গভীরতর অর্থে বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ধর্মপ্রসূত ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক কার্যকলাপের ধ্যানধারণার মধ্যে একটা সংঘাত জড়িয়ে আছে। প্রতীকী ছবি।
কিছু দিন আগে শুনতে পেলাম কেন্দ্রীয় সরকার সরকারি স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে ডারউইন সাহেবের নামে প্রসিদ্ধ বিবর্তনবাদ সরিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের পুনর্লিখনও শুরু হয়েছে বলে শুনছি। ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো বিখ্যাত গবেষণা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কিছু জানবে না, এর মতো ভুল পদক্ষেপ আর হয় না। দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা শুনলাম ‘কে বাঁদর থেকে মানুষ হতে দেখেছে’ এই বলে হাসিঠাট্টা করেছেন। সব মিলিয়ে অত্যন্ত দুঃখের এবং লজ্জার ঘটনা।
কিন্তু এই প্রসঙ্গে যেটা বলার, গভীরতর অর্থে বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ধর্মপ্রসূত ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক কার্যকলাপের ধ্যানধারণার মধ্যে একটা সংঘাত জড়িয়ে আছে। বৈজ্ঞানিক মহল বা বিজ্ঞান পৃথিবীর সৃষ্টি এবং মনুষ্যজাতির উত্থান ও বিবর্তন সম্পর্কে কোনও ‘ডিভাইন ইন্টারভেনশন’ বা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করেন না। যাঁরা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করেন, তাঁদের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ডারউইন সাহেবের বৈজ্ঞানিক মতবাদ। সহজতম ভাষায় সেই পুরনো প্রশ্নটিতে ফিরতে হয়, ঈশ্বর কি আছেন? তিনিই কি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? না কি পৃথিবী নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা? এই প্রশ্নের সামনে বিজ্ঞান যেন বিশাল বড় ঝাঁটা নিয়ে অজ্ঞানতার ময়লা পরিষ্কার করছে, আর বলছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। অদৃশ্য সব সত্য এক দিন উদ্ঘাটন হবেই। বিজ্ঞানই যে আসল ঈশ্বর, সেটা বোঝা যাবে।
ভারতের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদ বর্জনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের হিন্দু ধর্ম উৎসারিত আচার-সংস্কার ইত্যাদি ধ্যানধারণার সঙ্গে যুক্ত। মনে না করে উপায় নেই যে, এত কাল ধরে ভারতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞানবিষয়ক পরীক্ষা দেওয়ার সময়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সত্যের বহুপ্রমাণিত গণিত সমৃদ্ধ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরীক্ষার হল-এ যাওয়ার আগে কপালে দই বা ঘি-এর টিপ পরে, যাবতীয় সংস্কার মেনে, বাবা-মা-গৃহদেবতার আশীর্বাদ নিয়ে বেরোত। সব ধরনের ঈশ্বরবিশ্বাসকে নস্যাৎ করা রাজনীতির মানুষদের পরিবারও এ সবের ব্যতিক্রম করেনি। গোটা ভারত যাঁর নাম নিয়ে সারা পৃথিবীতে গর্বিত হয়ে বিচরণ করে সেই জগদ্বিখ্যাত গণিতবিশারদ রামানুজন বলতেন, অনেক দুরূহ রাশিমালার ক্রমানুসারের ধারণা তাঁর ইষ্টদেবী স্বপ্নে তাঁকে দিয়ে যেতেন। আমার দক্ষিণ ভারতীয় যত গণিতবিশারদ বন্ধু আছেন, তাঁদের ঈশ্বরবিশ্বাস গ্র্যানিট পাথরের মতো।
অর্থাৎ, কেউ বলতেই পারেন যে, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অত্যাধুনিক গবেষণালব্ধ উপাদান থাকুক বা না থাকুক, তার প্রভাব এ দেশের ব্যবহারিক জীবনে তেমন পড়ে না, পড়েনি। বৈজ্ঞানিক শিক্ষার অনুশাসনকে এ দেশের মানুষ জীবনের অন্তঃস্থিত সত্য-মিথ্যের বাছবিচারে তেমন ভাবে ব্যবহার করে না। ফলে সমস্যা অনেক গভীরে।
বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার তেমন এক্তিয়ার আমার নেই। এক মেধাবী কম্পিউটার বিজ্ঞানী বন্ধু আমাকে বলেছিল, যে সব বিষয়ের সঙ্গে ‘বিজ্ঞান’ কথাটিকে জুড়ে দিয়ে বিজ্ঞানের বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করতে হয়, সেগুলো আসলে বিজ্ঞান নয়। অবশ্যই তার মধ্যে কম্পিউটার বিজ্ঞান অন্যতম। অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র এই তিনটি বিষয় ছাড়া আসলে যথার্থ বিজ্ঞান বলে আর কিছু হয় না। এ কথা সত্যি যে, বিজ্ঞানচর্চার আওতায় ব্যাপ্তি বাড়তে বাড়তে অর্থনীতির মতো ‘এও হয় তাও হয়’ বিষয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান কথাটি জুড়ে দিয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে ১-এর সঙ্গে শূন্য গুণ করলে শূন্য হয়। এমনটি ঠিক বিশ্বাসনির্ভর ফলাফল নয়। অঙ্ক কষে যা পাওয়া যায় সেটা সত্য, যা পাওয়া যায় না তা সত্য নয়। সেটাই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ফল সব সময় সত্যি।
কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি তাই? ৫০০ জনকে নিয়ে পরীক্ষা করে যে ওষুধটি পাওয়া গেল, সেটি ৫০০০ জনের জন্য কাজ করলেও, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও ৫০০টি একেবারে অন্য ওষুধের মতো, এও তো সত্যি। একে ঠিক গণিতের মতে বিজ্ঞান বলা যায় না। সাধারণ মানুষ হয়তো গণিতের উল্টো দিকে অন্য ধরনের বিজ্ঞানচর্চায় খানিকটা অপ্রমাণিত বিশ্বাসের ছোঁয়া দেখতে পায়। আর সেখানেই শুরু হয় মুশকিল। দু’ধরনের সমস্যা এর থেকে উদ্ভূত হয়।
প্রথমত, বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস গভীরে পৌঁছয় না। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে একেবারে হালের বিজ্ঞানচর্চার সব ফলাফল দেওয়া থাকলে এবং সেই সিলেবাস বিশ্বের দরবারে নিবেদন করতে পারলে ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের আত্মশ্লাঘা হতে পারে। কিন্তু আগেই বলেছি ভারতের মানুষের ব্যবহারিক জীবনে তার প্রভাব দীর্ঘ কাল ধরে ন্যূনতম। নিজেদের ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ আর বৈজ্ঞানিক সত্যকে সমাজে জোরদার ভাবে প্রতিষ্ঠা করার ভিতর আকাশপাতাল তফাত থেকে গেছে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি গুরুতর। বিজ্ঞান যত দিন ‘এক দিন সব সত্য উদ্ঘাটিত হবে’ এমন একটি বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে এগোবে, তাকে লড়তে হবে মানুষের অন্য ধরনের বিশ্বাসের সঙ্গে। মানুষের অনেক ঈশ্বর। বিজ্ঞানের ঈশ্বরকে লড়তে হয় সম্মিলিত ঈশ্বরদের সঙ্গে, এখানে, ওখানে, যেখানে, সেখানে, সর্বত্র। বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসের লড়াইয়ে মানুষ এই জন্যই বারে বারে বিজ্ঞানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এখন ডান দিক বাঁ দিক, সব দিকেই ‘কৃত্রিম বুদ্ধি’ এবং ‘যান্ত্রিক শিক্ষা’ শব্দ দু’টি কান ঝালাপালা করে দেয়। মানুষ যা পারে না, মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার তথ্য বিশ্লেষণ করে কী ভাবে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হওয়া যায়, তার এক অমোঘ উদাহরণ এই পদ্ধতি। অথচ সেখানেও কিন্তু গণিতের মতো প্রত্যক্ষ উত্তর থাকে না। যেমন ধরুন, মোট পঞ্চাশটি কারণ সম্পর্কিত উপাদান দিয়ে লক্ষাধিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো গেল যে, সেই জন্যই বিশেষ ঘটনাটি ঘটছে। কিন্তু কেন ঘটছে, তা কেউ বলতে পারেন না।
ফলে বিসমিল্লার সানাই-এর ফুঁ, জাকির হোসেনের তবলার চাঁটি, আলি আকবর খাঁ সাহেবের হাতের জাদু, অথবা রবীন্দ্রনাথের সৃজনস্ফুরণ ইত্যাদিকে যে দিন গণিতের সাহায্যে অবিকল পুনর্নির্মাণ করা যাবে, সে দিনই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা আর একটু বাড়তে পারে। তত দিন অবধি শুনতে হবে ‘ঈশ্বরের জয়’, তা সে যে ঈশ্বরই হোন না কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy