জলমগ্ন: যমুনার জলে ভেসে যাওয়া নয়াদিল্লির রাজপথ, ১৬ জুলাই। ছবি: পিটিআই।
এক মাসের মধ্যে দু’বার জলমগ্ন হল দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
২৬ জুলাই ভোররাতের প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ডুবে গেল নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডার বিস্তৃত অংশ। হিন্দন নদী উপচে গেল জল... পথঘাট হয়ে উঠল নদী। আবার আরও কত ছোট ছোট বসতি ভেসে যাবে। ‘ট্রান্স যমুনা’ বা যমুনার অপর পাড়ের গল্পটা দিল্লিবাসীদের কাছে নতুন কিছু নয়। জনসংখ্যার চাপে ফুলেফেঁপে ওঠা রাজধানীর জনপদ আনন্দবিহার ময়ূরবিহার ছাড়িয়ে ‘ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন’ (এনসিআর)-এ মিশে গিয়েছে বহু আগেই।
জুলাই মাসের প্রথমার্ধেই গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছে দিল্লি। ঝাঁ-চকচকে ১৬ লেনের হাইওয়ে, যার অপর নাম দিল্লি মিরাট হাইওয়ে অথবা ন্যাশনাল এক্সপ্রেসওয়ে ৩, সেই পথে দিল্লির অফিস যেতে গিয়ে দেখি এক আশ্চর্য দৃশ্য, যমুনার ব্রিজ থেকে যেটুকু যমুনা দেখা যায় তার আশেপাশে আরও বহু অংশে প্রচুর গাছপালা জলের ভিতর থেকে মাথা তুলে আছে। আরও একটা দৃশ্য দেখা যায়, অতি উন্নত মিরাট হাইওয়ের দু’পাশের ফুটপাতে সারি সারি বস্তি বা ঝুপড়ির উদ্ভব ঘটেছে। ম্লানমুখ নারী ও প্রচুর শিশুকে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কাচা কাপড় টাঙিয়ে আড়াল রচনা করার করুণ প্রয়াস, দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনী ফ্লেক্স অথবা নিছক প্লাস্টিক শিট দিয়ে জোড়াতাপ্পি ঘর বাঁধার, ক্ষণিক মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির প্রয়াসও।
১২ জুলাই সমস্ত যমুনা তীরবর্তী দিল্লি প্লাবিত। জল যমুনা থেকে উঠে এসেছে দিল্লির রাজপথে। রাজঘাট থেকে শুরু করে হুমায়ুনের সমাধি। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে জল উঠে আসার খবরে মিম-এর হুড়োহুড়ি। প্রায় প্রতি অফিসযাত্রীর ৩০ মিনিটের পথ সে দিন অন্তত দু’ঘণ্টা ধরে পেরোতে হয়। আইটিও অঞ্চলের প্রতি অফিস, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে এজি অফিস চত্বর জলমগ্ন হয়। লক্ষ করি, যমুনা তীরবর্তী নিম্নবিত্ত পাড়াগুলো নিমজ্জিত। ফলে বাড়ির ছাদে গরু ও রেফ্রিজারেটর চেপেছে। মানুষ নিজের কাগজপত্র, টাকাকড়ি, গয়না সম্বল করে ছাদে বসে আছেন, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। সরকার জলমগ্ন অঞ্চল থেকে ন্যাশনাল ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট-এর টিম পাঠিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষকে উদ্ধার করল। তাঁদের ঠাঁই হল সার সার দুগ্ধধবল আধুনিক তাঁবুর নীচে, কিন্তু রাজপথেরই পাশে। বড় ফ্লাইওভারগুলির তলেও এসে উঠেছেন মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। ফ্লাইওভারের নীচে চিত্রবিচিত্র ভারতীয় শিল্পকলা, মহান ভারতের কীর্তি জানান দেওয়া— তার সামনে অজস্র মানুষের ঢল। গৃহচ্যুত। উচ্চবিত্তদের বাসস্থান কমনওয়েলথ গেমস ভিলেজ-এ জল উঠল। উঠল সিভিল লাইনস-এ, ডিফেন্স কলোনিতে। হরিয়ানার হথনী কুণ্ড ব্যারাজের জল ছাড়ার ফল বুধ ও বৃহস্পতির জল। যমুনার জল বিগত সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে ১২ জুলাই ২০৮ মিটার ছুঁয়েছিল, বিপদসীমার আড়াই-তিন মিটার উপরে। ১৩ জুলাই দিল্লির রাজ্যপাল জেনারেল মিটিং করে ঘোষণা করলেন স্কুল বন্ধ, জরুরি পরিষেবা বাদে সব অফিস বন্ধ করার কথা। আবার ২৬ জুলাই ছুটি দিতে হল স্কুলগুলিকে। দ্বিতীয় বারের জন্য জলমগ্নতার বেহাল দশা দেখল দিল্লি।
এখন প্রতি আধুনিক শহর অজস্র কংক্রিট ফ্লাইওভারের ফিতে দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া। এই উপহারটি জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে উন্নয়নের নামে, এখন এই চূড়ান্ত আবহাওয়াঘটিত দুর্বিপাকের সময়ে তা উপহাস ছাড়া কিছু নয়।
একদা ইউনিয়ন টেরিটরি থেকে সহসা রাজ্য বনে যাওয়া দিল্লির একটা বিশাল সমস্যা হল, এখনও আইনশৃঙ্খলা থেকে ভূ-রাজস্ব দফতর, নগরোন্নয়ন থেকে আরও বহু দফতর কেন্দ্রীয় সরকারের কুক্ষিগত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য রাজ্যকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকি বহু অংশে অন্য রাজ্যগুলোর প্রাপ্য স্বাধীনতা নেই। রাজধানী হওয়ার ফলে দিল্লির ‘আলাদা স্টেটাস’ এসে যে গভীরতর লাভ হল, তা এই। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, থুড়ি যমুনা মনোযোগ পায় না। কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের ঝগড়ায় সারা সময় মিডিয়া মুখরিত থাকে। আইআইটি দিল্লি-র রিপোর্ট পড়ি ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান-এর উপর। পাঁচ বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে নানা মডেলে ফেলে সেই অধ্যয়ন দেখাচ্ছে, দিল্লি শহরের নানা নালা-নর্দমার পরিচালন-প্রশাসনে ব্যাপৃত আছে সেচ ও বন্যাত্রাণ দফতর, পূর্ত দফতর, দক্ষিণ দিল্লি পুরসভা, উত্তর দিল্লি পুরসভা, পূর্ব দিল্লি পুরসভা, দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটি থেকে শুরু করে অন্তত ১৩টি সংস্থা। কাজের সমন্বয় কতটা সম্ভব এই প্রেক্ষিতে, তা সহজেই অনুমেয়। ওই রিপোর্ট ছবি তুলে দেখিয়েছে, বৃষ্টি-জল বেরোবার নর্দমা ময়লায় আটকা পড়েছে কোথাও, কোথাও সেই পথ আটকে মাটি ভরাট করে বাড়ি তৈরি হয়েছে, কোথাও কঠিন বর্জ্য ডাঁই করে রাখা আছে। জল বেরোবার পথ নেই।
তাত্ত্বিকরা আক্ষেপ করছেন, অক্ষরধাম মন্দির থেকে কমনওয়েলথ ভিলেজ— সবটাই জবরদস্তি করে যমুনা সংলগ্ন সমতল দখলদারি করে তৈরি। আগেই বললাম, দিল্লি নিকাশির মাস্টারপ্ল্যানের কথা। আন্তর্জালে, ‘ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান’ দিয়ে খুঁজলেই দেখা যাবে, বিষয়টা বার বার সংবাদমাধ্যমে এসেছে অগস্ট ২০২১ থেকে। মাঝে মাঝেই উত্থাপিত হয় ও ফাইলের তলায় চাপা পড়ে এমন বহু বিষয়ের মতোই। আইআইটি দিল্লি থেকে জমা পড়া ২০২১-এর মাস্টারপ্ল্যানটি নাকি ‘প্রয়োগ করা ভারী দুরূহ’, তাই খারিজ হয়। ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেম’ নামক বিষয় নিয়ে চেন্নাই শহর তোলপাড় হয়েছিল বছর পাঁচ-ছয় আগের এক বন্যায়। দিল্লিতেও সেই জলনিকাশি ব্যবস্থার নিদানই সার। তার মুখবন্ধেই বার বার উল্লিখিত হয় যে, ছোট ছোট বৃষ্টির ঘটনাতেও দিল্লি বার বার জলমগ্ন হয়। অর্থাৎ, জুলাইয়ের এই অত্যধিক বৃষ্টিই দিল্লির বন্যার একমাত্র কারণ নয়, নিছক প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার ফল নয় অধিকাংশ বড় শহরের জলমগ্নতা।
দিল্লি রাজধানী বলে নয়, বেঙ্গালুরু হায়দরাবাদ চেন্নাই মুম্বই কলকাতা— আমাদের তাবড় স্মার্টসিটিগুলোতে অজস্র স্মার্ট প্রোজেক্ট নেওয়া হয়, চালু হয় হরেক নতুন বন্দোবস্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই গিয়ে পড়ে নরেশ গুহের লাইনে— এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম, এত পথ হেঁটে এত জল ঘেঁটে কী তবে পেলাম?
আমাদের দেশে প্রতিটি অতি উন্নত শহরে এই রকম একটি করে আঁচল বিছানো আছে। ড্রেনেজ প্ল্যানগুলো ধুলো খায়। নগরায়ণের প্রকল্পে বহু শুঁড়সম্পন্ন অক্টোপাসের মতো নানা সরকারি-আধা সরকারি বেসরকারি সংস্থার কাজে সঙ্গতি থাকে না। ধু-ধু বেগে শুধু হাইওয়ে ফ্লাইওভার আর বহুতল তৈরি হতে থাকে, যাদের নাম দেওয়া হয়, চূড়ান্ত বিচিত্র শ্লেষে, ‘অমুক ভিলেজ’ আর ‘তমুক ভিলেজ’।
এ মুহূর্তে কাগজ খুললেই দেখব চণ্ডীগড়, মুম্বই, গোয়াতে লাল সতর্কতা জারি। দিন কয়েক আগে রাজকোটে বন্যার খবর এসেছে। একটি রিপোর্ট বলছে ভারতের অধিকাংশ শহর এ বি সি ক্যাটেগরির যেখানেই পড়ুক, জলমগ্ন হওয়ার দোষ-মুক্ত কেউই নয়। অতিবৃষ্টি কেবল এর একটা দিক মাত্র। ভোপাল শহরে গ্রিন ট্রাইবুনাল শহরের পুরসভাকে এক কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করেছে ভোপাল হ্রদ ভরাট করে সেখানে নির্মাণ কাজ চালানোর জন্য। কেরল থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ, জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল কোটি কোটি টাকা জরিমানা করেছে নানা শহরের পুরসভাগুলির আবর্জনা থেকে শুরু করে বিবিধ বিষয়ে সমন্বয়ের অপদার্থতাকে লক্ষ করে। গোটা উত্তর ভারতে, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে অতিবৃষ্টি এখন এক বাস্তব ভীতি। এনডিআরএফ দিয়ে ত্রাণ। এটাই কি একমাত্র সমাধান? অসুখের পর ত্রাণের ওষুধ প্রয়োগ, না প্রতিষেধক? প্রতিষেধক হিসাবে এখন তুলে ধরা হচ্ছে ‘স্পঞ্জ সিটি’ নামক নতুন একটি মডেল। সচ্ছিদ্র স্পঞ্জের মতো কংক্রিট জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকফোকর রাখতে হবে শহর পরিকল্পনার সময়েই। নতুবা শানবাঁধানো শহর হয়ে উঠছে আদর্শ বন্যাস্থল। শহরাঞ্চলে বন্যার জল জমা রুখতে চিনে ২০০০ নাগাদ এই প্রযুক্তির আমদানি হয় প্রথম। নতুন পথ আবিষ্কার করা আজ আর অবশ্যকর্তব্য নয়, রীতিমতো পিছিয়ে আছে ভারতের নানা প্রান্তের শহরগুলি। যা করা উচিত ছিল গত কাল, তা কি আগামী পরশুও হবে? আবহাওয়ার পরিবর্তন এক দিকে যেমন বাস্তব সত্য, অন্য দিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিষ ফল ফলছে ইতিমধ্যেই।
এই সমস্তের ভিতরেই লক্ষ করেছি সামাজিক দিক। টিভির সাহসী মেয়ের জলে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং, আর তিনি মাইক এগিয়ে ধরলে সে মাইকে গৃহচ্যুত মহিলাদের কথা বলার আড়ষ্টতা। মিডিয়া এলে পুরুষেরা এগিয়ে আসেন, স্ত্রীদের কথা বলতে দিতে নারাজ। দেখেছি, ক্যামেরা দেখে বাড়ির ছাদের উপরে আশ্রয় নেওয়া মহিলারও লজ্জা পেয়ে সহসা ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে ফেলা। নিজেকে আড়ালে রাখতে আর মুছে দিতে চাওয়া মেয়েরা আজ পথে এসে গোপনীয়তাহীন ঝুপড়িতে আশ্রিতা।
উন্নয়নের আলোমাখা শহরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে গ্রাম। যমুনা-পাড়ের ছোট ছোট পাড়াগুলি ডুবে রয়েছে এখনও। জল সরে গেলে সেখানে থাকবে পাঁক, পানা, কীট, কেঁচো, সাপ। ফ্রিজ খুললে দেখা যাবে এক হাঁটু কাদা। সে ফ্রিজ হয়তো চলবে না। সঞ্চয়ের শেষ বিন্দু দিয়ে তৈরি করা যমুনা কিনারের বাড়ির বাসিন্দারা আবার ফিরবেন, বাড়ি পরিষ্কার করবেন, অপেক্ষা করবেন পরের বর্ষা অবধি। অনিশ্চিতির মধ্যে বাস করবেন দেশের সবচেয়ে জাঁকালো, ঝাঁ-চকচকে শহরেরই এক কোনায়, যাঁদের শ্রম দিয়ে তৈরি হয় এই শহরের অনেক শোভার জিনিস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy