Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Slavery

কাজের ফাঁদে কৈশোর

রূপেশের ঠাঁই হয় ডাল লেকের পাশে এক কাপড়ের দোকানে। সকাল ছ’টা থেকে রাত বারোটা অবধি বাসন মাজা, উনুন ধরানো, দোকানের কাপড় গোছানো থেকে শৌচাগার পরিষ্কার, সব করতে হত।

—ফাইল চিত্র।

অভিজ্ঞান সরকার
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৪
Share: Save:

যোগেশচন্দ্র টি-গার্ডেনের রূপেশ সাঁওতাল একাদশ শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই পাশের গ্রামের বন্ধুর সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল। কালচিনির ঠিকাদার বলেছিল, পঞ্জাবের রুটির কারখানায় কাজ করলে মাসে দশ-বারো হাজার টাকা মিলবে। চা বাগানের নানা বস্তি মিলিয়ে জনা দশেক জনজাতিভুক্ত তরুণ ঠিকাদারের সঙ্গে বাসে পৌঁছে যায় বিহার। সেখানে হাতবদল হয়, নতুন ঠিকাদার রূপেশদের দিল্লিতে নিয়ে যায়, আর এক ঠিকাদারের তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দেয় শ্রীনগরে। পঞ্জাবের বদলে কাশ্মীরে পৌঁছনোয় হতভম্ব রূপেশ বাড়িতেও ফোন করেনি, কাশ্মীরে স্থানীয় সিম ছাড়া কিছু চলে না।

রূপেশের ঠাঁই হয় ডাল লেকের পাশে এক কাপড়ের দোকানে। সকাল ছ’টা থেকে রাত বারোটা অবধি বাসন মাজা, উনুন ধরানো, দোকানের কাপড় গোছানো থেকে শৌচাগার পরিষ্কার, সব করতে হত। মাইনে চাওয়ায় মালিক জানায়, রূপেশকে রাখতে ‘কোম্পানি’-কে টাকা দেওয়া হয়েছে, এক বছর মাইনে মিলবে না। রূপেশ আর এক পরিযায়ী শ্রমিকের সাহায্যে এক পাচারবিরোধী এনজিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের পরামর্শ মতো পালিয়ে জম্মু পৌঁছয়, ট্রেন ধরে দু’দিন অনাহারে যাত্রা করে জলপাইগুড়ি আসে।

রূপেশের সহযাত্রীরা প্রায় সকলেই কোনও ভাবে পালিয়ে এসেছে দেড়-দু’মাসের মধ্যে। তবে পাশের বস্তির স্বরূপ তেলির অভিজ্ঞতা ভয়ানক। বাইক কেনার স্বপ্নে মশগুল স্বরূপ এক ঠিকাদারকে ধরে পৌঁছেছিল কাশ্মীরে। একটি রেস্তরাঁয় কাজ করতে করতে পরিস্থিতি আঁচ করে স্বরূপ স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানায়। ফল হয় উল্টো— কাশ্মীরে কাজ করার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার অপরাধে স্বরূপকেই থানায় আটকে মারধর করা হয়, এবং তুলে দেওয়া হয় সেই ঠিকাদার ‘কোম্পানি’-র হাতে। ‘কোম্পানি’র ঘরে স্বরূপকে কয়েক দিন আটকে রাখার পর পাঠিয়ে দেওয়া ভগবানপুর নামে একটি জায়গায়, ফের রেস্তরাঁর কাজে। রাতের অন্ধকারে স্বরূপ পালায়, এ বার আর পুলিশের কাছে যাওয়ার ভুল করেনি। ‘কোম্পানি’-র সেই বিশেষ ঘরটিতে কিছু দিন বন্দি থাকতে হয়েছে সকলকেই। তার প্রসঙ্গ এলেই এই কিশোরদের মুখগুলি রক্তশূন্য হয়ে যায়।

ঘরে ফিরে রূপেশরা ওই ঠিকাদারকে খুঁজে বার করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায়নি। পাচারকারীরা চা-বাগানের দারিদ্র-জর্জর শ্রমিক বস্তিগুলোর আশেপাশে ওত পেতে থাকে। কারখানায় চাকরির লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে যায় বাগানের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের। আনন্দপুর টি-গার্ডেনের আজ়াদ ওরাঁও সতেরো বছর বয়সে এক ঠিকাদারের সঙ্গে গিয়েছিল রাজস্থানে, স্মার্টফোন পাওয়ার আশায়। তার ঝুলিতেও রয়েছে রাজস্থানের ‘মালিক’-এর কবল থেকে ফিরে রোমহর্ষক কাহিনি। সকলেই ঠিকাদারকে পেলে উত্তমমধ্যম দিতে চায়, কিন্তু তাকে খুঁজে পায়নি। ভুক্তভোগী মহিন্দর খেরিয়া দোষ দিচ্ছিলেন অভিভাবকদেরও। চা-বাগানের পানাসক্ত শ্রমিক পিতার হাতে কয়েক হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে নাবালক সন্তানদের কাজে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে ঠিকাদাররা।

ঠিকাদার চক্র সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এক এজেন্ট থেকে অন্য এজেন্টের হেফাজতে ঘুরে অভীষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয় সহায়সম্বলহীন মজুরকে। কাজের শর্ত, কর্মস্থল, কোনও কিছুই মজুরের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। টাকার হাতবদল হয় তার অলক্ষ্যে। নিয়োগকর্তা টাকা দেয় এজেন্ট বা কোম্পানিকে। শ্রমিক বছরভর খাটে বিনা পয়সায়, সামান্য মজুরিতে। এই পরিস্থিতিকে ‘দাসশ্রম’ বা ‘বন্ডেড লেবার’ ছাড়া আর কী বলা যায়? বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে, ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতিতে এ ভাবে শ্রমিক জোগান দেওয়া মানব পাচার ছাড়া আর কী?

রূপেশদের পূর্বপুরুষরা রাঁচী তথা ঝাড়খণ্ড অঞ্চল থেকে এসেছিলেন চা-বাগানে। রূপেশের মা-বাবার প্রজন্মের অনেকে চা-বাগানের ‘স্থায়ী চাকরি’ ছেড়ে যেতে চান না। অথচ, আজ চা-বাগানগুলি ধুঁকছে। রূপেশের প্রজন্ম এই বিপন্নতা নিয়ে বাগানে স্বল্প মজুরির কাজে লেগে থাকতে নারাজ। চা-বাগানের জনজাতিদের পরিযাণকে কেন্দ্র করেই গজিয়ে উঠেছে পাচারচক্র। দুনিয়াদারি না-জানা এই জনজাতিরা মজুরিহীন শ্রমের ফাঁদে পা দিচ্ছেন বার বার। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে এই বীভৎস ব্যবস্থা বেশ টিকে আছে। সময়ের সঙ্গে পাচারচক্রও কৌশলী হয়ে উঠছে। চেন্নাইয়ে সোনার কাজে পশ্চিমবঙ্গের শিশুশ্রমিকদের নিয়ে একটি রিপোর্টে অবিশ্বাস্য একটি তথ্য উঠে এসেছিল, ওই নাবালকদের ভাল ভাল খাবার দেওয়া হত, মোবাইলে গেম খেলতে দেওয়া হত ঘণ্টাখানেক। শুধু বেরোনো বারণ ছিল, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ নিষিদ্ধ।

প্রশাসন কি জানে না? গরুবাথান ব্লকে একাধিক জায়গায় প্রশাসনের পোস্টার, ‘সতর্ক থাকুন, আপনি মানব পাচারের শিকার হতে পারেন’। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত মানব পাচার কেসের সংখ্যা ষাট। প্রকৃত ছবি বুঝতে ধরতে হবে নিখোঁজদেরও। বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন সুশীল। সুশীলের মা সাবিনা নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন, পুলিশের পায়ে পড়েছেন, ছেলের খোঁজ পাননি। এজেন্ট ফোনে সাবিনার গলা শুনলে ফোন কেটে দেয়। ওই শ্রমিক বস্তিরই জাস্টিন ওরাওঁ তিন বছর আগে উত্তরপ্রদেশে খেতের কাজ করতে গিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছেন। কুমলাই চা-বাগানেও গত ডিসেম্বরে নিখোঁজ হয়েছেন এক জন। শ্রমের কারাগার থেকে মুক্তি পেতে চিরতরে হারিয়েই যাচ্ছেন কত শ্রমিক, তার হিসাব করছে কে?

অন্য বিষয়গুলি:

Slavery Society India Workers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy