বিক্ষোভ: তফসিলি জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতির দাবিতে কুড়মি সম্প্রদায়ের রেল রোকো আন্দোলন। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, পশ্চিম মেদিনীপুর। —ফাইল চিত্র।
সাঁওতালি ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুন্দর মনোজ হেম্ব্রমের একটা ছোট গল্পের শিরোনাম, ‘ওকা নাখা: পুরুব-পছিম সে উত্তর দাখিন?’ জ্ঞাতি-কলহের এই কাহিনিতে দিশার প্রশ্ন: “কোন দিকে: পূর্ব-পশ্চিম না উত্তর-দক্ষিণ?” এখানে মৃত গ্রাম-প্রধান (মাঞ্ঝি-হাড়াম)-রা গদা মুর্মুর দেহ ছেড়ে বেরিয়ে উপরে ভাসতে থাকা আত্মার প্রার্থনা: এখন তাঁর শেষ যাত্রার সময়, পূর্ব-পশ্চিম অথবা উত্তর-দক্ষিণ যে ভাবে চায় তারা তাঁকে শুইয়ে দিক। তাঁর “শুধু একটি আর্জি, সবাই মিলে শান্তিতে থাক।” এই আকুতির শিকড় ছড়িয়ে-জড়িয়ে আছে ‘আদিবাসী’ লোকসমাজের গাঁথুনির সঙ্গে। শান্তিতে থাকার জন্য সাঁওতালরা বারংবার দেশ ছেড়ে দেশান্তরি হয়েছেন, কোথায় কয়ডা, কোথায় কান্দাহারি, কোথায় চাঁই-চম্পাগড়, সেই সব আদি বাসভূমি থেকে বারংবার নতুন ভূমির সন্ধান করেছেন, শুধু শান্তিতে থাকবেন বলে। অথচ, শান্তি যাঁদের সাধনার ধন, সেই সাঁওতালদের, এবং শান্তির খোঁজে নিরন্তর দেশান্তরি তাঁদের প্রতিবেশী অন্য আদিবাসীদের, বার বার টেনে আনা হয় অশান্তি ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের ময়দানে। সামান্য তাঁদের চাহিদা: অ-ক্ষুধা ও অ-দমন, স্বাধীন জীবনযাপন।
ইতিহাস সাক্ষী, ঔপনিবেশিক শাসনের আগে পর্যন্ত এ-ভাবেই সাঁওতালরা— এবং মধ্য ভারতের বিস্তৃত ক্ষেত্রের আদিবাসীরা— জীবন কাটিয়ে আসছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসন ধ্বংস করল তাঁদের সমাজ সংগঠন ও ইতিহাস। কল্পনা করা হয়েছিল, ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তে আদিবাসীরাও ফিরে পাবেন আপন ইতিহাস গড়ার হক। কিন্তু তাঁদের স্বাধীন ইচ্ছার মূল্য দিতে গেলে ধনাঢ্যদের অবাধ ধনসঞ্চয়ে বাধা পড়ে। তাই, স্বাধীন দেশেও এক দিকে ঔপনিবেশিক শাসনে আদিবাসীদের উপর নামিয়ে আনা দুর্ভাগ্যের পাহাড়গুলো অক্ষত থাকে, অন্য দিকে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় দুর্ভাগ্যের বিপুল সমুদ্রের সামনে। উদাহরণ, যে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ওরাওঁ, মাহালি, কোল, কোড়া-সহ তৎকালীন সরকারি তালিকায় জনজাতি বলে চিহ্নিত কুড়মি-মাহাতদের নিয়ে গিয়ে ফেলা হল উত্তরবঙ্গ ও অসমের চা-বাগিচায়, অন্যত্র নির্মাণ-শ্রমিক বা কৃষি-শ্রমিক হিসাবে, স্বাধীনতার পরেও তাঁরা নির্দয় মজুরি-শ্রমিকের জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। অসমের মতো রাজ্যে, যেখানে কম-বেশি ত্রিশ লক্ষ এই রকম আদিবাসীর বাস, সেখানে তাঁদের ‘তফসিলি জনজাতি’ (এসটি) মর্যাদাও দেওয়া হল না। আদিবাসীরা সামান্য সাংবিধানিক সুযোগসুবিধা পেলে অবাধ ধনসঞ্চয়ে বাধা পড়বে যে! তার চেয়েও বড় কথা, এই মর্যাদা কেবল কিছু সুযোগসুবিধার ব্যাপার নয়, এর সংজ্ঞা যা-ই হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে ‘এস টি’ তালিকাভুক্তি হচ্ছে আদিবাসীর অভিজ্ঞান। আজ যে পশ্চিমাঞ্চলে কুড়মি-মাহাতরা এস টি তালিকাভুক্তির আন্দোলনে নেমেছেন, সেটা কেবল সংরক্ষণের মতো কিছু সুবিধার জন্য নয়, বরং একটা মতাদর্শগত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
ফিরতি দাবি
কুড়মালি ঝুমুরে আছে, “দিন গেলে দিন ঘুরি কে না আসে।” ঠিক কথা। কিন্তু দিন ঘুরে না এলেও, দিন তো আসে! ১৯৩০-এর দশকে কুড়মি-মাহাতরা তাঁদের ক্ষত্রিয়ত্বের পরিচিতিকে তুলে ধরে তৎকালীন ভারতে জনজাতীয়দের যে তালিকা ছিল তা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি করেন। এই দাবি ছিল তৎকালীন ভারতে জাতিকাঠামোর সঙ্গে মানবিক মর্যাদার যোগের কারণে। স্বাধীন ভারতে সেই যোগটা ছিন্ন না হলেও, সংবিধানে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের স্বার্থে কিছু ব্যবস্থার কারণে তাঁদের পক্ষে সামান্য মাত্রায় হলেও দেশের সামাজিক-প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় যোগদানের জায়গা তৈরি হয়। ফলে কুড়মি-মাহাতদের মতো জাতিগুলোর পূর্বতন দাবিটা তাঁদের পক্ষে হানিকর প্রমাণিত হল। তাঁরা না পারলেন জাতিকাঠামোর প্রকৃত ক্ষমতাবান অবস্থানে পৌঁছতে, না পেলেন চাকরি, শিক্ষা ও সংরক্ষণের সুযোগ। কিন্তু অন্য দিকে, তাঁদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। আলাদা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবির মতো আঞ্চলিকতা ও জাতিসত্তার জটিল মিশ্রণে জেগে ওঠা আন্দোলন এই আকাঙ্ক্ষাকে প্রসারিত করে তোলে। কুড়মি-মাহাতদের মধ্যে একটা ভিন্ন পরিচিতিসত্তা জাগ্রত হয়, সেটি হল নিজেদের জনজাতীয় উৎসের সন্ধান।
সাঁওতাল, মুন্ডা, হো প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁরা অধিক আত্মীয়তা খুঁজে পেলেন, সারনা ধর্মাচরণ, নিজেদের বৃহত্তর খেরোয়াল নৃগোষ্ঠীর অংশীদার দাবি করা, ঝুমুর গান থেকে শুরু করে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, কুড়মালি-ভাষিক পরিচিতি তুলে ধরা, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ১৯৮০-৯০’এর দশক জুড়ে কুড়মি-মাহাতরা অন্যান্য ঝাড়খণ্ডি জনজাতি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে একত্রে পথ হেঁটেছেন। পশুপতি মাহাতর মতো অগ্রণী নৃতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক জনবিন্যাসের অন্যতম পথিকৃৎ হার্বার্ট রিজ়লির বেশ কিছু পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর খেরোয়াল সমাজের ধারণাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। রিজ়লি সাঁওতাল ও কুড়মি জীবনযাত্রায় বিরাট মিল দেখেছিলেন। এটা ছিল একটা ভিন্নতর সংহতির প্রক্রিয়া, শ্রমজীবীদের মধ্যেকার ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক-সাংস্কৃতিক বিভাজনগুলোকে গৌণ করে তুলে এক অভিন্ন আঞ্চলিক-জাতিসত্তাগত পরিচিতি গড়ে তোলা, যা আবার কার্যত একটা শ্রমজীবী ঐক্যের রূপ নেয়।
২০০০ সালে কেবল বিহারের কয়েকটি জেলা নিয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হল। আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে আন্দোলন স্তিমিত হল। কিন্তু এই অঞ্চল ঐতিহাসিক ভাবেই নানা প্রতিবাদী উত্থানের সাক্ষী। গত পঞ্চাশ বছরে এই অঞ্চলটি অন্তত তিনটি বৃহৎ ও ব্যাপক গণ-সংগঠন ও বিক্ষোভে শামিল হয়েছে, শিকার হয়েছে প্রচণ্ড শাসকীয় অত্যাচারের: নকশাল আন্দোলন, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন ও লালগড় বিক্ষোভ। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক চৈতন্য জুড়ে আছে এক বিদ্রোহী সত্তা। এই সত্তাই পশ্চিমাংশে কুড়মি-মাহাতদের মধ্যে অসন্তোষকে আলো-বাতাস জোগায়। সেই বিক্ষোভকে আবার খানিকটা সমর্থন দেয় ঝাড়খণ্ড সরকারের একটি পদক্ষেপ— বিধানসভায় কুড়মি-মাহাতদের জনজাতি তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারটা অনুমোদিত করে নেওয়া, যদিও ভারত সরকার এখনও এটাকে স্বীকৃতি দেয়নি। না দেওয়ার বাহ্যিক যুক্তিটি হল, কুড়মি-মাহাতরা নৃবৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে জনজাতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। আসল যুক্তিটি সম্ভবত দেশের শাসনক্ষমতায় আসীন বিজেপি দলের উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, যেখানে ‘আদিবাসী’ ধারণাটাই তাদের কাছে বিপজ্জনক। তারা যে ভারতীয় অ-ভারতীয় ভাগটাতে বিশ্বাসী, তাতে আদিবাসী শ্রেণিকরণের জায়গা নেয় হিন্দু পরিচিতি। ফলে কুড়মি-মাহাতদের জনজাতি তালিকাভুক্তির দাবির মধ্যে নিহিত আদিবাসী পরিচিতির দাবিটাকে তারা ঠিকই পড়তে পেরেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৮ সালেই কুড়মি-মাহাতদের আদিবাসী পরিচিতির দাবি নিয়ে পদক্ষেপের আশ্বাস দিলেও কিছুই করেনি। এ-ছাড়াও শাসক দলের কিছু কাজকর্ম ও আচরণ কুড়মি-মাহাতদের বিক্ষোভে ইন্ধন জোগায়।
সংহতির চৈতন্যই সম্বল
শাসকীয় অহঙ্কার এই বিক্ষোভের মনোভূমিকে চিনতে পারে না, তার শিরায়-ধমনীতে আছে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার প্রশিক্ষণ। আর আছে ভাই-বোনেদের মধ্যে, আত্মীয়দের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া। আপাতত এটাই চলছে, এবং বিপজ্জনক ভাবে চলছে। ঝাড়খণ্ডে এক সাঁওতাল মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় কুড়মি-মাহাতদের জনজাতিভুক্তির দাবিতে প্রস্তাব পাশ করাতে পারেন, এবং সেখানকার সাঁওতালরা তাতে আতঙ্কিত বোধ করেন না; এ-রাজ্যেও কুড়মি-মাহাতদের আন্দোলন অর্ধ দশক ধরে চলতে থাকলেও সাঁওতালরা তা নিয়ে খুব একটা বিরূপতা দেখাননি, অথচ মাত্র কিছুকালের মধ্যে তাঁদের মধ্যে এত অসন্তোষ সৃষ্টি হল যে, তাঁরা কুড়মি-মাহাতদের দাবির বিরুদ্ধেনেমে পড়লেন!
ঘরপোড়ারা সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। এ-দেশে বার বার ঘর পুড়েছে, পুড়ে চলেছে। ঘরপোড়ারা জানে, আগুন নিজে নিজে লাগে না। শান্তির পরিক্রমায় জীবন কাটিয়ে দেওয়া সাঁওতাল ও তাঁদের তুতো ভাইবোন কুড়মি-মাহাতদের সংহত ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক চৈতন্য ঘরপোড়াদের এই সঞ্চিত ও চলমান অভিজ্ঞতার কথা স্মরণে রাখবেন— এই বিশ্বাসেই আমাদের নির্ভরতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy