E-Paper

ইজ়রায়েল চলল দেশের মজুর 

কিছু দিন আগে ভারত সরকার ইটালির সঙ্গে চুক্তি করে সে দেশেও কুড়ি হাজার শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। ডিসেম্বর ২০২৩-এ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

—ফাইল চিত্র।

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৪ ০৬:৪৬
Share
Save

ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ অব্যাহত, তার মধ্যেই এপ্রিল আর মে মাস জুড়ে দফায় দফায় ভারতীয় শ্রমিকরা উড়ে যাচ্ছেন ইজ়রায়েলে। এপ্রিলের গোড়ায় ইজ়রায়েল সরকার একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ছ’হাজার শ্রমিক যাতে এই দু’মাসে আসতে পারেন, তার জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিকাদারের মাধ্যমে নয়, দু’দেশের সরকারের মধ্যে শ্রমিক সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গত বছর মে মাসে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন যে, ভারত থেকে বিয়াল্লিশ হাজার শ্রমিক পাঠানো হবে। এপ্রিলের গোড়ায় ষাট জন ইজ়রায়েল পৌঁছে গিয়েছেন।

যথেষ্ট দক্ষ শ্রমিক পেতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, এজেন্ট নিয়োগ করেছে স্কিল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে চলা এই সংস্থার মাধ্যমেই শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে ইজ়রায়েলে। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানাতে দক্ষ কর্মীদের নাম লেখাতে বড়সড় শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। চৌত্রিশ হাজার নির্মাণ শ্রমিক এবং আট হাজার নার্সিং কর্মী প্রয়োজন। তা ছাড়াও দরকার লোহার কাজে দক্ষ শ্রমিক, সেরামিক টাইলস বা প্লাস্টার করার কাজে দক্ষ মিস্ত্রি। ভারতীয় শ্রমিকদের চাহিদার কারণ— যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইজ়রায়েল সরকার ৯০ হাজার প্যালেস্টাইনি শ্রমিকের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বাতিল করেছে। অনেক বিদেশি শ্রমিক যুদ্ধ শুরু হতে দেশে ফিরেও গিয়েছেন। এই ঘাটতি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে ভারত সরকার।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে দু’টি বড় প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম প্রশ্নটি নৈতিক। ইজ়রায়েলকে সহায়তা করার অর্থ, গাজ়ার বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের যুদ্ধের সহায়তা করা, যেখানে ইতিমধ্যেই অন্তত ত্রিশ হাজার প্যালেস্টাইনি প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতীয় শ্রমিকরা ইজ়রায়েলের সৈন্যদের ছাউনি, কিংবা প্যালেস্টাইনি বন্দিদের জেলখানা বানাচ্ছেন, এই কল্পনায় মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভারতের দশটি প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে প্রতিবাদপত্র দিয়ে ইজ়রায়েলে ভারতীয় শ্রমিক পাঠানোর বিরোধিতা করেছে। অরুন্ধতী রায় সরকারের সমালোচনা করে লিখেছেন, আমেরিকা রফতানি করছে তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ— অস্ত্র আর টাকা, আর ভারতও রফতানি করছে তার উদ্বৃত্ত সম্পদ— কর্মহীন, দরিদ্র মানুষ। তবে এই সব বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নরেন্দ্র মোদী সরকার কানে তোলেনি।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ওই শ্রমিকদের নিরাপত্তার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, গত বছর অক্টোবরে ভারত সরকার ‘অপারেশন অজয়’-এর মাধ্যমে ছ’টি বিমানে ইজ়রায়েল থেকে বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিককে উদ্ধার করেছিল। অথচ আজ যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই প্রচুর শ্রমিককে সে দেশে পাঠাতে চায়। এপ্রিলে প্রথম দফায় শ্রমিকদের পাঠানোর সময় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জায়সওয়াল সাংবাদিকদের বলেন যে, শ্রমিকদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য সার্বিক ব্যবস্থার শর্ত দু’দেশের চুক্তির মধ্যেই রয়েছে, এবং ইজ়রায়েল তার রূপায়ণ করছে। বস্তুত গত বছর মে মাসে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিতে বলা হয়েছে, ভারতের শ্রমিকদের ইজ়রায়েলের নাগরিকদের সমান মর্যাদা দেওয়া হবে, এবং যথাযথ আবাসন, স্বাস্থ্য বিমা এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বিশদ শর্তগুলি কী, তা জানা যায়নি। মালয়ালি শ্রমিক নিবিন ম্যাক্সওয়েল (৩১) হামাসের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। অতীতে কুয়েত, ইরাকের যুদ্ধ, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় শ্রমিকদের অবস্থা হয়েছিল ভয়ঙ্কর। ইজ়রায়েলে কাজের অভিজ্ঞতাও সর্বদা ভাল নয়— কম মজুরি, অতিরিক্ত সময় খাটানো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা, থাকা-খাওয়ার অব্যবস্থা, এমন নানা সঙ্কটের কথা জানিয়েছিলেন ভারতীয় শ্রমিকরা। প্রসঙ্গত, বিদেশে যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের যে নিয়মবিধি বা ‘প্রোটোকল’ রয়েছে— যেমন বিদেশ দফতরের ই-মাইগ্রেট পোর্টালে নথিভুক্ত করা, বিমা করা— সে সব এ ক্ষেত্রে মানা যাচ্ছে না। কারণ গন্তব্য দেশগুলির মধ্যে ইজ়রায়েল নেই। কেবল দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভরসায় শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে, অথচ যুদ্ধরত একটা দেশ কী করে শ্রমিকদের সুরক্ষিত রাখবে, তা স্পষ্ট নয়।

প্রসঙ্গত কিছু দিন আগে ভারত সরকার ইটালির সঙ্গে চুক্তি করে সে দেশেও কুড়ি হাজার শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। ডিসেম্বর ২০২৩-এ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কথা চালাচ্ছে তাইওয়ানের সরকার, এক লক্ষ শ্রমিক পাওয়ার জন্য। পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকরা বিভিন্ন উপনিবেশে ভারতীয় শ্রমিকদের রফতানি করত। কী অমানবিক পরিস্থিতিতে তাদের কাজ করতে হত, তার সাক্ষ্য মেলে ইতিহাসে, সাহিত্যে। স্বাধীন ভারতে ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় সক্রিয় ভূমিকা নিত না। মোদী সরকার সেই নকশা বদল করল। বহু শ্রমিক এতে উৎসাহী— বিদেশের মুদ্রায় তাঁরা যা রোজগার করতে পারবেন, তা ভারতের চাইতে অনেকটা বেশি। আবার অনেকে আপত্তি করছেন, ভারতে কাজ তৈরি না করে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো কেমন নীতি? দেশের শ্রমসম্পদকে কি এখন রফতানিযোগ্য ভাবা হচ্ছে? অতীত দেখিয়েছে, বিদেশে দরিদ্র মানুষটাই পণ্য হয়ে যায়, মানবাধিকার বা নীতি-নৈতিকতা অবশিষ্ট থাকে না। চুক্তির মাধ্যমে এ বছর যে শ্রমিকরা বাইরে যাচ্ছেন, তাঁদের নিরাপত্তা, মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে তো?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

israel India Workers Israel Palestine Conflict

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।