জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারে আমরা সবাইকে টপকে যাব কি না, কিংবা কোভিডের মোকাবিলায় আমরাই সবার আগে দৌড়চ্ছি কি না, বা সামনের দু’বছরে অর্থনীতিতে ঠিক কী হতে চলেছে, এ সব ছাপিয়ে মধ্যবিত্তের আশঙ্কা এবং এক অনিশ্চিত আর্থিক ভবিষ্যতের সমস্যা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক-এক করে কারণগুলো দু’এক কথায় বলার চেষ্টা করি।
ব্যাঙ্কে সুদের হার কমেছে ভীষণ ভাবে। এই অতিমারির সময় দেশে প্রচুর টাকা ঢুকেছে— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার টইটম্বুর, ফলে টাকার জোগানের অভাব নেই। তাই সুদের উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপও নেই। এক বিশাল জনসংখ্যার স্থির আয়ের পেনশনভোগী, জীবনের সব টাকাকড়ি ব্যাঙ্কে মজুত রাখা মানুষজনের আয় ক্রমাগত কমেছে বেশ কিছু দিন ধরে। এর উপরে চাপানো হয়েছে সরকারি ব্যাঙ্ককে বার বার ‘খারাপ’ আখ্যা দিয়ে সেগুলো বিক্রি করার বা বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করার ভয় সৃষ্টি। ‘সরকারের টাকা মার যায় না’, দলমত-জাতপাত-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আসমুদ্র হিমাচল মানুষের এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত লাগছে। বারে বারে এত দিন যাবৎ অনুচ্চারিত প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আইন করে বলা হচ্ছে, ব্যাঙ্ক ফেল করলে সরকার আমাদের সবচেয়ে বেশি কত টাকা দিতে পারে। যাতে সে রকমটা হলে কেউ কোর্টকাছারি করে সরকারকে বিব্রত না করে। সরকার আপনার আর্থিক
বিপদে সাহায্য করবে না। অনিশ্চিত আশঙ্কার এ বড় ভয়ঙ্কর দিক।
গত কাল যিনি বছরে ২০ হাজার টাকা বিমার প্রিমিয়াম দিতেন, আজ সমপরিমাণ মূল্যের বিমার জন্য তিনি দ্বিগুণের বেশি টাকা প্রিমিয়াম দিচ্ছেন। এ রকম ভয়াবহ প্রচ্ছন্ন ‘আয়কর’ আমরা আগে দেখিনি। ভারতীয় অর্থনীতির নতুন জীবনাদর্শ নিয়ে আমরা সতত দুশ্চিন্তায় ভুগছি— সরকারি বিমা কোম্পানি বাঁচাতে চাইলে আমাদের বাড়তি কর দিতে হবে, সরকার কিছু দেবে না। এর সঙ্গে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে সরকারি সংস্থা কম লাভ করলেই সরকার তাকে বিক্রি করে দেবে। লোকসান করলে তো কথাই নেই। অতিমারির প্রকোপে এখন সরকারি সংস্থাগুলো বেশি করে ধুঁকছে— যখন তাদের বাজারি মূল্য কম, তখনই তাদের বেসরকারি হাতে দিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে, কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। এ সবের ফলে মানুষের ভয় আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। এক দিকে, দেশের ভিতর কাঁচা টাকার বা লিকুইডিটির অভাব নেই। বেসরকারি বড় ব্যবসায়ীদের হাতেই টাকার জোগান সব সময় বেশি। অন্য দিকে, সরকারের হাতে টাকা নেই, আর সরকার বাইরে থেকে ধার করলেও, সেই টাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শক্তপোক্ত করতে খরচ করছে না। ফলে সরকারি বেসরকারিকরণ নীতিকে বেসরকারি পক্ষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করে চলেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হাতবদল করাই কি সরকারি নীতির মূল লক্ষ্য হবে?
হতেই পারে, সরকার ঠিক করেছে পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ছাড়া সরকার আর কোনও কিছুতেই খরচ করবে না, বা সব বেসরকারি হাতে তুলে দেবে। সরকারি ব্যাঙ্ক বলেও কিছুই থাকবে না। সরকারি সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি সংস্থার চক্ষুশূল। কারণ, আর যা-ই হোক, প্রতিযোগিতার হাত মুচড়ে বাজারে একচেটিয়া ক্ষমতা কায়েম করার পথে তা বাধার সৃষ্টি করে। নিঃসন্দেহে দিনের পর দিন লোকসানে চলেও সরকারি পয়সায় কোনও সংস্থা অনন্তকাল টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো কেন লাভের মুখ দেখছে না, কোন সংস্থাকে কী ভাবে বাঁচানো যায়, কী ভাবে সেই সংস্থাগুলোতে কর্মরত মানুষদের কথা ভাবা যায়, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের ‘মন কি বাত’ অজানাই থেকে যায়। শুধু সম্পত্তি বিক্রি করে তিলে তিলে বিনিয়োগ করে গড়ে তোলা মূলধনকে অন্যের হাতে তুলে দিতেই সবার উৎসাহ। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সব কর্মচারী অজানা আশঙ্কায় জর্জরিত।
ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ি ঋণ নিয়েও গভীর উদ্বেগ। যাঁরা ব্যাঙ্ক ম্যানেজারদের ফোন করে ঋণ দিতে বলেন, কিন্তু নিজেদের নাম-পদ-ফোন নম্বর গোপনই রাখেন; যাঁরা এক ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা ধার শোধ না দিয়ে নিজেদের অন্য সংস্থায় সেই কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন; যাঁরা একটি সংস্থাকে রুগ্ণ করে অন্য কোম্পানিতে রুগ্ণ কোম্পানির টাকা পাচার করেন— তাঁরা প্রত্যেকেই এই উদ্বেগের জন্য দায়ী। অসুখ নিয়ে তীক্ষ্ণ আলোচনা না করে রোগীকে মেরে ফেললে অসুখ নির্মূল হয় না। ব্যাঙ্কের অসুখগুলোর দায় বর্তায় সব কর্মচারী আর সাধারণ আমানতকারীর উপর। অনিশ্চিত আশঙ্কা এখানেও পরোক্ষ আয়করের মতো ধাওয়া করছে মধ্যবিত্তকে।
কৃষি বিলেও খানিকটা তা-ই হচ্ছে। কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া উত্তম প্রস্তাব, সন্দেহ নেই। কিন্তু ন্যূনতম দামের ব্যবস্থাটা উঠে গেলে ভবিষ্যতে অবশ্যম্ভাবী একচেটিয়া অত্যাচারের ভয় কৃষকদের গ্রাস করছে। কেন্দ্রীয় সরকার আজ আর কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্যের ভূমিকা স্বীকার করতে চায় না। রাজ্যগুলো যদি মান্ডি চালানোর পরিকাঠামো সজীব রাখতে না পারে, এমএসপি উঠে যাবে। এখন এমএসপি বাড়ালেও সে সমস্যার সমাধান হবে না। কৃষকদের পিঠ ঠেকানোর দেওয়ালটা সরকারকেই তৈরি করে দিতে হবে।
সরকার আসলে জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু, সরকারের আচরণ দেখে মনে হয়, সব স্তরের মধ্যবিত্ত, কৃষকদের বৃহদংশ এবং রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তারা যেন সম্মুখসমরে নেমেছে। মুনাফা কত, সব বিষয়ে এটাই শেষ হিসেব। ফলে অনেক নীতিই ভুল বার্তা দিচ্ছে। আর, অনিশ্চিত আশঙ্কায় মধ্যবিত্ত একেবারে ভাল নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy