নিশানায়: ২০২৪ সালের ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত গ্লোবাল সামিট’-এর মঞ্চে শিল্পপতি গৌতম আদানি। ছবি: পিটিআই।
বছর তিনেক আগের কথা। রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ের ক্ষমতায় তখনও কংগ্রেসের সরকার। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত মুশকিলে পড়ে সনিয়া গান্ধীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। রাজস্থানে আদানি গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপরে গোটা রাজ্য নির্ভরশীল। তার কয়লার জোগান আসে ছত্তীসগঢ়ে আদানিদের কয়লা খনি থেকে। কিন্তু জনজাতিদের আপত্তিতে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল জঙ্গলের মধ্যে খনি থেকে বাড়তি কয়লা তোলার অনুমতি দিচ্ছিলেন না। ভয়, রাজস্থানে কয়লা পাঠাতে গিয়ে তাঁকে জনজাতিদের ভোট হারাতে হবে। ও দিকে রাজস্থান অন্ধকারে ডুবে গেলে গহলৌতের গদি নড়ে ওঠার আশঙ্কা।
শোনা যায়, রাহুল গান্ধী দুই মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে বসেছিলেন। রাহুলের বৈঠকের পরে ছত্তীসগঢ়ে আদানিদের কয়লা খনি থেকে রাজস্থানে আদানিদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা যাওয়া শুরু হয়েছিল। কংগ্রেস অবশ্য খাতায়-কলমে রাহুল গান্ধীর এই মধ্যস্থতার কথা স্বীকার করেনি। কারণ রাহুল গান্ধী তার আগে থেকেই ‘অম্বানী-আদানি’-দের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
কংগ্রেসের অন্দরমহল জানে, সনিয়া গান্ধী কর্পোরেট জগতের সঙ্গে প্রকাশ্যে দূরত্ব রেখে চলতেন। তবে শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করতেন না। তাই তাঁদের নাম করে আক্রমণও করতেন না। কিন্তু রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শন কোনও দিনই শিল্পপতিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষায় বিশ্বাসী নয়। তাঁর কাছের নেতারা বলেন, কোনও শিল্পপতির বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। তিনি শিল্প-বিরোধী নন, শিল্পমহলের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলার পক্ষপাতী।
এখানেই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর পার্থক্য। অন্তত এত দিন তা-ই ছিল। নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই মুকেশ অম্বানী-গৌতম আদানিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে দ্বিধাহীন। নরেন্দ্র মোদীর বরাবরই অবস্থান ছিল, শিল্পপতিরাই দেশে সম্পদ তৈরি করেন। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে তিনি ভয় পান না। শিল্পপতিদের কেন অপমান করা হবে? কেন তাঁদের চোর-ডাকাত বলা হবে?
কে জানত, সেই নরেন্দ্র মোদীই হঠাৎ রাহুল গান্ধীকে প্রশ্ন করবেন, তিনি অম্বানী-আদানির থেকে টেম্পো ভর্তি কালো টাকা পেয়েছেন কি না!
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা? হয়তো তা-ই। না হলে আর নরেন্দ্র মোদী পাঁচ বছরে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়াবেন কেন?
ঠিক পাঁচ বছরই। এবং একশো আশি ডিগ্রিই। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জিতে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদী একেবারে লাল কেল্লা থেকে বলেছিলেন, শিল্পপতিরাও দেশের সেবা করছেন। তাঁরা দেশের জন্য সম্পদ তৈরি করবেন। সম্পদ তৈরি না হলে তার পুনর্বণ্টন হবে কী ভাবে? তাই শিল্পপতিদের খাটো করা উচিত নয়। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা উচিত নয়। পাঁচ বছর পরে আর একটি লোকসভা নির্বাচনে জিততে মরিয়া নরেন্দ্র মোদী প্রশ্ন করছেন, রাহুল গান্ধী কি অম্বানী-আদানির থেকে বস্তা ভর্তি করে কালো টাকা পেয়েছেন? কংগ্রেসের কাছে কি অম্বানী-আদানিদের থেকে টেম্পো করে টাকা পৌঁছেছে?
নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গান্ধী নতুন নন। এ দেশের রাজনীতিকরা চিরকালই শিল্পপতিদের দোষারোপ করাটা জনপ্রিয়তা অর্জনের সহজ রাস্তা হিসেবে বেছে নেন। তাই শিল্পপতিদের নাম-পদবি রাজনৈতিক আক্রমণের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে ছিল টাটা-বিড়লা। এখন অম্বানী-আদানি। দু’বছর আগের ফেব্রুয়ারিতে রাহুল গান্ধী লোকসভায় দাঁড়িয়ে অম্বানী-আদানিকে ‘এএ প্রজাতি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। রাহুল বলেছিলেন, করোনাভাইরাসের ডেল্টা, ওমিক্রন প্রজাতির মতো ‘এএ’ প্রজাতি গোটা অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সে দিন রাহুলের অভিযোগের জবাবে নরেন্দ্র মোদী পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, এ দেশের উদ্যোগপতিরা কি করোনাভাইরাসের প্রজাতি? এ কেমন কথা? কাদের সম্পর্কে এ সব বলা হচ্ছে? মোদী সে দিন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ষাট থেকে আশির দশকে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বলা হত। সে সময় কংগ্রেসের বিরোধীরা এই কথা বলতেন। এখন তাঁরা কংগ্রেসের শরিক। কংগ্রেস এখন তাঁদের ভাষাই বলছে। শুধু ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’-টা বদলে গিয়েছে। সেই নরেন্দ্র মোদীই এখন নিজে রাহুল গান্ধী অম্বানী-আদানিদের থেকে টাকা পেয়েছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
হঠাৎ কেন এর প্রয়োজন পড়ল?
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর প্রধান অস্ত্র রাফাল-চুক্তি। রাহুল বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী নিজে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে রাফাল-চুক্তির অঙ্গ হিসেবে বরাত পাইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই অস্ত্র কাজ করেনি। মোদী স্বস্তি পেয়েছিলেন। কারণ ২০১৪’য় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনিই শিল্পমহলের সুবিধার্থে জমি অধিগ্রহণ আইনে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। রাজ্যসভায় সেই বিল পাশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। রাহুল গান্ধী মোদী সরকারের গায়ে ‘স্যুট-বুট কি সরকার’-এর তকমা সেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে ইচ্ছে থাকলেও মোদী শিল্পমহলের স্বার্থে বড় মাপের কোনও আর্থিক সংস্কার করতে পারেননি। অম্বানীর সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্ত্বেও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জিতে বহাল তবিয়তে ফিরে আসার পরে নরেন্দ্র মোদী স্বস্তি পেয়েছিলেন। তাই দ্বিধাহীন ভাবে লাল কেল্লা থেকে তিনি বলেছিলেন, শিল্পপতিরাও দেশের সেবা করছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে তিনি ভয় পান না।
মোদী অবশ্য কথা রাখতে পারেননি। কৃষিক্ষেত্রে শিল্পমহলের বিনিয়োগের পথ সহজ করতে তিনি তিন কৃষি আইন এনেছিলেন। এক বছর ধরে চলা কৃষকদের আন্দোলনের চাপে উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে মোদীকে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। রাফালের ভূত অবশ্য তাঁর পিছু ছাড়েনি। বার বার অভিযোগ উঠেছে, নরেন্দ্র মোদী যেখানে যেখানে বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানেই আদানি গোষ্ঠী কোনও না কোনও বরাত পেয়েছে। শেষবেলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচনী বন্ড খারিজ হওয়ার পরে গোটা বিজেপিই ‘ব্যাকফুট’-এ চলে গিয়েছে। কোনও শিল্প সংস্থা যাতে গোপনে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে মোদী সরকারই নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এর যাবতীয় তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরে দেখা গিয়েছে, এর সবচেয়ে বেশি সুবিধা বিজেপিই পেয়েছে। যে সব সংস্থার বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআইয়ের তদন্ত চলছিল, বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার পরেই তদন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক সংস্থা বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের বরাত পেয়েছে। বা বরাত পাওয়ার পরেই গোপনে বিজেপিকে চাঁদা দিয়েছে। এমনকি কোভিডের টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির থেকেও বিজেপি কোটি কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে মোদী সরকার এই সংস্থাগুলিকে ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম বাড়ানোর ছাড়পত্র দিচ্ছে। রাহুল এখন মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুট কি সরকার’ বলছেন না। তিনি সরাসরি মোদী সরকারকে ‘অম্বানী-আদানির সরকার’-ই বলছেন।
যে নির্বাচনে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও বিষয় থাকে না, সেখানে এই সব নানা বিষয়ই ভোটারদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে। ২০১৪-র ভোটে ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন ছিল। ২০১৯-এ পুলওয়ামা-বালাকোটের পরে দেশপ্রেমের আবেগ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ২০২৪-এর ভোটে তেমন সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নেই। রামমন্দির ঘিরেও তেমন সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার আবেগ তৈরি হয়নি।
নরেন্দ্র মোদীকে তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। সেই কারণেই অম্বানী-আদানির নাম তাঁর মুখেও শোনা গিয়েছে। তিনিও রাজনৈতিক স্বার্থ কুড়োতে দেশের শিল্পপতিদের নাম করে বিপক্ষকে আক্রমণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। ভোট বড় বালাই। তা নরেন্দ্র মোদীকেও একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy