Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজ্যভিত্তিক রাজনীতিই ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সফল করতে পারে
Opposition Parties Meet

যার শক্তি যেখানে

দশ বছরে বিজেপির রাজনীতি মোটামুটি তিনটে ভাষ্য তৈরি করেছে: এক, অর্থনৈতিক ‘বিকাশ’; দুই, নরেন্দ্র মোদীর ‘সুদৃঢ় নেতৃত্ব’; তিন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ।

An image of Opposition Party Meet

সম্মিলিত: বেঙ্গালুরুতে বিজেপি-বিরোধী জোটের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাহুল গান্ধী। ১৮ জুলাই ২০২৩। ছবি: সংগৃহীত।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ ০৪:৩৮
Share: Save:

এই যদি রাজনীতি হয়, তবে নাগরিক সমাজ কোথায়?” বেঙ্গালুরুতে বিজেপি-বিরোধী জোটের ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণের শুভলগ্নে এমন বেসুরো প্রশ্ন উঠতেই পারত। জোটের মঞ্চে হাজির নেতাদের বেশির ভাগই রাজনীতির ময়দানে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী; তাঁরা জানেন, ধারণা হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা গণতন্ত্র যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনী ময়দানের প্রশ্ন হিসাবে ততখানি নয়। ভারত নামক ধারণাটিকে রক্ষা করার তাগিদই যদি তাঁদের কাছাকাছি আনে, তবে তা অতি সুসংবাদ, কিন্তু শুধু সেই নৈতিক উচ্চতা নির্বাচনী বৈতরণি পার করে দেবে না। তার জন্য রাজনীতি চাই। তার একমাত্র পথ, বিজেপির রাজনীতির স্পষ্ট, গ্রহণযোগ্য এবং সাধারণের বোধগম্য বিকল্প তৈরি করা। ‘সাধারণের বোধগম্য’ মানে রাজনীতির অতিসরলীকরণ নয়— এমন সব প্রশ্নকে ধরা এবং সেগুলিকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিনতায় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।

দশ বছরে বিজেপির রাজনীতি মোটামুটি তিনটে ভাষ্য তৈরি করেছে: এক, অর্থনৈতিক ‘বিকাশ’; দুই, নরেন্দ্র মোদীর ‘সুদৃঢ় নেতৃত্ব’; তিন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ। তিনটে ভাষ্যেই অসংখ্য ফুটিফাটা, বিস্তর চিড়: তিনটির বিরুদ্ধেই আক্রমণ শাণানো যায়, তৈরি করা যায় স্পষ্ট বিকল্প। প্রশ্ন হল, জোট সেই কাজটা কোন পথে করবে? একটা সর্বভারতীয় বিকল্প ভাষ্য তৈরি করে প্রত্যেক রাজ্যে প্রচার চালাবে সেই লাইন ধরেই? না কি, জাতীয় স্তরে একটা ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি তৈরি করে প্রত্যেকটি রাজ্যে জোটের শরিক প্রভাবশালী দল রাজ্যের বাস্তবের কথা মাথায় রেখে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতি তৈরি করবে? ভারত নামক দেশটাকে কী ভাবে দেখব— একটা একশৈলিক অস্তিত্ব হিসাবে, না কি বহু আপাত-পরস্পরবিরোধী অস্তিত্বের সহাবস্থান হিসাবে— জোটকে আসলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ভারতকে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের একশৈলিক অস্তিত্ব হিসাবেই দেখেছে— বহুত্বের যে কোনও প্রকাশকে অ-ভারতীয় বা ভারত-বিদ্বেষী বলে দাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সেই একশৈলিক দর্শনই হয়ে উঠেছে বোঝা— মোদী-শাহ জুটির জোরে ভোটজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরেই। বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোটের বৈঠকের আগে তড়িঘড়ি এনডিএ শরিকদের বৈঠক ডাকতে হল বিজেপিকে। বিরোধীদের জোটশক্তি প্রদর্শনের পাল্টা দেওয়ার তাগিদ তার নিতান্তই আপাত-কারণ— মূল কারণ হল, বিজেপি টের পাচ্ছে যে, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের স্লোগান দিয়ে যত দূর যাওয়া যায়, ততটা পথ হাঁটা হয়ে গিয়েছে, বাকি পথ চলতে গেলে দিল্লি (অথবা আমদাবাদ) থেকে তৈরি করা নীতি নয়, প্রয়োজন স্থানীয় স্তরের ভাষ্যের। তার জন্য শরিকদের চাই, রাজনৈতিক বহুত্ব চাই।

এনডিএ-র শরিকদের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সে পথ মোদী-শাহের বিজেপিই বন্ধ করে দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু দল ছাড়া, এক এআইএডিএমকে বাদে, জোটে এমন কোনও দল নেই, বিজেপিকে বাদ দিয়ে যার নিজস্ব রাজনৈতিক জোর রয়েছে। মহারাষ্ট্রে অজিত পওয়ারের এনসিপি বা একনাথ শিন্দের শিবসেনার দৃষ্টান্ত স্মরণীয়। পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দলের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে যে, বিজেপি তার জোটসঙ্গীদের সঙ্গে ঠিক কী করেছে। নরেন্দ্র মোদী যতই বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ গড়ে ওঠার স্মৃতি চর্চা করুন, পঁচিশ বছর আগের সেই জোট ছিল ভিন্ন সাধনার ফল। তখন শরিকদের জায়গা দিতে উগ্র হিন্দুত্বের স্লোগান ধামাচাপা দিয়েছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর ন’বছরে শরিকরা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য বাধ্য হয়েছে বিজেপির পথে হাঁটতে। তাই আজ জোট খুঁজতে নেমে মোদীরা হোঁচট খাচ্ছেন।

মোদী-শাহের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে দুর্বল হয়েছে বিজেপির অধিকাংশ রাজ্য সংগঠনও। দুটো সাম্প্রতিক উদাহরণ কর্নাটক আর পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য স্তরের নির্বাচনেও বিজেপির মুখ সেই নরেন্দ্র মোদীই, রাজ্যের নিজস্ব প্রশ্নের বদলে গুরুত্ব পেয়েছে তিনটি কেন্দ্রীয় ভাষ্যই। সেই ভাষ্যের রাজনীতিতে তৈরি হওয়া অসন্তোষ মেটাতে যখন আঞ্চলিক প্রশ্নকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে, তখন বিজেপির হাত-পা বাঁধা। বুলডোজ়ার চালানোর এটাই বিপদ— দুর্মর গতিতে পথের যে কোনও বাধা গুঁড়িয়েএগিয়ে যাওয়া যায় বটে, কিন্তু হঠাৎ পথ বদলাতে হলেই মুশকিল। সে রাক্ষুসে যন্ত্রের মুখ ঘোরানো সহজ নয়।

এই জায়গাতেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের একটা সুবিধা— সেখানে এমন কোনও রাজনৈতিক দল নেই, যারা অন্য দলগুলোর উপর নিজেদের কোনও সর্বভারতীয় অবস্থান চাপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু, কংগ্রেস বাদেও অন্তত পাঁচটি এমন দল আছে, যারা রাজ্য স্তরের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। এমন দল আছে, যারা প্রতিনিধিত্ব করে নির্দিষ্ট পরিচিতিভিত্তিক গোষ্ঠীর— সে পরিচিতি জাতেরই হোক, ধর্মেরই হোক বা ভাষার। ভারতীয় রাজনীতি যত বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়, তার প্রতিটিতেই বিজেপি-বিরোধিতার অক্ষ প্রস্তুত হয়ে আছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিজেপির অবস্থান নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। শুধু খেয়াল করা দরকার, আক্রমণের লক্ষ্য কিন্তু মুসলমানরাই নয়, খ্রিস্টান-সহ অন্যরাও। দলিত ও জনজাতি সম্প্রদায়কে বিজেপি যে বৃহৎ হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনতে চায়, তাতে বর্ণহিন্দু আগ্রাসন গত কয়েক বছরে অতি প্রকট। পরিচিতির সেই প্রশ্নটিও জরুরি। জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে গোটা দেশে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতির বিরোধিতাও দরকারি। আবার, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জোটসঙ্গী এবং রাজনৈতিক বন্ধুদের মধ্যে একাধিক দল ঘোষিত ভাবেই বাংলা ভাগ করতে চায়। বিজেপি-বিরোধী রাজনীতি কি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না? এক-এক রাজ্যে এক-একটি প্রশ্নের গুরুত্ব আলাদা। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সুবিধা হল, বহু রাজ্যেই এই প্রশ্নগুলি তোলার মতো দল এই ছাতার নীচে আছে। যেখানে যে প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন, জোটের রাজনীতি সে ভাবেই চলুক।

পাশাপাশি, সর্বভারতীয় রাজনীতির একটি অক্ষ তৈরি হতে পারে অর্থনীতির প্রশ্ন নিয়ে। গত ন’বছরে অর্থব্যবস্থার কোমর ভাঙতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে তুলে আনা যায় মূল্যস্ফীতি আর বেকারত্বের প্রশ্ন দু’টিকে। ন’বছরে মুষ্টিমেয় মানুষের সম্পদ বেড়েছে, সিংহভাগ মানুষ আরও বিপন্ন হয়েছেন। যে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিজেপি ঝকঝকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তারা ভাল নেই। খুব খারাপ আছেন দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ— কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দ কমেছে, অসংগঠিত ক্ষেত্র এখনও নোট বাতিল আর জিএসটি-র ধাক্কা থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ায়নি।

অতএব, জোটের সামনে সম্ভাবনা প্রচুর। সমস্যাও কম নয়। দুটোর কথা উল্লেখ করা যাক। প্রথমত, চারটি গুরুত্বপূর্ণ দল জোটের বাইরে রয়েছে— উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বিএসপি, তেলঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্র সমিতি, ওড়িশায় নবীন পট্টনায়কের বিজেডি এবং অন্ধ্রপ্রদেশে জগন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস। এই চার রাজ্যে লোকসভা আসন ১৪৩, তার মধ্যে এই দলগুলির হাতে রয়েছে ৫৩টি আসন। এদের বাদ দিয়ে— অথবা, এদের এনডিএতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে— জোটকে অঙ্ক কষতে হবে। কঠিন অঙ্ক।

দ্বিতীয় সমস্যা হল, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এবং কেরলে সিপিএম-এর সঙ্গে যথাক্রমে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের যে বিরোধ— ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুতা— তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু সেই বৈরকে পাশে সরিয়ে রেখে রাজ্য-নির্দিষ্ট ভাবে জোটের প্রশ্নগুলোকে এমন ভাবে সাজানো দরকার, যাতে দুই দল পাশাপাশি কাজ করতে পারে। কী ভাবে, তা স্থির করতে হবে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকেই। তবে, সিপিএম-নেতৃত্ব দুটো কথা মাথায় রাখতে পারেন। এক, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে দলের রাজনৈতিক ওজন সমান নয়, ফলে দু’রাজ্যে দল সমান গুরুত্ব দাবি করতে পারে না; এবং দুই, প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যবধানের সঙ্গে নিছক ‘রেটরিক’কে গুলিয়ে ফেললে মুশকিল।

নির্বাচনের ফল কী হবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রশ্নই উঠছে না। তবে এটুকু বলা যায়, জোট যদি নাগরিক সমাজের ভূমিকায় অভিনয় করার বদলে প্রকৃত রাজনীতির পথে হাঁটে, তবে বিজেপির পক্ষে এই নির্বাচন সহজ হবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Opposition Parties Anti BJP Alliance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy