পরম্পরা রক্ষার নামে ইতিহাসের বিকৃতিসাধন। প্রতীকী ছবি।
বিখ্যাত আধুনিক গবেষকরা তাঁদের তথাকথিত ‘অ-রক্ষণশীল’ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আজ গণচিৎকারের শিকার হচ্ছেন। যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে তা হল, জনতার প্রবল চাপে পড়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ... প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের বিরুদ্ধে চালিত হচ্ছে। বৌদ্ধিক স্বাধীনতা বিপন্ন হচ্ছে ও সরকারি পদক্ষেপ (কার্যত) আগুনে হাওয়া দিচ্ছে।”
উপরের উদ্ধৃতিটি জরুরি অবস্থা-উত্তর জনতা সরকারের আমলে প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদদের লেখা। বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যবইগুলির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক সুশোভন সরকার একটি দৈনিকে ‘ক্রুসেড এগেনস্ট মডার্ন হিস্টোরিয়ানস’ শিরোনামের নিবন্ধে এই মন্তব্য করেছিলেন। সে দিনও ধর্মান্ধ শক্তির মূল আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ইতিহাসের বস্তুবাদী আখ্যান, আজও তাই, পরম্পরা রক্ষার নামে ইতিহাসের বিকৃতিসাধন।
সম্প্রতি এনসিইআরটি-র দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে ‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস: দ্য মুঘল কোর্টস (সি. সিক্সটিনথ-সেভেনটিনথ সেঞ্চুরিজ়)’ শীর্ষক ৩১ পৃষ্ঠার একটি অধ্যায় বাদ পড়়ল, ছাঁটা হল অন্য একাধিক অধ্যায়ের পাঠও। এর মূল সুর অবশ্য আগেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ২০০৫ সালের ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক অনুসারে লিখিত এবং এনসিইআরটি দ্বারা প্রকাশিত ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের শেষ দিকে শিক্ষা, নারী, শিশু, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ তোলা হয়। তার ভিত্তিতে সংসদের রাজ্যসভার সচিবালয়ের প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশের ইতিহাসের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞের সে বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। ‘পাঠ্যবইগুলির বিষয়বস্তু এবং বিষয়সজ্জার সংস্কার’ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে ইতিহাসের চালু পাঠ্যবইগুলির বিরুদ্ধে তিনটি মূল অভিযোগ ছিল। বলা হয়, এই বইগুলিতে অনৈতিহাসিক তথ্য উপস্থাপন ও জাতীয় বীরদের সম্পর্কে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে, ভারতের ইতিহাসের সব যুগের প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এবং ঐতিহাসিক নারী-চরিত্রগুলি উপেক্ষিত হয়েছে। ২০২১-এর নভেম্বরে রাজ্যসভায় পেশ করা বিশদ প্রতিবেদনে নয়া শিক্ষানীতিকে অনুসরণ করে ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক ‘সংশোধন’ এবং ‘ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরম্পরা’ অনুসারে ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের ‘সংস্কার’ ও ‘পুনর্গঠন’-এর প্রস্তাব পেশ করা হয়। অর্থাৎ, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হতে যাওয়া দ্বাদশ শ্রেণির ‘র্যাশনালাইজ়ড কনটেন্ট’ আচমকা তৈরি হয়নি।
এনসিইআরটি-র সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যে অবশ্য মোগলদের বংশপরিচয়, সামরিক অভিযান, শাসনব্যবস্থা, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সঙ্গে পড়ুয়াদের প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বইটি বারো-তেরো বছরের পড়ুয়াদের জন্য লেখা। কিন্তু, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বইটি সেই সব পড়ুয়ার জন্য, যারা স্বেচ্ছায় ইতিহাস নামক বিষয়টিকে পছন্দ করেছে এবং যাদের মধ্য থেকে আগামী দিনে ইতিহাসপাঠে আগ্রহী কলেজ পড়ুয়ারা আসবে। সুতরাং, বিষয়ের গভীরে গিয়ে পাঠ বিশ্লেষণধর্মী হওয়াই দরকার। উচিত নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে পড়তে ও বুঝতে শেখা।
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে যে অধ্যায়টি বাদ গেছে, তার কেন্দ্রীয় ভাবনা হল, কী ভাবে দরবারি সাহিত্যকর্মে, চিত্রকলায় শাসকের ভাবমূর্তি নির্মিত হয় এবং শাসনকে বৈধতাদান করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে মোগল যুগে বই-নির্মাণ ও দরবারি চিত্রকলার প্রসঙ্গ, রাজধানী শহর ও দরবারের বিবরণ, বাদশাহি অন্দরমহলের ছবি, রাজপুরুষদের খেতাব ও নিয়োগপদ্ধতি, সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ও প্রান্তের যোগ, এবং সমসাময়িক অন্য একাধিক এশীয় শক্তির সঙ্গে মোগলদের সম্পর্কের কথা। একাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে বাদ গেছে ‘সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস’ শীর্ষক অধ্যায়টি, যাতে ছিল মধ্যযুগের পশ্চিম এশিয়ার কথা, যে অঞ্চলটির সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মধ্যযুগে ইসলামের বিস্তার ও প্রভাব এবং সমসাময়িক অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়া যে একটি ঐতিহাসিক সত্য, সেটিকে অনর্থক অস্বীকার করার প্রয়াস করে কি ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরানো যায়?
এনসিইআরটি-র পাঠ্যবইগুলির লেখকরা আধুনিক গবেষণার সঙ্গে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, বিবরণী, লেখতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের মতো নির্ভরযোগ্য প্রাথমিক সূত্রের মিশেল দিয়ে স্কুলপড়ুয়াদের জন্য বই লিখেছিলেন। সমসাময়িক উপাদান থেকে উদ্ধৃতি, প্রামাণ্য মানচিত্র এবং ছবিও পাঠের অন্তর্গত। মোগল চিত্রশালায় (আতেলিয়র) কী ভাবে তসবির আঁকার বিকাশ ঘটেছিল, আবুল ফজ়লের লেখা থেকে তার নজির হাজির করা হয়েছিল। ভাষার জগতে মোগল শাসকরা চাগতাই তুর্কি থেকে সরে এসে ফারসি ভাষায় বিবরণী বা ক্রনিকল লেখার যে ধারার অনুশীলনে উৎসাহ দিয়েছিলেন, তার তুলনীয় সমৃদ্ধ নজির হয়তো ফারসি ভাষার জন্মস্থান ইরানের বাইরে বিশেষ নেই। অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির বাগ্ধারার উপরে ফারসির প্রভাব পড়েছিল। রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ পুরাণ, যোগবাশিষ্ঠ, ভাগবত-এর ফারসি অনুবাদ যে মোগল আমলেই হয়েছিল, কিংবা মোগল ‘মাস্টার’ চিত্রকরদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান, ইরানি ও ভারতীয় শিল্পীরা দুই-ই ছিলেন, এই সত্যই কি ভবিষ্যতের নাগরিকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চান আমাদের আজকের শাসকরা? পাণ্ডুলিপি নির্মাণ ও চিত্রণ, হস্তলিখনশৈলীর ক্রমবিকাশের যুগ ছিল মোগল যুগ। এ যুগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তার পরিসরের মধ্যে থেকেও মুক্তমনা আধ্যাত্মিক প্রশ্ন তোলার দিকটিও তো কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। নানা অসমতা ও দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও বর্ণাঢ্য একটি যুগের সমন্বয়ী দিকগুলিকে অস্বীকার করে মোগল বনাম ‘ভারতীয়’, কিংবা ‘বিদেশি’ বনাম ‘দেশি’ এ রকম একটি একঢালা, বিরোধমূলক আখ্যান নির্মাণের চেষ্টার ফল হবে উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়াদের তুলনামূলক ভাবে এক নিম্নমানের, খণ্ডিত পাঠ্যসূচি পড়তে বাধ্য করা।
প্রায় ছেচল্লিশ বছর আগের নিবন্ধটিতে সুশোভনবাবু প্রশ্ন তুলেছিলেন, আমাদের পরম্পরা কি অবিমিশ্র ভাবে ‘হিন্দু’? তা কি নিছক একটি ক্ষুদ্র প্রাচীনপন্থী জনতার অনড় নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-এর আদর্শ? রবীন্দ্রনাথের ‘মহাভারত’-এর আদর্শ পূরণের সামনে আমাদের এ-হেন পরম্পরাই কি শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়াবে? সত্যদ্রষ্টা ইতিহাসবিদের এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা কি এনসিইআরটি-র ‘যৌক্তিকতা’র চেয়ে আজ আমাদের কাছে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy