গুগলের ধ্বংসের এমন আভাস শুনে তোলপাড় শুরু হল বিশ্বে। প্রতীকী ছবি।
তাঁর নাম হয়তো তেমন পরিচিত নয় আমজনতার কাছে। তবে তাঁর নির্মিত প্রযুক্তি-পণ্য গোটা বিশ্বের নিত্যদিনের সঙ্গী। গুগল মেল তথা জিমেলের নির্মাতা সেই পল বুহের মুখেই শোনা গেল গুগলের ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী। ২ ডিসেম্বর বুহে টুইট করলেন, “বড়জোর এক থেকে দু’বছর। তার পরই গুগল পুরোপুরি ঘেঁটে যাবে। যে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথ্য দিয়ে গুগল সবচেয়ে বেশি আয় করে, তাকে ধ্বংস করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। গুগল নিজেও যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়, তা হলেও তাকে নিজের ব্যবসার সবচেয়ে লাভজনক অংশটাকে নষ্ট করতে হবে।”
গুগল-এ একেবারে গোড়ার দিকের কর্মী বুহে। স্বভাবতই তাঁর মুখে গুগলের ধ্বংসের এমন আভাস শুনে তোলপাড় শুরু হল বিশ্বে। যে প্রযুক্তির দাপট দেখে বুহে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, সেই সংস্থা খুব অল্প দিনে আলোড়ন ফেলেছে ই-দুনিয়ায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলে বলীয়ান ওই সফটওয়্যারের নাম ‘চ্যাট জিপিটি’। প্রযুক্তি-সংস্থা ‘ওপেন এআই’ ওই সফটওয়্যারটি প্রকাশ করে নভেম্বরের শেষে। তার পরে ঝড়ের বেগে তা জনপ্রিয় হয়েছে বিশ্ব জুড়ে।
একটা হিসাব দিলে চ্যাট জিপিটি-র জনপ্রিয়তার আঁচ মিলবে। প্রকাশের পাঁচ দিনের মধ্যে ১০ লক্ষ মানুষ চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করা শুরু করেন। ওই সংখ্যক ব্যবহারকারী পেতে ইনস্টাগ্রামের লেগেছিল আড়াই মাস, ফেসবুকের দশ মাস। কিসের টানে চ্যাট জিপিটির জন্য ছুটছে ই-জনতা? কোন শক্তিতেই বা এই সদ্যোজাত প্রযুক্তি-পণ্য গুগলকেও মুছে ফেলার ইঙ্গিত দিচ্ছে?
উত্তর হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই প্রযুক্তির জোরেই চ্যাট জিপিটির সঙ্গে একটা মূলগত ফারাক হচ্ছে গুগলের। গুগলে কোনও বিষয় সম্বন্ধে ‘সার্চ’ করলে সেই সম্পর্কিত একাধিক ওয়েবসাইটের ঠিকানা সে হাজির করে। কোন কোন সাইটের নাম গুগল দেখাবে, তা ঠিক হয় ওই সমস্ত সাইটের গুগলকে দেওয়া অর্থ থেকে। সেটাই গুগলের আয়ের প্রধান উৎস। যিনি সার্চ করছেন, তিনি গুগলের এক বা একাধিক ওয়েবপেজ বা পাতা উল্টেপাল্টে, সেই সব পাতায় থাকা একাধিক ওয়েব ঠিকানায় গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে এই জায়গাতেই গুগল বা অন্য যে কোনও সার্চ ইঞ্জিনকে টেক্কা দিতে চাইছে চ্যাট জিপিটি। সেখানে কোনও প্রশ্ন করলে কোনও ওয়েবসাইটের ঠিকানা নয়, একেবারে হাতেগরম উত্তর নিয়ে হাজির হচ্ছে সে। আপাতদৃষ্টিতে চ্যাট জিপিটির দেওয়া সেই উত্তর এতটাই নিখুঁত যে, তা কোনও বিশেষজ্ঞের লেখা বলে বিশ্বাস হতে বাধ্য।
দৈনন্দিন আটপৌরে প্রশ্ন থেকে তত্ত্ব বা দর্শন, সমাজ-রাজনীতি থেকে কবিতা— সব কিছু নিয়েই প্রশ্নের বিশদে উত্তর দিচ্ছে এই ই-নবজাতক। সেই উত্তর এতটাই তথ্যসমৃদ্ধ যে, গুগল ঘেঁটে নানা ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে লিখলেও তা হওয়া কঠিন। যেমন, দিনে ভিটামিন ডি-র ডোজ় সবচেয়ে বেশি কত হতে পারে, তা জিজ্ঞাসা করলে গুগল যেখানে একাধিক ওয়েবসাইটের ঠিকানা এনে হাজির করত, সেখানে চ্যাট জিপিটি তা নিয়ে পরিপাটি প্রবন্ধ লিখে দিচ্ছে। টুইটারে একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি বলে সেই সম্বন্ধে জাপানি কবিতা হাইকু লিখতে বললে তাও লিখে ফেলছে চ্যাট জিপিটি!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন নিখুঁত হয়ে ওঠাই গুগলের চিন্তার কারণ। গুগল এসে তার পূর্বসূরি ইয়েলো পেজেস-এর যা হাল করেছিল, সেই অবস্থাই গুগলের হবে বলে আঁচ করছেন তাঁরা। মানুষ খোঁজার সময়টুকু না ব্যয় করে সাজানো গোছানো বিশদ তথ্য পেতে গুগল ভুলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকেই ঝুঁকবেন বলে তাঁদের মত।
চ্যাট জিপিটির এই শক্তিতেই লুকিয়ে রয়েছে বিপদের বীজ। কারণ, তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে তথ্য বা জবাব এনে হাজির করছে, সেই বুদ্ধিমত্তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার পক্ষপাতের দোষ। যাঁরা সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোপণ করেছেন যন্ত্রে, তাঁদের মনে থাকা পক্ষপাত, আসক্তি-অনাসক্তি সবই চলে যাচ্ছে যন্ত্রের মগজে। তাই টুইটারে একাধিক প্রশ্ন করে দেখা গিয়েছে, চ্যাট জিপিটির উত্তরে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মনে থাকা শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্যের মনোভাব স্পষ্ট। লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ নিয়ে যন্ত্রের মগজে রয়েছে বিভাজনমূলক ধারণা। একটি প্রশ্নের উত্তরে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বার্থপরদের ‘পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা’র কথা বলেছে। তাই আইন, বিচার, নৈতিকতা এ সব সম্বন্ধেও তার মনোভাব গা-জোয়ারি শোনাচ্ছে অনেক সময়েই।
দুনিয়া এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গ্রাসে চলে গেলে আরও একটি বিপদ— সাইবার সুরক্ষার ক্ষেত্রে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে সাইবার অপরাধীদের কাজকর্ম, যেমন নকল ইমেল লিখে টোপ দেওয়া এতটাই নিখুঁত হয়ে যেতে পারে, যা চেনা দুরূহ হয়ে পড়বে। গুগলের প্রধান সংস্থা অ্যালফাবেট-এর সিইও সুন্দর পিচাই ও জেফ ডিনও সম্প্রতি কর্মীদের নিয়ে একটি বৈঠকে চ্যাট জিপিটির এই সীমাবদ্ধতার কথা বলে গুগলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। ওপেন এআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান স্বয়ং গত ১১ ডিসেম্বর টুইট করেছেন, “এখনই চ্যাট জিপিটি-র উপর যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্ভর করা মারাত্মক ভুল। এর সীমাবদ্ধতা না জেনে মহান ভাবাটা মারাত্মক ভুল হবে। নির্ভরযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠতে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।”
সবচেয়ে বড় কথা, ভালমন্দ ঘেঁটে, জেনে বুঝে নিজের ভালটা বুঝে বেছে নেওয়াই পরিণত হওয়ার একটা প্রধান ধাপ। কেবল গুগলে তথ্য খোঁজা নয়, নিজের যাপনেও এই অভ্যাসই আমাদের জীবনকে চিনতে, জানতে, বুঝতে শেখায়। তার বদলে কেবল একপাক্ষিক একটা সাজানো-গোছানো পথ পেলে, কেবল সেই পথেই অন্ধের মতো কি আমরা মানুষ হিসেবেই আরও গণ্ডিবদ্ধ, কূপমণ্ডূক হয়ে পড়ব না? রবার্ট ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকেন’ কবিতার সেই কম চলা পথে চলে, বেছে নেওয়ার আনন্দেই জীবনের পূর্ণতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপজ্জনক পারিপাট্যে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy