রাহুল গান্ধী ও অন্যান্য নেতারা। —ফাইল চিত্র।
সব মিলিয়ে এ দেশে গণতন্ত্রের যতটুকু অগ্রগতি আজ পর্যন্ত হয়েছে তাকে নস্যাৎ বা অস্বীকার করে রাজনীতিতে এগোনোর চিন্তাটা আর বাস্তবসম্মত হতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই চিন্তা চর্চা অনুশীলন দর্শনে সংশ্লেষ এবং বহুত্ববাদের অনুগামী এই দেশ কিছুতেই তার উপর চাপিয়ে দেওয়া একমুখিতাকে মেনে নিতে রাজি হয় না। তেমন চেষ্টা করা হলেও তাকে প্রতিহত করা হয়েছে। যে যুগে ধর্ম সমাজজীবনে রাজনীতির থেকেও বড় নিয়ন্ত্রক ছিল, সেই যুগেও ধর্মের কোনও এককেন্দ্রিক রূপ ভারতভূমিতে গড়ে ওঠেনি। এ দেশের বহমান ধারাটাই হচ্ছে মত-জিজ্ঞাসা-সংশ্লেষ-তর্ক-বিতর্ক-আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে চলা। এই ইতিহাসের থেকে শিক্ষা নেওয়াটা বোধ হয় এ দেশের রাজনীতির পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে আবশ্যিক ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা। সঙ্কীর্ণ জবরদস্তি যে দীর্ঘ দিন সাফল্য পেতে পারে না, সে অভিজ্ঞতা কম-বেশি সব রাজনৈতিক দলেরই আছে।
মহারাষ্ট্রে অজিত পওয়ার দল ভেঙে বিজেপিতে যোগ দিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী পদ আলো করে বসায় মহাজোটের ভবিষ্যৎ কতখানি নড়বড়ে হল, সে প্রশ্নে আপাতত ঢোকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঘটনা হল, লোকসভা নির্বাচনের কৌশল স্থির করার জন্য বিরোধী দলগুলির নেতাদের পটনায় একত্র হওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নীতীশ কুমার, তেজস্বী যাদবদের ধন্যবাদ, এই প্রয়োজনীয় আলোচনার উদ্যোগ করার জন্য। আজকের সময়ে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মতাদর্শগত ভিত্তি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যা দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো অন্ধবিশ্বাস আর যুক্তিহীনতাকে পাথেয় করে। সামাজিক-রাজনৈতিক স্তরের নানান বন্ধন একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রগতিশীল ভাবনার সীমা নির্ধারণ করে দেয় যাকে সংজ্ঞায়িত করা না গেলেও অনুধাবন করতে পারাটাই কোনও একটি বিশেষ সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা। যে বিরোধী নেতৃত্ব আলোচনার মাধ্যমে সহমতে পৌঁছতে চাইছেন তাঁরা এই সাধারণ বোঝাপড়াটা নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারবেন এটাই প্রত্যাশিত। যদি ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের যাবতীয় কুফলের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, তা হলে সামন্তবাদের সমস্ত অবশেষকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। কিন্তু আলোচনায় বসা সব দলকে এ বিষয়ে একমত করা যাবে এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন।
আবার উল্টো দিকে এটাও সত্য যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির এই যুগে হিন্দুরাষ্ট্রের নামে মধ্যযুগীয় অন্ধকারকে যারা ফিরিয়ে আনতে চাইছে, যাদের আক্রমণের তালিকায় গান্ধী-নেহরু-রবীন্দ্রনাথ-ইকবাল-আম্বেডকর-মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ সবাই, তাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তোলাটাই এ সময়ের জরুরি কাজ। এই জন্যই প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার লড়াইয়ে গণতন্ত্রের প্রশ্ন আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবলম্বন করছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই মূল প্রশ্ন মাথায় রেখে বলেছেন, “আমাদের দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এই দেশের চিরন্তন আদর্শকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের নিতেই হবে।” বলেছেন, “যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ভারত গঠিত হয়েছিল, সেই সংস্কৃতির ভিত্তিমূল আজ আরএসএস-এর হাতে আক্রান্ত।” সীতারাম ইয়েচুরির কথায় উঠে এসেছে আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোটাকেই পাল্টে দেওয়ার বিজেপির উদ্যোগের কথা। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে যৌথ সাধারণ কর্মসূচি গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন। বৈঠক তখনকার মতো ইতিবাচক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও। যদিও বৈঠকে থাকলেও সাংবাদিক সম্মেলনে ছিলেন না পঞ্জাব এবং দিল্লির আপ মুখ্যমন্ত্রীরা। আর আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় থেকেছেন। সিবিআই, ইডি কোর্টের বাইরে খুব একটা বেরোননি।
এই ঐক্য শেষ পর্যন্ত বিজেপি-বিরোধী সার্বিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট গড়ে তুলতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নকে বাঁচিয়ে রেখেও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে চান ভারতীয় সংবিধানের প্রতি অনুরক্ত সমস্ত ভারতবাসী। কারণ, দেশবাসীর কাছে এটা স্পষ্ট যে এই শাসন আমাদের সাংবিধানিক ঐতিহ্যের পক্ষে বিপর্যয়কর।
আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এক সময় বলেছিলেন, যদি এক জনও মুসলমান এ দেশে না থাকত তা হলেও এ দেশ ধর্মনিরপেক্ষ হত। কারণ বিংশ শতাব্দীতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে আধুনিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে প্রগতিশীলতা। এই প্রগতিশীলতার পথে হাঁটা ভারতে মর্তের মানুষ বাবরের ভিটেয় মৌলপ্রেমে জেগে উঠছে স্বর্গের রামের মন্দির আর তার নির্মাণযজ্ঞে অর্থ নয়ছয়ের বিবাদে হাতাহাতিতে জড়াচ্ছেন সর্বত্যাগী সাধুরা। এই মহান দেশচেতনার স্বরলিপিতে লুকিয়ে থাকা বহুত্ববাদের চিরায়ত গণতন্ত্রের বীজমন্ত্র এক সঙ্গে উচ্চারণ করছে ঘৃণা আর প্রণাম অর্থের দু’টি পরস্পরবিরোধী শব্দ। গণতন্ত্র আজ আক্রান্ত সাম্প্রদায়িকতাবাদের হাতে। সমাজচেতনার মাটি থেকে উৎসারিত শোণিতস্রোতে অবগাহনের শেষে আমাদের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কি পরাস্ত হবে?
পটনা একটু হলেও আশার আলো জাগিয়েছে। এক দিন মর্তের মানুষের জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করেছিল প্রমিথিউস। আর এক দিন রাইখস্ট্যাগের আগুন ছাপিয়ে উঠেছিল ডিমিট্রভ-এর কণ্ঠ। প্রতিরোধের দুর্গের প্রাচীর-নির্মাণে এ সবই থাক সভ্যতার বিকাশমান ঝুলিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy