Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Notes

পাঠ্যবইরা কি জাদুঘরে থাকবে

কেবল ছাপানো নোটবইতেও কুলোচ্ছে না। সাতসকালেই খুলে গিয়েছে পাকুড়তলার জ়েরক্স সেন্টার।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২১ ০৬:০১
Share: Save:

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর পিতা ফিরছিলেন হাতে মস্ত বাজারের ব্যাগ নিয়ে। ছেলের পুষ্টি বাড়াতে মাছ-শাক-দুধের প্যাকেটভরা থলি নয়। ব্যাগভর্তি নোটবই। অনলাইন ক্লাসে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি ছেলে। তাই কিনে নিয়েছেন বাজারচলতি নানা নোটবই, বিভিন্ন প্রকাশকের। জেলাশহরের বইয়ের দোকান এখন নোটবইয়ে ঠাসা, দেখাই যায় না পাঠ্যবই।

কেবল ছাপানো নোটবইতেও কুলোচ্ছে না। সাতসকালেই খুলে গিয়েছে পাকুড়তলার জ়েরক্স সেন্টার। মাঘের শেষেও জ়েরক্স করতে করতে ঘামছেন দু’জন। পাশে এক জন চেয়ারে বসে টেবিলে রাবার স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেন নোটসের পাতায় পাতায়— ‘ইজ়ি সাকসেস কোচিং সেন্টার’। যাকে বলে, খাঁটি নকল। প্রাইভেট টিউটরদের লিখে দেওয়া উত্তরের এমন চাহিদা, রাত দেড়টাতেও খুলে রাখতে হয় ফোটোকপির দোকান। দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে বাংলার নোটস ফ্রি মিলছে। অফার সীমিত সময়ের জন্য। তিন বিষয়ের নোটবই মাত্র হাজার টাকায়। খবরের কাগজের সঙ্গে এমন আকর্ষক ছাড়ের লিফলেট বিলি হয়েছে। পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, ভোর চারটে থেকে লম্বা লাইন পড়ছে পাকুড়তলায়।

আর এক সংস্থা মুক্ত বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের আকর্ষক ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে। পোস্টারে মুড়ে ফেলা হয়েছে শহরের দেওয়াল। দশ হাজারে ফার্স্ট ডিভিশন, সাত হাজারে সেকেন্ড ডিভিশন, আর শুধু পাশের সার্টিফিকেট পেতে চাই মাত্র পাঁচ হাজার! এক কর্মকর্তা জানালেন, প্যাকেজে রয়েছে ‘স্টাডি মেটেরিয়ালস’-এর নোট, বাসভাড়া, হোটেলে থাকাখাওয়া, খাতাকলম, পরীক্ষার হলভাড়া-সহ সব খরচ। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন পরীক্ষা দিতে আসছেন বলেই নাকি এর নাম দূরশিক্ষা! “দেখবেন, মিনি গঙ্গাসাগর!”

এ কি শিক্ষাব্যবস্থার গঙ্গাপ্রাপ্তি? পরীক্ষার দিন দেখা গেল, বিয়েবাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। বিরাট হলঘরের মাইকে প্রশ্নের উত্তরগুলো অঞ্জলির মন্ত্রের মতো সুর করে করে এক জন পড়ছেন। আর সকলে খাতায় লিখছেন। বেলা বাড়ে। পৃষ্ঠা ভরে ওঠে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের। দেখে মনে হয়, পরীক্ষার্থীদের বয়স ৩০-৪০ বছরের মধ্যে। ভোট আসছে। কখন কী নিয়োগের ঢল নামে! তাই পাশটা করে রাখছেন সকলে। মানে, সার্টিফিকেটটা কিনে রাখছেন। গণশ্রুতিলিখন পালার মধ্যেও দু’-চার জন শুনেও কিচ্ছুটি লিখতে পারলেন না। পরে তাঁদের ‘স্পেশ্যাল প্যাকেজ’-এ এনে কোয়ালিফাই করানোর বন্দোবস্ত রয়েছে, জানালেন কোম্পানির এক জন।

শিক্ষা তো নয়, যেন ইনস্ট্যান্ট নুডলস। অনেক স্কুলও বুকলিস্টে বড় বড় করে সব পাঠ্যবইয়ের পাশে সহায়িকা বইয়ের নাম ছেপে দেয়। একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন এলেই ‘সিলেবাসের বাইরে’ বলে ছাত্রদের বিক্ষোভ, পরীক্ষা ভন্ডুল। ‘পাশে আছি’ বলে ছুটে আসে বিখ্যাত ছাত্র সংগঠন। টেস্টে ফেল করলে হেডস্য‍রের ঘর ঘেরাও, দেদার ভাঙচুর, লোকাল পার্টির শাসানি। এ সবের ফলেই আজ পাঠ্যবই দশ আনার মতো অচল। অনেক ছাত্র তো শুধু একটা ডায়েরি নিয়েই স্কুলে আসে-যায়। স্কুলব্যাগও অনাত্মীয়। এক পুস্তক ব্যবসায়ী জানালেন, “অনার্সের ছাত্ররা বাধ্য হয়ে সামান্য কিছু টেক্সট বই কিনলেও, নিচু ক্লাসের ছাত্ররা ছাত্রবন্ধু, ছাত্রসাথীর মতো নোটসর্বস্ব এক থান ইট কিনছে। এদের বাড়িতে তল্লাশি করলেও পাঠ্যবই মিলবে না একখানাও।”

বিদ্যার দালানবাড়ির ভিত শুরুতেই নড়ে গিয়েছে। শিক্ষানীতি মানে নোট গেলানোর নীতি। ছাত্রদের কল্পনাশক্তি, নিজস্ব লিখনশৈলীকে অথর্ব করে দিচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের উত্তরপত্রগুলো কপি-পেস্টের খাতায় পরিণত। গরুর রচনা লিখতেও আজ স্যরের সাহায্য চাইছে ছাত্ররা।

নোটবইগুলোতে কোনও অভিনবত্ব না থাকায়, স্বাভাবিক ভাবেই নম্বরের ব্যবধান কমছে। সব নোট এসে মিলে গেল শেষে...। এক দিন ক্লাসের দু’শো জনের প্রত্যেকেই মাধ্যমিকে বাংলায় বিরাশি পেলেও অবাক লাগবে না। যেমন বাংলা, ইংরেজিতে এখন একশোয় একশো পেলে কেউ অবাক হয় না। সব শেষে পড়ে থাকে এক বর্ণহীন মার্কশিট। স্কুলের লাইব্রেরিগুলোও চটকলের মতো ধুঁকছে। বছর বছর সরকারি টাকায় বই কেনা হলেও, সে পথ মাড়ায় না কোনও ছাত্র। ধুলো জমছে বইয়ে, আর সেই সঙ্গে ছাত্রদের মনেও। পঁচিশে বৈশাখে অনুষ্ঠানের ধুম বাড়ছে, কিন্তু “বিদ্যা বাহির হইতেই কেবল জমা করিলাম, ভিতর হইতে কিছু তো দিলাম না।”— রবীন্দ্রনাথের কথাগুলোই সকলে ভুলে বসে রয়েছে।

মনের ভিতরের কথা প্রকাশের উপায় রাখেনি পরীক্ষাব্যবস্থাও। বাংলা, যা অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর প্রিয় বিষয়, সেখানেও সে সুযোগ নেই। “এখন কোনও ক্লাসের পরীক্ষাতেই এমন উত্তর লেখা হয় না, যাতে একটা এ-ফোর পৃষ্ঠা পুরো ভরে উঠতে পারে। সব দু’লাইন, চার লাইন। যেন আধুনিক কবিতাসমগ্র।” বললেন এক বাংলা শিক্ষক।

দেখেশুনে মনে হয়, আর কিছু দিন। তার পরেই পাঠ্যবইদের স্থান হবে জাদুঘরে। মিশরের মমির পাশে শুয়ে থাকবে নব গণিত মুকুল, সহজ পাঠ। মেধার মন্বন্তরে বেঁচে থাকব আমরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Notes Text Books
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy