Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Society

সংসার সামলে রোজগার

পশ্চিমি এবং উন্নত দেশগুলিতে সরকারি মধ্যস্থতায়, নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে, কর্মক্ষেত্রে নানান কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এই অবস্থার বেশ খানিকটা পরিবর্তন করা গেছে।

work.

—প্রতীকী ছবি।

প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ ০৬:২৯
Share: Save:

ধরো, তোমায় তিনটি বিকল্প দেওয়া হল। এক, বড় হয়ে তুমি সংসার বা ঘরকন্নার কাজকেই প্রাধান্য দেবে। দুই, পেশা বা কর্মজীবনই তোমার প্রধান লক্ষ্য হবে। আর তিন, তুমি সংসার সামলে, তার পর পেশাগত কাজকে প্রাধান্য দেবে। কোনটি বেছে নেবে তুমি?”

প্রশ্নটা যাদের উদ্দেশে, তারা কলকাতা থেকে অনতিদূরে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। উত্তর জানার জন্য ছাত্রীদের হাত তুলতে বলা হল। নব্বই শতাংশ হাতই উঠল তৃতীয় বিকল্পের পক্ষে। আরও বেশ কয়েকটি স্কুলে সমীক্ষা চালিয়ে মোটের উপর বোঝা গেল— বেশির ভাগ মেয়েই মনে করছে, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জন করার লক্ষ্যে মেয়েদের চাকরি করা প্রয়োজন। কিন্তু সংসার সামলানো এবং শিশুর প্রতিপালনও যে-হেতু ‘মেয়েদেরই কাজ’, তাই সে সব সামলে উদ্বৃত্ত সময়ে যদি কিছু রোজগার করা যায়, তবেই তা করব, নয়তো নয়।

কথাটা বিশ্ব জুড়েই সত্যি। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন বলছে, এখনও অবধি পৃথিবীর কোনও দেশেই বেতনহীন শ্রমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতের দিকে তাকালে দেখি, গড়পড়তা একানব্বই শতাংশ বেতনহীন কাজই করছে মেয়েরা। এই প্রবল অসাম্য প্রমাণ করে, ঘরের কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব মেয়েদের, এই কথা ভারতের জন্যে অনেকটা বেশি সত্যি। প্রায় পাঁচ লক্ষ ভারতীয়ের উপর করা জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, প্রতি দশ জনে মাত্র এক জন পুরুষ ঘরের কাজে হাত লাগায়। সিংহভাগ ঘরের কাজ সামলে বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারে যোগ দেওয়া এবং তাতে টিকে থাকা যে সহজ নয়, সে সারসত্য এই প্রজন্ম দ্রুত বুঝে গেছে। শুরুতে যে সমীক্ষার প্রশ্নের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তাতেও এই সত্য উপলব্ধিরই প্রতিফলন। ঘরের কাজের অপরিসীম গুরুত্ব নিয়ে বহু আলোচনা হলেও অর্থনৈতিক আঙ্গিকে তার দাম বা মূল্য-নির্ধারণ করার কোনও পন্থা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ফলে বাস্তবে তা মূল্যহীন হয়েই রয়ে যায়। আর সংসারে যে জিনিস মূল্যহীন, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সহস্রাব্দ পুরনো এই মানবসভ্যতা ‘মূল্যহীন’ গৃহকর্মকে ও তা প্রদানকারী ব্যক্তিকে উপার্জনকারীর সমান মূল্যবান ভাববে, তা হয় না।

কারণ, সমাজ-সংসার ঐকিক নিয়মে চলে না। তাই তোমার আয় না থাকলেও সংসার যে-হেতু তোমার আমার দু’জনেরই এবং তার লক্ষ্য যে-হেতু অভিন্ন, অতএব ‘আইস সকলে মিলিয়াই সকল ভাগ করিয়া খাই’— বাস্তব জীবনে এমন মানসিকতা দুর্লভ। তাই নিরন্তর সংঘর্ষ চলতে থাকে। তারই মাঝে সংসারের চাকা গড়াতে থাকে ‘ইন্ট্রা-হাউসহোল্ড বার্গেনিং’ মডেলে। ফলে সংসারের যে মানুষটির কাজ দৃশ্যমান ও অর্থ-উপার্জনকারক, তার গুরুত্ব, প্রাধান্য ও মতামত প্রতিষ্ঠিত হয়। আর অপর জন তার ‘মূল্যহীন’ অদৃশ্য কাজকে দৃশ্যমান ও মূল্যবান করে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর আরও পরিশ্রম করতে চায়। বাচ্চার স্কুলের টিফিনে দু’টির বদলে পাঁচটি সুদৃশ্য খাবার দিয়ে সান্ত্বনা পায় এই ভেবে যে, চাকরি করলে বাচ্চার এমন যত্ন করত কে?

পশ্চিমি এবং উন্নত দেশগুলিতে সরকারি মধ্যস্থতায়, নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে, কর্মক্ষেত্রে নানান কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এই অবস্থার বেশ খানিকটা পরিবর্তন করা গেছে। সিঙ্গাপুর নাকি অফিসের কর্মীদের সর্বদা উৎসাহ দেয় টিফিন বাড়ি থেকে না এনে বাইরের দোকান থেকে কিনে খেতে। কারণ দু’টি। এক, মেয়েদের ঘরের কাজ কমিয়ে ফেলা, যাতে তারা আরও বেশি করে পেশাগত কাজে যুক্ত হতে পারে। দুই, স্থানীয় হোটেল, হকার ও খাবারের দোকানগুলির বিক্রি বাড়িয়ে তাদের আয় তথা দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের হিসাবে সিঙ্গাপুরের তেষট্টি শতাংশ মহিলাই কর্মরত, ভারতের তুলনায় তেতাল্লিশ শতাংশ-বিন্দু বেশি!

সত্য যে, ভারতে দারিদ্র, অশিক্ষা, সম্পদ ও আয়ে অতিবৈষম্য, বিবিধ খাদ্যরুচি, সাংস্কৃতিক ফারাক; সব মিলিয়েই উপরোক্ত মডেলটিকে কার্যকর করে তোলা মুশকিল। কিন্তু বেশ কিছু পন্থার দিশা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা দিয়েছে। যেমন— বেতনহীন ঘরোয়া শ্রমে লিঙ্গসাম্য স্থাপনের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ যে দাওয়াই দিয়েছিল, তার নাম ‘ট্রিপল আর অ্যাপ্রোচ’। প্রথমে ঘরোয়া কাজগুলিকে খুঁজে বার করো (রেকগনিশন), তার পর কী ভাবে সেগুলিকে আরও সহজে, আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বা ‘আউটসোর্স’ করে সংক্ষিপ্ত করা যায় (রিডাকশন) তা ঠিক করো। এবং শেষ ধাপে এই সঙ্কুচিত কাজকে পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী লিঙ্গনির্বিশেষে সকলের মধ্যে ভাগ করে নাও (রিডিস্ট্রিবিউশন)।

এই পথে কাজের লিঙ্গভিত্তিক মেরুকরণ দূর করা সম্ভব। পাশাপাশি, উনিশ শতক থেকে মেয়েদের কাজের বাজারে যোগদানের জনপ্রিয় শব্দবন্ধ ‘ঘরে-বাইরে’ যা মেয়েদের একা হাতে সম্পূর্ণ ঘরের কাজ সামলে বাইরের কাজে যোগদানের অসম্ভব আইডিয়ার প্রস্তাবনা দেয়, তাও দূরে সরিয়ে, অর্থকরী ও বেতনহীন উভয় কাজেই লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

অন্য বিষয়গুলি:

Society Work gender equality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE