Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Old Age Pension Scheme

অবসরের পর অনিশ্চিত জীবন

পেনশন, কর্মচারীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জিত অধিকার, কর্মচারীদের প্রতি সরকারের আর্থ-সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের এক গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা।

An image of Protest

সাম্প্রতিক কালে সরকারি কর্মচারীদের এত বড় মাপের সংগঠিত বিক্ষোভ দেখেনি এই দেশ। —ফাইল চিত্র।

সত্যব্রত পাঠক
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৮
Share: Save:

যা ছিল প্রথমে নিছক মৃদু কোলাহল, তা এখন পরিণত হয়েছে সমুদ্রগর্জনে। দিল্লির রামলীলা ময়দানে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের লক্ষাধিক কর্মচারী জড়ো হয়ে সম্প্রতি দাবি করলেন, পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফেরাতে হবে। সাম্প্রতিক কালে সরকারি কর্মচারীদের এত বড় মাপের সংগঠিত বিক্ষোভ দেখেনি এই দেশ।

পেনশন, কর্মচারীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জিত অধিকার, কর্মচারীদের প্রতি সরকারের আর্থ-সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের এক গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও বিভিন্ন সময়ে কর্মচারীদের পেনশন নিরাপত্তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একটি মামলায় (ডিএস নাকরা বনাম কেন্দ্রীয় সরকার, ১৯৮২) সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে মন্তব্য করে, পেনশন কেবল কাজের পুরস্কার নয়, তা হল আর্থ-সামাজিক ন্যায়।

দু’দশক জুড়ে নয়া পেনশন স্কিম (এনপিএস)-এর বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভে এখন চাকা ঘুরছে উল্টো দিকে। ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ ও পঞ্জাব পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয় জাতীয় বিচার বিভাগীয় বেতন কমিশন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এনপিএস চালু না করার সুপারিশ করেছে। কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা সিএজি ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা দানে এনপিএস-কে ‘ব্যর্থ’ বলেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০ ডিসেম্বর ২০২১, এনপিএস পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে বলেছে কেন্দ্রকে।

সংবিধানের ৩০৯ ধারা অনুসারে সরকার হল আদর্শ নিয়োগকর্তা যার কর্মচারী সুরক্ষা বিধিব্যবস্থা হবে সব কর্মক্ষেত্রের অনুসরণযোগ্য মডেল। সেই সাংবিধানিক অনুজ্ঞা মেনেই তৈরি হয়েছিল এক সুরক্ষিত, সুসংগঠিত পেনশন ব্যবস্থা। ২০০৪-এ তার বদলে আসে ‘কর্পাস বেসড পেনশন’ ব্যবস্থা। এর ফলে কর্মচারীদের পেনশনের অঙ্ক আর নিশ্চিত নয়, শেয়ার বাজারের ওঠানামার উপর নির্ভরশীল। কর্মচারীর বেতন প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্ক (১০ শতাংশ) কেটে নেওয়া হয় আগের মতোই, কিন্তু অবসর-পরবর্তী মাসিক পেনশন অনিশ্চিত। বহু কর্মচারী এই বাজারভিত্তিক পেনশন ব্যবস্থায় পাঁচ হাজার টাকারও কম পেনশন পাচ্ছেন। এই অনিশ্চয়তায় ক্ষুব্ধ বৃহত্তর কর্মচারী সমাজ, যাঁদের বেশির ভাগই গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি কর্মী।

পুরনো পেনশন ব্যবস্থায় কর্মচারীদের পেনশন নির্ধারিত হত অবসরকালীন মূল বেতন ও মহার্ঘ ভাতার হিসাব ধরে। কুড়ি বছর চাকরি করলেই পূর্ণ পেনশন মিলত। মূল্যসূচকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পেনশন বাড়ত। ছিল পারিবারিক পেনশনের সুযোগ, কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হলে বিশেষ গ্র্যাচুইটি। পেনশনে কিছু হ্রাসের পরিবর্তে এককালীন অর্থ পাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। নয়া পেনশন ব্যবস্থা কর্মচারীদের এই সব সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে মূল্যসূচকের সঙ্গে পেনশনের সম্পর্ক না থাকায় ক্ষতির জন্য ক্ষুব্ধ কর্মীরা।

লাগাতার আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু বদল এনেছে— ২০১৬ সালে ডেথ কাম গ্র্যাচুইটি ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছে, ২০১৯-এর এপ্রিল থেকে কর্মচারী পেনশন তহবিলে সরকারের দেয় অংশ ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৪ শতাংশ করেছে। তবু অনিশ্চয়তা আর অস্বচ্ছতার জন্য কর্মীদের আস্থা ফিরে পায়নি এনপিএস। অনেক রাজ্যে এনপিএস চালু হওয়ার পর বহু বছর কর্মচারীদের বেতন থেকে পেনশন তহবিলের জন্য টাকা কাটা হয়নি, সরকারের দেয় অংশও জমা পড়েনি। পেনশন বিনিয়োগের তহবিলই গড়ে ওঠেনি। ফলে সেই সব কর্মচারী অবসরের পর আরও কম পেনশন পাবেন।

এনপিএস তাঁদের জন্যই কিছুটা লাভজনক, যাঁরা ৩০ বছরের বেশি কাজ করেছেন, এবং উচ্চ বেতন পেয়েছেন। কম মেয়াদে চাকরি, এবং স্বল্প থেকে মাঝারি বেতনের কর্মচারীদের এনপিএস ব্যবস্থায় লাভ সামান্য, ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। রামলীলা ময়দানের সমাবেশ থেকে একটা মৌলিক প্রশ্ন বার বার উঠে এসেছে— কর্মচারীর বেতন থেকে পেনশন তহবিলে অবদানের হার যখন নির্দিষ্ট, নিজের মতো টাকা জমা করার কোনও স্বাধীনতা নেই, তখন অবসর-পরবর্তী পেনশন কেন সুনির্দিষ্ট হবে না?

৩১ জানুয়ারি, ২০১৩-এর হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীদের ২,৫০,০৫৮ কোটি টাকা ও রাজ্য সরকারের কর্মীদের ৪,৩২,৬৫৫ কোটি টাকা পেনশন তহিবল থেকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই টাকার সুরক্ষা কতটুকু? কয়েক বছর আগে এনপিএস-এর তদারকির দায়িত্বে থাকা ‘পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ জানিয়েছিলেন, শেয়ার বাজারে পেনশন তহবিলের ১৬০০ কোটি টাকা তলিয়ে গিয়েছে, যা ঋণ-জর্জরিত ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজ়িং অ্যান্ড ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস’-এর মাধ্যমে খাটানো হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সদ্য স্বাধীন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আদর্শ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল, তা আজ সঙ্কটে। সামাজিক সুরক্ষার ক্রমিক অবনমন তার একটা খণ্ডচিত্র। কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এই সামাজিক সুরক্ষার দর্শনকে ভারতের রাজনীতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারবে, আগামী দিনে সেটাই ক্রমে স্পষ্ট হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy