—ফাইল চিত্র।
ধূপগুড়ি বিধানসভা উপনির্বাচন খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরের কথা। বিজেপির হাত থেকে জলপাইগুড়ি জেলার এই বিধানসভা আসন তৃণমূল পুনরুদ্ধার করেছিল। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি এই আসনে জিতলেও বিজেপি বিধায়কের প্রয়াণের পরে উপনির্বাচন হয়। তৃণমূল জিতে যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধূপগুড়ির সেই জয়কে ‘ইন্ডিয়া টিমের বড় জয়’ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। এমন নয় যে, ধূপগুড়িতে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূল, কংগ্রেস, বামেদের জোট হয়েছিল। তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেস আলাদা-আলাদাই ভোটে লড়েছিল। তা সত্ত্বেও তৃণমূলনেত্রী একে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জয় হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন।
মাত্র পাঁচ মাস পরে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইতে তৃণমূল একাই যথেষ্ট। ইন্ডিয়া-র দলগুলির মধ্যে আসন সমঝোতার প্রয়োজন নেই। তৃণমূল একাই ৪২টি আসনে লড়বে। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ৪২টি আসনের মধ্যে মাত্র ২২টি আসনে জিতেছিল। বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি আসন। তৃণমূল ৪৩.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বিজেপি পেয়েছিল ৪০.৭ শতাংশ ভোট। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের তুলনায় ২০১৯-এ রাজ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছিল ২২ শতাংশ-বিন্দুর বেশি। পাঁচ বছরে এতখানি ভোটের হার বেড়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে একাই বিজেপির মোকাবিলা করতে পারে। তাঁদের কারও সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রয়োজন নেই। তাঁরা মনে করছেন, তৃণমূল এ বার ২০১৯-এর তুলনায় বেশি আসন পাবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে খান-ত্রিশ আসন পেলে লোকসভায় তৃণমূল গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে উঠে আসবে। তখন কেন্দ্রে যে সরকারই থাকুক না কেন, দর কষাকষি করতে সুবিধা হবে।
প্রশ্ন হল, কিসের ভিত্তিতে এমন আশা করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? উপনির্বাচন বাদ দিলে রাজ্য জুড়ে শেষ নির্বাচন হয়েছে গত বছর জুলাইতে। পঞ্চায়েত ভোটে। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪ শতাংশের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে এসেছিল। ২০২৩-এ তা ১০ শতাংশের আশেপাশে চলে এসেছে। লক্ষণীয় যে, প্রবল হিংসা ও বিপুল রিগিংয়ের অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূল যত আসনে লড়েছিল, তার মধ্যে ২৮ শতাংশের বেশি আসনে হেরেছে। উল্টো দিকে, বিজেপি গ্রাম পঞ্চায়েতে যত আসনে জিতেছিল, তার মধ্যে ২৬ শতাংশ আসনেই জিতেছে। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর থেকে দক্ষিণবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়ার মতো জেলায় আগের থেকেও ভাল ফল করেছে বিজেপি।
তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব যেটা মানতে চাইছেন না, তা হল, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পরে রাজ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তার একটা বড় কারণ। প্রাথমিক শিক্ষক থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হলে তার ফলে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হন। সামগ্রিক ভাবে শিক্ষাব্যবস্থার উপরেও প্রভাব পড়ে। পড়ুয়ারা যদি ভাবে, স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, সে কি আর শিক্ষক-শিক্ষিকাকে মানতে চাইবে? প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষিকারাও স্কুলে নতুন চাকরিতে যোগ দিতে আসা সহকর্মীকে সংশয়ের চোখে দেখবেন। তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের বিরুদ্ধে গরু পাচার-কয়লা চুরির মতো অভিযোগও রয়েছে। তার সঙ্গে ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে স্থানীয় স্তরেও শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জমতে বাধ্য।
বিজেপি যে লোকসভা ভোটে এই শাসক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে কাজে লাগাতে চাইবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘিরে ভাবাবেগ পশ্চিমবঙ্গে কতখানি কাজে দেবে, সেটা সময় বলবে। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার সঙ্গে বিজেপি মেরুকরণের রাজনীতিকেও ফের হাতিয়ার করবে। তাই ভোটের বাদ্যি বাজার আগেই বিজেপির রাজ্য নেতারা নতুন করে ঝুলি থেকে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বার করে এনেছেন।
যে ধূপগুড়ির উপনির্বাচনে বিজেপির থেকে তৃণমূলের আসন ছিনিয়ে আনাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ইন্ডিয়া জোটের জয়’ হিসাবে দেখেছিলেন, সেখানে কী হয়েছিল? বিজেপি হেরেছিল ঠিকই, কিন্তু ২০২১-এর তুলনায় ২০২৩-এ বিজেপির ভোট কমেছিল খুবই সামান্য। ২০২১-এ বিজেপি ধূপগুড়িতে ৪৫.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০২৩-এর উপনির্বাচনে হেরে গেলেও বিজেপি পেয়েছিল ৪৪.২৩ শতাংশ ভোট। ফলে উপনির্বাচনেও মমতা-অভিষেক বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাতে পারেননি। এর সঙ্গে লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে হাওয়া এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ যোগ হবে। গত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাঙালি পরিচিতি সত্তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। ‘বহিরাগত, হিন্দি বলয়ের পার্টি’ তকমা দিয়ে বিজেপিকে বাংলায় রুখে দিতে তৃণমূলই পারে বলে স্লোগান তুলেছিলেন। লোকসভা ভোটে সেই অঙ্ক কাজ করার কথা নয়। সব মিলিয়ে আসন্ন লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন কমার সম্ভাবনা যে খুবই কম, তা হলফ করে বলা যায়। বরং আসন বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব প্রথম থেকেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি কংগ্রেসকে দু’টির বেশি আসন দেবেন না। বহরমপুর ও দক্ষিণ মালদহ। কংগ্রেস গত লোকসভায় এই দু’টি আসনই জিতেছিল। এ বার কংগ্রেস তার সঙ্গে দার্জিলিং, পুরুলিয়া, রায়গঞ্জের মতো আসন চাইছিল। এমন নয় যে, এগুলো তৃণমূলের জেতা আসন। এগুলি সবই বিজেপির দখলে। এর মধ্যে দার্জিলিঙে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ভোটের হারের বিস্তর ব্যবধান ছিল। সেই ব্যবধান মিটিয়ে তৃণমূল এ বার বিজেপির থেকে আসন ছিনিয়ে নেবে, এমন সম্ভাবনা কম। ফলে সেই আসন তৃণমূল যদি কংগ্রেসকে ছেড়ে দিত, তা হলেও তৃণমূলের আপাত ভাবে কোনও ক্ষতি হত না। অন্য দিকে, পুরুলিয়া, রায়গঞ্জে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হলে বিজেপিকে হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হত।
এটা ঠিক, রাজ্যে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে আসন সমঝোতা হলেই যে কংগ্রেসের যাবতীয় ভোট তৃণমূলের ঝুলিতে এসে পড়ত বা তৃণমূলের ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে চলে যেত, এমনটা নয়। কারণ, রাজ্য-রাজনীতিতে তৃণমূল ও কংগ্রেস এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু অন্তত তৃণমূলের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোট লড়ছে এমন বার্তা দিতে পারলে তৃণমূল এ রাজ্যে লোকসভা ভোটের লড়াইকে জাতীয় রাজনীতির চরিত্র দিতে পারত। তা না হওয়ায় রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ বিজেপির প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে।
ঠিকই, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সঠিক ভাবে, সঠিক সময়ে আলোচনা করে উঠতে পারেনি। তৃণমূল নেত্রী গান্ধী পরিবারের দিক থেকে আরও সদর্থক বার্তা আশা করছিলেন। কংগ্রেসকে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে বলেছিলেন। কংগ্রেস গন্ডগোল পাকিয়েছে। উল্টো দিকে, তৃণমূলনেত্রীও আলোচনা শুরুর আগেই কংগ্রেসকে মাত্র দু’টি আসন ছাড়া হবে বলে অনড় মনোভাব নিয়ে ফেলেছিলেন। এখন তৃণমূল রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করে কংগ্রেস বিরোধিতার মনোভাব নিয়ে চলছে। যে কোনও সমঝোতায় দেওয়া-নেওয়ার মনোভাব দরকার। আসন সমঝোতা না হওয়ার জন্য তৃণমূল এখন যাবতীয় দোষ কংগ্রেসকেই দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যের প্রধান বিজেপি বিরোধী দল হিসাবে ইন্ডিয়া-র আসন সমঝোতায় তৃণমূলেরও উদ্যোগী এবং নমনীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল।
বিজেপিকে হারানোর মতাদর্শগত দায় যদি কংগ্রেসের থেকে থাকে, তা হলে তৃণমূলের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই দায় এড়াতে পারেন না। প্রদেশ কংগ্রেস, রাজ্য সিপিএমের নেতাদের অভিযোগ, সিবিআই-ইডির হাত থেকে নিজের ঘনিষ্ঠদের বাঁচাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ‘সেটিং’ করে ফেলেছেন। সেই ‘সেটিং’ যে হয়নি, তা প্রমাণের দায়ও তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্বেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy