Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Senior Citizens

বয়স বাড়ার দেশে কয়েকটি প্রশ্ন

২০২১ সালে কলকাতার উচ্চ আদালত মত প্রকাশ করেছিল যে, প্রবীণ এবং অসুস্থ নাগরিকের যত্ন নিতে না-পারা দেশ আসলে ‘অসভ্য’।

A Photograph of an Old Woman

বয়স বাড়লে বৃদ্ধার জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ফাইল ছবি।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৬
Share: Save:

সম্প্রতি খবরে দেখলাম, অশীতিপর মা’কে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গঙ্গা পেরিয়ে ভাটপাড়ায় এক স্কুলের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিল তাঁর দুই ছেলে। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করেন দু’রাত কেটে যাওয়ার পর। সন্তানরা যুক্তি সাজায়, তাদের মায়ের মাথার ঠিক নেই। কথা শোনেন না। অর্থাৎ, কথা না শোনা আশি পেরোনো মা’কে এই ভাবে ঝেড়ে ফেলা চলে। সংবাদটি প্রথম পাতায় জায়গা পায়নি, দেশে এখন উল্লেখযোগ্য ঘটনার ঘনঘটা। তবু অতীতের পাতা একটু ওল্টাতেই দেখা গেল, বৃদ্ধ মা-বাবাকে এই ভাবে ছেড়ে এসে ‘দায়মুক্ত’ হওয়ার দৃষ্টান্তকে একেবারেই অগ্রাহ্য করা চলে না। ধারাবাহিক ভাবে এমন কাজ ‘আধুনিক সন্তান’রা করে আসছে। গত বছর এই রাজ্যেই আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার নাম করে মা’কে হাবড়া স্টেশনে ফেলে গিয়েছিল ছেলে। তার মাস দুয়েক আগে তেলঙ্গানায় নব্বই-ঊর্ধ্ব মা-বাবাকে রাস্তায় বার করে দিয়ে চলে যায় ছেলেরা। নিজেদের জমিবাড়ি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে একচালায় আশ্রয় নিয়েও তাঁরা রক্ষা পাননি। খোলা আকাশের নীচে ঠাঁই হয়েছিল। ২০২০ সালে এই তেলঙ্গানায় অসুস্থ এক বাবার শেষ সম্বল চল্লিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে সন্তানরা তাঁকে পথে ফেলে আসে। তার কয়েক বছর আগে দিল্লিতে ঘটে আর এক নাটকীয় ঘটনা। বৃদ্ধা মা’কে আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাবে বলে ছেলে গাড়িতে তোলে, দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁকে বলে ফল কিনে আনতে। মা গাড়ি থেকে নেমে পিছন ফিরে দেখেন ছেলের গাড়ি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন এই ভেবে যে, ছেলে সম্ভবত তেল ভরতে বা অন্য কোনও কারণে গিয়েছে। এল বলে। ছেলে কিন্তু আসে না। বৃদ্ধার জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে।

ভারতে অনেক দিন জনগণনা হয় না। কিছু কাল আগের হিসাব বলেছিল, এ দেশের বয়স্কদের পঁচাত্তর শতাংশের কোনও না কোনও ক্রনিক অসুস্থতা রয়েছে। কুড়ি শতাংশ মানসিক ভাবে সুস্থ নন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হল, ভারতের বৃদ্ধদের অন্তত চল্লিশ শতাংশের শরীরে কমপক্ষে একটি করে আঘাতের চিহ্ন আছে। কে করল এই আঘাত? যদি সন্তানসন্ততি করে থাকে, খবর মেলা মুশকিল। আহত ব্যক্তি স্নেহের পাশে আবদ্ধ হয়ে নিজেই বাঁচিয়ে চলবেন আক্রমণকারীকে; অন্তত যত ক্ষণ বেঁচে থাকবেন। আর যদি অন্য কোনও ভাবে এই আঘাত লেগে থাকে, তা হলে অযত্ন এবং উদাসীনতার যুক্তি হালে বেশ ভাল ভাবেই পানি পাবে। কারণ, এ দেশের পঁয়ষট্টি শতাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একাকিত্বের শিকার। তাঁদের উপর নির্যাতন, অবহেলা, অপমানের অভিযোগও আমাদের গা-সহা হয়ে গিয়েছে। তাই বলে তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে পরিত্যক্ত পানীয়ের বোতলের মতো পথঘাট, স্টেশনে ফেলে আসার ঘটনাগুলি এই আধুনিক উদরেও পুরোপুরি হজম হয় না। গৃহপালিত পশুপ্রাণীর চেয়েও গৃহপালিত বৃদ্ধের কপাল অধিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুনদের পরিস্থিতি বাস্তব জীবনে এমনই অসহনীয়। তবু মৃত্যুর আগে তিনি একটি ক্ষীণ আত্মীয় আবহ পেয়েছিলেন। অধিকাংশই পান না। বৃদ্ধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই মুহূর্তে সেই সংখ্যা চোদ্দো কোটির কাছাকাছি। ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রতি পাঁচ জন নাগরিকের এক জন ষাটোর্ধ্ব হয়ে বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলবেন। কিন্তু ভারত কি তাঁদের ‘দেশ’ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে? না কি তার যাত্রা ঠিক উল্টো পথে? কিছু ভাতা, ব্যাঙ্কের ইন্টারেস্ট রেট ইত্যাদির ঐকিক নিয়ম দিয়ে সবটা হয় না, দরকার মানসিক সাহচর্য, পরিবেশগত এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত সহায়তা। এরও জন্য অর্থের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। এই আর্থিক স্বাবলম্বন ক’জন বয়স্কের আছে? গ্রাম-শহর মিলিয়ে হিসাব করলে মহিলাদের শতকরা পনেরো ভাগেরও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নেই। আর যদি থেকেও থাকে, শিক্ষা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার অভাবে সেটুকুও তাঁরা সহজেই খোয়ান ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতায় অথবা অপত্য স্নেহের অল্প দামে।

একাকিত্ব বা সামাজিক নির্বাসন থেকে বাঁচার চেষ্টা পরের কথা, শুধুমাত্র নিজের ভিটেমাটি আঁকড়ে থাকতে হলে বয়স্কদের জানতে হবে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে। যদিও এ দেশের সংবিধানের একুশ নম্বর ধারা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তার বিধান দিয়েছে কিন্তু বাস্তবের প্রতিকূলতা এমন শক্তিমান যে সংবিধানের বিধান বিপন্ন হয়ে পড়ে। ভারতে যে প্রায় দু’কোটি বৃদ্ধের মাথার উপর আক্ষরিক অর্থেই ছাদ নেই, তাঁরা ক’জন আইন-আদালতের সহায়তা নিতে পারেন?

২০২১ সালে কলকাতার উচ্চ আদালত মত প্রকাশ করেছিল যে, প্রবীণ এবং অসুস্থ নাগরিকের যত্ন নিতে না-পারা দেশ আসলে ‘অসভ্য’। বাড়ির বৃদ্ধ মালিক দরকার হলে সন্তানকে সপরিবার উচ্ছেদ করতে পারেন কারণ তারা থাকার ‘অনুমতি প্রাপ্ত’। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা এই রায় দেওয়ার সময় দিল্লি, পঞ্জাব ও হরিয়ানার উচ্চ আদালতের উদাহরণ টেনেছিলেন। বয়স্ক ব্যক্তি সঠিক ভাবে দেখাশোনার অঙ্গীকারের বদলে কাউকে সম্পত্তি দান করলেও যদি সেই শর্ত যথার্থ ভাবে পূরণ না হলে আদালতে যেতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবে কি এক জন সাধারণ অসহায় বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা এই আইনগত অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? এর প্রয়োগ কি অশক্ত শরীর বা মনের দ্বারা সম্ভব? এমন ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য খানকতক এনজিও ছাড়া আর কে আছে? স্থানীয় থানা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কিন্তু মা-বাবা সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার সুযোগ কতখানিই বা পান?

একটি প্রশ্ন। আমাদের দেশে বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই পাঁচ বছরের শিশুর ‘ড্রয়িং পরীক্ষা’র জন্য অথবা সতেরো বছর এগারো মাসের শিশুর পায়ে ব্যথার জন্য কর্মরত মা ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ নিতে পারেন। কিন্তু তাঁর আশি বছরের মা অথবা নব্বই বছরের বাবার বাইপাস সার্জারির জন্য একটি ছুটিও বরাদ্দ আছে? যদি সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায় রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয়, তা হলে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায় নিয়ে জোরালো প্রশ্ন ওঠে না কেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Senior Citizens Older Persons old age home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE