যে সব সংস্থায় বড় মাপের ছাঁটাই হচ্ছে, সেগুলির প্রায় প্রত্যেকটিই ‘ইন্টারনেট বেসড’। প্রতীকী ছবি।
কয়েকশো বা হাজার-দু’হাজার নয়, গত কয়েক মাসে আমেরিকার প্রযুক্তি শিল্পে কাজ হারিয়েছেন দু’লক্ষেরও বেশি মানুষ। মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজ়ন, মেটা-সহ বহু বিখ্যাত বহুজাতিক সংস্থা গণ-ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটে বয়স এবং অভিজ্ঞতা নির্বিশেষে হাজার-হাজার কর্মীকে জানিয়ে দিয়েছে: আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আপনি আসতে পারেন। তাঁদের মধ্যে কেউ প্রায় তিন দশক কাজ করেছেন সিলিকন ভ্যালির কোনও এক বহুজাতিক সংস্থায়, কেউ আবার সদ্য যোগ দিয়েছিলেন চাকরিতে। যাঁরা গণ-ছাঁটাইয়ে চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ভারতীয়, যাঁরা অনেকেই আমেরিকায় চাকরি করছিলেন ‘ওয়ার্ক ভিসা’য়— যার শর্ত অনুযায়ী কর্মহীন অবস্থায় আমেরিকায় থাকা যায় মাত্র কয়েক মাস। তার মধ্যে নতুন কাজ না পেলে, বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে আমেরিকা পরিত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আমেরিকার শ্রমবাজারের এই সঙ্কট অন্তত দু’টি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, চিরাচরিত ভাবে গণ-ছাঁটাইয়ের প্রধান বলি সাধারণত হন স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ কিংবা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকরা। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। যে দু’লক্ষ মানুষ আমেরিকার প্রযুক্তিশিল্পে কাজ হারিয়েছেন তাঁরা প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক, ‘হোয়াইট কলার ওয়ার্কারস’। ২০০৮-এর মন্দার কথা বাদে দিলে, সাম্প্রতিক অতীতে এই হারে ‘হোয়াইট কলার ওয়ার্কারস’ ছাঁটাইয়ের নজির খুব একটা নেই। দ্বিতীয়ত, এই গণ-ছাঁটাই এমন সময়ে হচ্ছে, যখন পৃথিবী সবে কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করে অর্থনৈতিক ভাবে একটা স্থিতাবস্থায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছিল। আমেরিকার শ্রমবাজারের এই পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের সেই স্থিতাবস্থায় পৌঁছনোর পথটিকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলল।
প্রশ্ন হল, স্বপ্নের সিলিকন ভ্যালিতে ‘এত রক্ত কেন?’ যে সব সংস্থায় বড় মাপের ছাঁটাই হচ্ছে, সেগুলির প্রায় প্রত্যেকটিই ‘ইন্টারনেট বেসড’— অর্থাৎ তারা তাদের পরিষেবা প্রদান করে থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কোভিড অতিমারির সময় এই সংস্থাগুলির পরিষেবার জন্য তৈরি হয়েছিল আকাশচুম্বী চাহিদা। তার কারণ সেই সময়, আমাদের প্রায় সারা ক্ষণই বাড়ির মধ্যে কাটাতে হত বলে দিনের একটা দীর্ঘ সময় কাটত সমাজমাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ওয়েব সিরিজ় দেখে। যাবতীয় কেনাকাটাও করতাম অনলাইনে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে পারলে মুনাফা বাড়ার সুযোগ, কিন্তু তাঁর জন্য প্রচুর কর্মী নিয়োগ করা প্রয়োজন। তাই কোভিড অতিমারির সময় প্রচুর কর্মী নিয়োগের পথে হেঁটেছিল সংস্থাগুলি। তাদের যা উদ্দেশ্য—অর্থাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা— সেটা পূরণও হয়েছিল।
কিন্তু যখন কোভিডের তরঙ্গ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে শুরু করে, আমরা শুরু করি আবার চার দেওয়ালের বাইরে বেরোতে, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনলাইন পরিষেবার চাহিদা কমতে শুরু করে, ধাক্কা খায় অনলাইন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির মুনাফা। মুনাফা ব্যাহত করে আরও একটি ঘটনা— রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে গত এক বছর ধরে গোটা বিশ্ব ভয়ঙ্কর মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে ভোক্তাদের মধ্যে এই সংস্থাগুলির পরিষেবার চাহিদা কমে যায়— সংস্থাগুলির মুনাফা ব্যাহত হয়। শুধু তা-ই নয়, কমতে শুরু করে ‘ডিজিটাল’ বিজ্ঞাপনও। অতিমারিতে সৃষ্টি হওয়া মুনাফার বুদ্বুদ যেই ফেটে পড়ার উপক্রম হয়, খরচ কমাতে ২০২২-এর শেষ দিক থেকে শুরু হয় গণ-ছাঁটাই, যা আজও চলছে।
তা হলে এই গণ-ছাঁটাইয়ের আসল কারণ কি সংস্থাগুলির ভুলবশত অতিমারির সময়ের বাস্তবকে ‘নিউ নর্মাল’ হিসাবে ধরে নেওয়া (আচরণবাদী অর্থনীতির পরিভাষায় প্রোজেকশন বায়াস?), তাদের বুঝতে না পারা যে, অতিমারিতে সৃষ্টি হওয়া মুনাফার বুদ্বুদ এক দিন ফাটবেই? অসম্ভব, সেটা বলা যাচ্ছে না (বস্তুত, সংস্থাগুলির তরফ থেকেও সে রকমই দাবি করা হচ্ছে)। তবে এটাও সম্ভব যে, সংস্থাগুলি প্রথম থেকেই জানত, অতিমারির সময়ের ‘বাস্তব’ আসলে বাস্তব নয়। তারা জানত, অতিমারি এক দিন শেষ হবেই, মুনাফার বুদ্বুদ অচিরে ফাটবেই। এবং তখন ছাঁটাইয়ের পথে না হেঁটে উপায় থাকবে না কোনও। তাও তারা প্রচুর কর্মী নিয়োগ করেছিল স্রেফ অতিমারির সময় বেশি মুনাফা করার লোভে, কারণ ধনতন্ত্রের মূল মন্ত্রই হল ‘গ্রিড ইজ় গুড’।
আমেরিকায় গণ-ছাঁটাইয়ের ঢেউ সাত সমুদ্র পেরিয়ে ভারতের শ্রমবাজারেও এসে পৌঁছেছে। আমেরিকায় যে সমস্ত বহুজাতিক সংস্থা গণ-ছাঁটাইয়ে রত, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি ইতিমধ্যেই তাদের ভারতের অফিসের কর্মীদের একাংশকে ছাঁটাই করতে শুরু করেছে বা শীঘ্রই শুরু করবে বলে জানা যাচ্ছে। বিপুল হারে ছাঁটাই শুরু হয়েছে বাইজু’স, ওলা, সুইগি, ওয়ো, ডানজ়ো ইত্যাদির মতো ভারতীয় স্টার্ট-আপগুলিতেও। কারণ? অতিমারির সময় স্টার্ট-আপগুলিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের তরফ থেকে আসা বিনিয়োগ কমেনি একটুও। সেই বিনিয়োগের উপরে ভর করে স্টার্ট-আপগুলি তীব্র গতিতে ডালপালা মেলেছিল, নিয়োগ করেছিল প্রচুর কর্মী। কিন্তু ২০২২-এর শুরু থেকেই যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি এবং মন্দার আশঙ্কায় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা তাঁদের বিনিয়োগ অনেক বেশি বাছাই করে করতে শুরু করেন। এর ফলে স্টার্ট-আপগুলিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে শুরু করে দ্রুত। এই পরিস্থিতিতে, মুনাফা ধরে রাখার জন্য, স্টার্ট-আপগুলির খরচ কমানো এবং ব্যবসা পুনর্গঠন করা ছাড়া গতি থাকে না কোনও। তারা, অতএব, ছাঁটাই শুরু করে আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থাগুলির মতোই।
ভারত সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, আমেরিকার মতো ভারতে গণ-ছাঁটাইয়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ভারতের শ্রম আইন আমেরিকার শ্রম আইনের তুলনায় অনেক বেশি শক্তপোক্ত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যে সংস্থাগুলি ছাঁটাই করতে চায়, তারা খুব সহজেই তাদের কর্মীদের স্বেচ্ছা-ইস্তফা দিতে বাধ্য করে আইনের আওতার বাইরে থেকে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের তরফ থেকে যে শক্তপোক্ত শ্রম আইনের কথা বলা হচ্ছে, মনে রাখতে হবে, তা প্রযোজ্য কেবল ‘নন-ম্যানেজারিয়াল’ কর্মীদের ক্ষেত্রে। যারা ‘ম্যানেজারিয়াল’ কর্মী, তাঁরা শ্রম আইনের আওতার বাইরে। শ্রম আইনের আওতার বাইরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী এবং ‘গিগ ইকনমি’-তে কর্মরতরাও। গত কয়েক মাসে ভারতের প্রযুক্তি শিল্পে কাজ হারিয়েছেন যে বিপুল ‘সংখ্যক হোয়াইট কলার ওয়ার্কারস’ তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ বাধ্য হয়েছেন আশ্রয় নিতে এই ‘গিগ ইকনমি’-তেই। এই ধরনের কাজ শ্রম আইনের আওতার বাইরে থাকার দরুন, এঁদের কাজ হারানোর ভয় সর্ব ক্ষণ। শুধু তা-ই নয়, ‘গিগ’ কর্মীদের অধিকার, পারিশ্রমিক এবং সামাজিক সুরক্ষা নিয়েও প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে—তাই ‘গিগ ইকনমি’-তে কাজ করে মাথার উপরে জোটানো ছাদ ঝড়বৃষ্টির সময় একেবারে যদি উড়ে না-ও যায়, তা ফুটো হয়ে যে ঘরে জল চুইয়ে পড়বে না, সেটা বলা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন হল, প্রযুক্তি শিল্পে যদি শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি থাকত— নখদন্তহীন নাম-কা-ওয়াস্তে সংগঠন নয়, সত্যিই শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন— তা হলে বিশ্ব জুড়ে গণ-ছাঁটাইয়ের কবলে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্দশার মাত্রা কি খানিক কম হলেও হতে পারত না? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কিন্তু, তবুও প্রশ্নটা নিয়ে ভাবা যায়। ভাবা জরুরি।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy