষে ভর করে আবার নির্বাচনী সাফল্য পান, তা হলে বুঝতে হবে, দেশের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর এমন একটি নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে, যারা সব ভুলে মুসলিম-বিদ্বেষকে ইন্ধন করেই ভোট দিতে পারেন।
এমন নয় যে গত বাইশ বছরে মুসলিমদের সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক কথা মোদীর মুখে শোনা যায়নি, বরং উল্টো। যখনই নির্বাচন এসেছে, তখনই নরেন্দ্র মোদী মুসলিমদের সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক কথা বলেছেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর মুখে মুসলিমদের সম্পর্কে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী শব্দবন্ধ শোনা গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ২০১৫-তেই বিহারের বিধানসভা ভোটের প্রচারে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, বিরোধীরা দলিত-জনজাতিদের সংরক্ষণের সুবিধা মুসলিমদের দিয়ে দিতে চাইছে। ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশের ভোটের প্রচারে তিনি বলেছিলেন, গ্রামে ‘কবরিস্থান’ তৈরি হলে শ্মশানও তৈরি করতে হবে। রমজানের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ অক্ষুণ্ণ থাকলে দীপাবলির সময়ও বিদ্যুৎ জোগাতে হবে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদী সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনের কথা বলে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’-এর মন্ত্র নিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেই নয়া নাগরিকত্ব আইন সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় মোদী বলেছিলেন, যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের পোশাক দেখেই চেনা যাচ্ছে।
বলা বাহুল্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নরেন্দ্র মোদী মেরুকরণের সুফল পেয়েছেন। তা সে রাজ্যের ভোটে হোক বা লোকসভা ভোটে। হয়তো কর্নাটকের মতো রাজ্যে তাঁর মেরুকরণ কাজ দেয়নি। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে তিনি পর পর দু’বার সাফল্য পেয়েছেন। সে দিক থেকে বলা যায়, রাজনীতির স্বার্থে নিজের ভোটব্যাঙ্ককে চাঙ্গা রাখতে নরেন্দ্র মোদী নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মুসলিম-বিদ্বেষের পালে হাওয়া জুগিয়ে গিয়েছেন। তাতে কাজ হচ্ছে বলে টের পেয়েছেন। আর সেই কারণেই এ বার কোনও রাখঢাক না রেখে, সরাসরি মুসলমানদের নাম করে মেরুকরণের খাপখোলা হাতিয়ার হাতে তুলে নিয়েছেন।
দশ দিন আগে বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী যখন জে পি নড্ডা, রাজনাথ সিংহকে পাশে নিয়ে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করলেন, তখন অবশ্য মনে হয়েছিল, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন অন্য রকম হবে। কারণ বিজেপির ইস্তাহারে কোনও জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি ছিল না। মনে হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী শুধু ২০৪৭-এর ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন ও ‘মোদীর গ্যারান্টি’-কে পুঁজি করেই ভোটে যাবেন। তার সঙ্গে রামমন্দির নির্মাণের সাফল্য বর্ণনা থাকবে। তবে তাতে রাম-ভক্ত হিন্দুদের প্রত্যাশা পূরণ ও আস্থাকে সম্মান দেওয়ার কথাই থাকবে। মুসলিম-বিদ্বেষ থাকবে না।
বাস্তবে দেখা গেল, নরেন্দ্র মোদী বোধ হয় এতখানি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। নির্বাচন শুরুর আগে অধিকাংশ জনমত সমীক্ষা জানান দিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী ফের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে ফিরছেন। বিরোধীরা যে মাথায় চড়ে বসেছে, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প কে, মানুষের কাছে সে প্রশ্নের উত্তর নেই। বিজেপির মধ্যেও মোদীর কোনও চ্যালেঞ্জার উঠে আসেনি। শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্বে মোদী সরকারের ডঙ্কা বাজছে বলে বিজেপির দাবি। বিজেপি নেতারা নিশ্চিন্তে রয়েছেন, যত দিন মোদী রয়েছেন, তত দিন ভাবনা নেই।
দলের নেতা-কর্মীদের এই নিশ্চিন্তির ভাবই এখন মোদীর দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে। তিনি বিজেপির জন্য ৩৭০ আসন, এনডিএ-র জন্য চারশো পারের লক্ষ্য রেখেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে প্রবল দেশপ্রেমের হাওয়াতে ভর করে বিজেপি ৩০৩টি আসন জিতেছিল। উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়, দক্ষিণের কর্নাটকে সিংহভাগ আসন জিতেছিল বিজেপি। তার পরে আরও ৭০ থেকে ১০০টি আসন বাড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিজেপির আসন বাড়ানোর সুযোগ কম। সর্বোপরি গত লোকসভা নির্বাচনে জেতা ৩০৩টি আসন যে সুরক্ষিত থাকবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। রাজস্থান থেকে কর্নাটক, বিহার থেকে মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বিজেপি তথা এনডিএ-র আসন বাড়ার সুযোগ নেই। বরং কমার আশঙ্কা বেশি।
এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী দু’টি কৌশল নিচ্ছেন। প্রথমত, তিনি কংগ্রেসকে নিশানা করছেন। কারণ কংগ্রেসকে একশো আসনের মধ্যে আটকে রাখতে পারলেই বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র সরকার গঠনের ধারে কাছে আসার সম্ভাবনা শেষ করে দেওয়া যাবে। তাই কংগ্রেসের ইস্তাহারের প্রতিটি পৃষ্ঠা তুলে ধরে ধরে রাহুল গান্ধীদের মনোবাঞ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কংগ্রেসের ইস্তাহার বোধ হয় দলের নেতারাও এত খুঁটিয়ে পড়েননি। মোদী সেখানে কখনও মুসলিম লিগের ভাবনা, কখনও নকশালদের মতাদর্শ খুঁজে বার করছেন। দ্বিতীয়ত, মোদী মুসলিমদের সম্পর্কে ফের আতঙ্ক তৈরি করছেন। হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়া হবে বলছেন। কংগ্রেস হিন্দুদের সম্পত্তি মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চায় বলে প্রচার করছেন। সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্বের ভাবনার মধ্যেই মুসলমানদের সম্পর্কে আতঙ্ক ও বিদ্বেষ বা ‘ইসলামোফোবিয়া’ লুকিয়ে রয়েছে। সেই মতাদর্শ মেনেই মুসলমানদের সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছেন মোদী। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, ধনী-গরিবের অসাম্য, নির্বাচনী বন্ডে বিজেপির বিরুদ্ধে চাঁদা নিয়ে সরকারি বরাত পাইয়ে দেওয়া, ইডি-সিবিআইয়ের ভয় দেখিয়ে বন্ডের মাধ্যমে তোলাবাজির অভিযোগ, নজর ঘোরাতে এর থেকে বড় অস্ত্র আর কী হতে পারে?
প্রশ্ন এখন একটাই: এই কৌশলে কাজ দেবে কি না? যদি কাজ দেয়, তা হলে নরেন্দ্র মোদী প্রমাণ করবেন, তিনি একই সঙ্গে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে ফেলেছেন। সেই ভোটব্যাঙ্ককে বার বার একই দাওয়াই দিয়ে ভিজিয়ে ফেলার কৌশলও তাঁর করায়ত্ত। ২০০২-এ তিনি ভোটপ্রচারে মুসলিমদের নিশানা করে একটি মাইলফলক তৈরি করেছিলেন। ২০২৪-এ নতুন মাইলফলক তৈরি করতে পারেন কি না, তা লোকসভা ভোটের ফল বলে দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy