বাঙালির আরবি-উর্দু-ফার্সি শিক্ষার ইতিহাস রয়েছে। প্রতীকী ছবি।
এত দিন জানা ছিল, ‘মুসলমানের মুখের ভাষা’ যে বাংলা নয়, এই মতবাদটা মূলত একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের একচেটিয়া। ঘৃণার রাজনীতির রণকৌশল হিসেবে শব্দকেন্দ্রিক বিদ্বেষের চাষ হত। নির্দিষ্ট কিছু শব্দের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ‘আমরা-ওরা’র ধর্মীয় বিভাজনের কৌশল হিসেবে বানান ভুলে ঠাসা হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড বুঝিয়ে দিত, জল না বলে পানি বলার কারণে বাংলা ভাষার কতখানি ক্ষতি হচ্ছে ইত্যাদি। এই ভাষা দিবসে শুরু হওয়া তরজা বলে দিচ্ছে, সমস্যাটা গভীরতর।
যে শিল্পীর বক্তব্য থেকে বিতর্কের সূচনা, এত দিন তাঁকে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা মনে হওয়ার মতো কোনও কারণ ঘটেনি— এই একটি মন্তব্যের কারণে তাঁকে সে ভাবে চিহ্নিত করাও সম্ভবত সরলীকরণ হবে। তার চেয়ে বরং তাঁকে এক জন সাধারণ উচ্চবর্ণ হিন্দু হিসেবে দেখলে সমস্যাটির গভীরে পৌঁছনো সহজ। এবং, তাঁর মন্তব্যের প্রতিবাদ করলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকের বয়ানও তাৎপর্যপূর্ণ। “যাঁরা ও পার থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁরা এই ভাষাটিকে গ্রহণ করেছেন।” অর্থাৎ, পানি বা দাওয়াত ‘আমাদের ভাষা’ নয়, ‘ওদের ভাষা’, এ কথা নিয়ে সংশয় নেই— ‘ওদের’ ভাষাকে খানিক জায়গা করে দেওয়ার মধ্যেই সহিষ্ণুতা। অনেকে আবার ব্যাকরণের সূত্র খুঁজে দেখাতে চাইলেন, ‘পানি’ শব্দটার মূল রয়েছে সংস্কৃতেই, কাজেই একে ‘ওদের’ শব্দ বলাটা অন্যায় হবে। মোট কথা, পক্ষে অথবা বিপক্ষে যিনি যে দিকেই থাকুন, ভাষার ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে প্রত্যেকেই নিঃসংশয়। আসল বিপদটা এখানে— শুভাপ্রসন্নের একটা ছুটকো মন্তব্যে নয়, আইটি সেলের নিরন্তর প্রচারেও নয়। ভাষার ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন ক্রমে সর্বজনমান্য হয়ে উঠেছে বলেই তাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা এত সহজ হয়েছে।
যে শব্দমালা বাঙালির জীবনের সঙ্গে এত কাল জুড়ে রয়েছে সেগুলিকে ‘মুসলমানি’ আখ্যা দেওয়া আসলে ভাষার সাম্প্রদায়িকতা। যেখানে জেনেবুঝেই আব্বা আর বাবাকে লড়িয়ে দেওয়া হয়৷ জল আর পানির ঠোকাঠুকি চলে। নাস্তা, দাওয়াত ইত্যাদি শব্দকে নির্দিষ্ট ধর্মের শব্দ বলে দাবি করা হয়। রোজকার ব্যবহৃত আইন, আদালত, এজলাস, উকিল, কানুন, রায়, মহকুমা, হাজত-এর মতোই নাস্তা, দাওয়াত প্রভৃতি ভিন্ন ভাষা থেকে আগত শব্দ। ইতিবাচক দিক হিসেবে এই প্রবণতার বিরোধিতায় নানা পাল্টা যুক্তিও উঠে আসছে। কিন্তু, ‘ওদের’ ভাষার প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার ‘উদারতা’ নয়, প্রতিবাদের যুক্তি হিসেবে যে কথাটিকে কেন্দ্রে রাখতে হবে, তা হল, ভাষার ধর্ম হয় না। শুধু ভাষাগত বিভেদ তৈরি করার নয়, প্রতিরোধ করতে হবে ভাষাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ঘৃণার রাজনীতির। কেউ যদি বলেন ‘দাওয়াত’ বাঙালির শব্দ নয়, কিংবা বাঙালি ‘নাস্তা’ করে না, তবে তাঁকে সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, ভাষার হিন্দু-মুসলিম করতে এলে তার ফল ভাল হবে না। এই রাজনৈতিক প্রতিরোধের অবস্থান বাঙালিকে নিতেই হবে। কারণ জল, পানি ইত্যাদির উৎপত্তির ব্যাখ্যার চেয়েও বেশি জরুরি এটা বোঝানো যে, শব্দ কখনও নির্দিষ্ট ধর্মের হতে পারে না।
বাঙালি ‘ব্রেকফাস্ট’ করে, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ‘ইনভিটেশন’ পাঠায়। এই শব্দগুলির ব্যবহারে ‘ওদের শব্দ’ জাতীয় উচ্চবাচ্য নেই। অন্ততপক্ষে ‘গেল গেল’ রব ওঠে না। তা হলে মূল সমস্যা নাস্তা বা দাওয়াত-এ। হতে পারে কেউ ‘গোসল’ শব্দটি ব্যবহার করতে আগ্রহী নন। তিনি ‘স্নান’ শব্দের মাধ্যমে কাজ চালাতেই পারেন। কিন্তু ‘গোসল’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে ‘ফতোয়া’ দিতে পারেন না। অন্য ভাষা থেকে আগত আর পাঁচটা শব্দের মতো কে কোন শব্দ ব্যবহার করবেন, সেটাও ব্যক্তিস্বাধীনতা। শব্দ ব্যবহারের স্বাধীনতা। হিন্দু নামধারী অনেককেই দেখি, ফেসবুকের পোস্টে নিঃসঙ্কোচে ‘ইনশাল্লা’ লিখছেন। শব্দটির মূলে ধর্ম রয়েছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু ব্যবহারে নেই— যিনি লিখছেন, তিনি শব্দটাকে নিছক একটা শব্দ হিসেবেই দেখছেন। যেমনটা দেখা উচিত। পাস্তা বা চাউমিন যে ভাবে বাঙালির খাদ্য-তালিকায় ঢুকে গিয়ে তার একটি বাঙালিকরণ হয়েছে। আলু বা টোম্যাটো এসেছিল বিদেশিদের হাত ধরে। আজ তা আলুপোস্ত বা টোম্যাটোর চাটনিকে কেউ ‘বহিরাগত’ তকমা দেবে কি? খাদ্যাভ্যাস বা পোশাকের মতো ভাষার মধ্যেও এমন সংযোজন এসেছে। এর শিকড় এত গভীরে যে উর্দু, ফার্সি, আরবি ইত্যাদি শব্দগুলো সরিয়ে নিলে বাংলা ভাষা অনেকখানি ‘বেআব্রু’ হয়ে পড়বে৷ তখন পেনসিল হাতে রইলেও, ‘কলম’ থাকবে না৷
বাঙালির আরবি-উর্দু-ফার্সি শিক্ষার ইতিহাস রয়েছে। অতীতে রামমোহন, গিরিশচন্দ্র সেনরাও এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাত্র এক দশক আগেও কেউ কি ভেবেছিলেন এ সব শব্দ ‘পেরেশানি’-র কারণ হবে? বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে এ সব হচ্ছে না। ভাষার বহতা নদী থেকে আঁজলা করে জল (অথবা পানি) পান করার বিচক্ষণতা বাঙালির ছিল। আব্বা, আম্মা, খালা, ফুফু বললে যে সম্পর্কের মাধুর্য বিন্দুমাত্র কমে না, দাওয়াত দিলেও যে নিমন্ত্রণের আন্তরিকতা একই রকম থাকে, এ কথাগুলো বোঝার মতো বোধ বাঙালির এখনও আছে বলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। রাজনীতি যাতে সেই বোধটা নষ্ট না করে দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা সব বাঙালির কর্তব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy