E-Paper

তা বলে কি প্রেম দেব না

কালের নিয়মে সরকারি ছানা এবং পোনাদের রমরমা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে। তারা সরকারের মুখ তো বটে, কালে কালে তারাই সরকার হয়ে উঠেছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

An image of pen

—প্রতীকী চিত্র।

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:১৫
Share
Save

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কবির মৃত্যু: লোরকা স্মরণে’-র শেষ লাইনটা মনে পড়ে? “আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন, বলেছিলুম কি না, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!”

আপনারা কবিতা পড়েন, লেখেন, তাই বললাম আর কী। তবে এই লেখাটা কবিতা নিয়ে নয়। লেখাটা আপনাদের আর আমাদের। প্রণম্য গৌরকিশোর ঘোষের একটি লেখার কথা মনে পড়ছে। তখন সম্ভবত মাছের দাম বেড়েছে। একটি বড় বাজারে মন্ত্রিমশাইয়ের উপস্থিতিতে ন্যায্য মূল্যে মাছ বিক্রি করা হল, প্রথম মাছটি বিক্রি হল তৎকালীন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর হাত দিয়ে। গৌরকিশোর ঘোষ ওরফে গৌড়ানন্দ কবি ওরফে রূপদর্শী সেই মাছটির সাক্ষাৎকার নিলেন। পোনা মাছ, সাংবাদিক তাঁকে সম্ভাষণ করলেন পোনাদা হিসাবে। পোনাদা বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আমাকে পোনা বলে ডাকবেন না, আমি সাধারণ পোনা নই। আমি সরকারি পোনা। মন্ত্রীর হাতে বিক্রি হয়েছেন, সরকারি পোনা তো হবেনই, অতঃপর তাঁকে সরকারি পোনাদা বলেই ডাকা হল।

কালের নিয়মে সরকারি ছানা এবং পোনাদের রমরমা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে। তারা সরকারের মুখ তো বটে, কালে কালে তারাই সরকার হয়ে উঠেছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। হুজুর মা-বাপ। বাংলা এবং হিন্দি বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে একটি চেনা চিত্রনাট্য হচ্ছে ছানা আর পোনাদের রাজত্ব। তারা তোলা তুলবে, মহিলাদের উপর অত্যাচার করবে, লোককে সপাং সপাং করে চাবুক মেরে পিঠের চামড়া তুলে নেবে, আর দৈবাৎ যদি কেউ তাদের পাল্টা প্রশ্ন করে, তা হলে বলবে, জানিস আমি কে?

কে আপনি? আমি অমুকের ছেলে, তমুকের শ্যালক, তমুকের ভাই, তমুকের ভাইয়ের ছেলে, তমুকের বোনঝি জামাই, তমুকের বোনের ভায়রা, তমুকের পেয়াদা, তমুকের জুতো পালিশ করি ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পর সব ভাল যার শেষ ভাল-র মতো নায়ক বা নায়িকার আবির্ভাব এবং দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন।

বাস্তবটা তেমন নয়। আজ যাকে আপনি নায়ক বা নায়িকা ভাবলেন, পরশু তিনিই ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাজা’ হয়ে বসলেন।

সাধে কি আর শাহরুখ খান বলেছেন, ওই নায়ক-টায়ক নয়, আপনিই সব, একটি আঙুলে বোতাম টিপে ছলাকলা ঘুচিয়ে দিন, সব তাড়ান। তবে আমরা সাধারণ মানুষেরা আবার নায়ক-নায়িকাই পছন্দ করি বেশি। পর্দায় তারা ধাইধপাধপ সরকারি ছানা-পোনাদের পেটাবে, আর আমরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাব। নিজেরা বেশি কিছু করার ঝুঁকি নেব না। কিন্তু যারা নেবে তাদের ভয়ানক বিপদ।

তবে পুরনো আমলের মানুষেরা ’৪২ নামের ছায়াছবির কথা নিশ্চয় ভুলে যাননি। পুলিশ অফিসাররূপী বিকাশ রায় কী অত্যাচারই না করত লোকেদের উপরে, শেষে তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে ছুটল স্বাধীনতাকামী জনতা। তখন কোথায় উর্দি, কোথায় টুপি, কোথায় বোলচাল। এই রকমই হয়।

তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। সকলেই নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, এই রকম অত্যাচারী লোকদের বেশির ভাগেরই হাতে আবার চাবুক থাকে। তারা অন্যদের ছাল-চামড়া তুলে নেয়, গুটিয়ে দেয়ও বলতে পারেন। বেশ সপাং সপাং করে শব্দ হয়, লোকদের পিঠ রক্তাক্ত হয়, তারা লুটিয়ে পড়ে আর পৈশাচিক হাসি হাসতে থাকে চাবুকধারীরা। তা বাস্তবে এই সরকারি ছানা আর পোনারাও চাবুকের শব্দ শোনাতে ভালবাসে। সকলের সামনে চাবুক খাচ্ছি, পুলিশ জেলে নিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়টা নিশ্চয় ভাল লাগবে না, অতএব আমরা ভয় পাব, কুঁকড়ে যাব। ছানা আর পোনারা এটাই চায়।

কিন্তু এটা আমরা করব না, আমরা রুখে দাঁড়াব, একে একে, মাস্টারমশাইয়ের মতো। আতঙ্ক ছবিতে ভয় পেতে পেতে, ‘আপনি কিছুই দেখেননি’ শুনতে শুনতে এক দিন মাস্টারমশাই লাঠি নিয়ে যেমন তাড়া করেছিলেন গুন্ডাদের, ঠিক সেই রকম। আর চাবুকধারীদের তো সেটা দেখা অভ্যাস নেই, তাই তারা এ বার ভয় পেতে শুরু করবে। সব থেকে মজা হবে, যখন কেউ আর ভয়ই পাবে না। কারণ কলম আছে, ক্যামেরা আছে। আমরা লিখতে পারি, বলতে পারি, ছবি তুলতে পারি। সরকারি ছানা আর পোনারা আমাদের শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারবে না।

লেখা পোড়াবে? ডিস্ক নষ্ট করবে? করুক, মন পোড়াতে পারবে না। আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, পরাণ বান্ধিবি কেমনে! ভেবে দেখেছেন, গানটা কতটা রাজনৈতিকও হতে পারে?

সত্য ডাকছে, অভিসারে কেউ না কেউ তো যাবেই, লিখবে। আমরা লিখব, শব্দের সঙ্গে, অক্ষরের সঙ্গে আমাদের প্রেম, আমরা যাব সত্যের অভিসারে, আমরা লিখব। আমরা লিখব, আমরা লিখব।

না লিখে আমরা থাকি কী করে বলুন তো? আপনারা কু-কথা বলবেন, ধমক দেবেন, মাংস ছুড়ে দেবেন, সেটা আপনাদের কাজ হে সরকারি ছানা ও পোনাদাদারা। তা বলে কি প্রেম দেব না, যদি মারো কলসির কানা! এই গানটা ফিচেলের মতো ক’দিন ধরেই মনে গুনগুন করছে। প্রেমের জায়গায় খবর বসিয়ে নিতে হবে এই যা।

সত্যি কথা বলতে কী, এই লেখাটা প্রেমের নয়, কবিতার নয়। শুধু অক্ষরের, শব্দের, সত্যের। যে ভালবাসা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে চাই না কোনও দিন। আমরা লড়াইয়ের নিয়ম মেনে লড়াই করতে শিখেছি। আমাদের বর্ম ফুটো হয়েছে কোনও কোনও দিন, লোকে আমাদের বলেছে হেরো। লোকে বলবে পালিয়েছে।

আমরা সহ্য করেছি। অপেক্ষা করেছি। লিখেছি। লেখা ছাড়া কী-ই বা আছে আমাদের? আমাদের লিখতেই হবে।

দায়বদ্ধতা একটি ভারী শব্দ, আমরা যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করে চলেছি।

আমরা মনে রাখছি জেলে যাওয়া সহকর্মী তরুণের স্ত্রী আমাদের বলেছে সাংবাদিকতা নামক পেশাটার প্রতি তাঁরও দায়বদ্ধতা আছে। সেটা তাঁর শক্তি।

আমরা মনে রাখছি বছরকয়েক আগে ভিত্তিহীন অভিযোগের তাড়ায় মাসের পর মাস পরিবারের মুখ দেখতে না পাওয়া সহকর্মী যুবক এখনও লিখে চলেছে।

দায়বদ্ধতা একটি ভারী শব্দ। আমরা শব্দটাকে জড়িয়ে ধরতে লিখে যাচ্ছি, ছবি লিখছি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Political Violence Control Writing Habit Photographs

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।