Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
PMAY

দুর্নীতি, না কি তথ্যের ঘাটতি

বেশির ভাগ প্রকল্প পুরনো সমীক্ষা ও তথ্যের উপর কাজ করছে। ২০১১-র কাস্ট সেন্সাস বা ২০১৮-র কোনও সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে আবাস যোজনা চলছে।

 এমন লোক, যাঁর কাঁচা বাড়ি অথচ বিভিন্ন ভাবে রোজগার করেন, ভাল রোজগারও হচ্ছে, তিনি কি বাড়ি পাওয়ার যোগ্য?

এমন লোক, যাঁর কাঁচা বাড়ি অথচ বিভিন্ন ভাবে রোজগার করেন, ভাল রোজগারও হচ্ছে, তিনি কি বাড়ি পাওয়ার যোগ্য? ফাইল ছবি।

সন্দীপ মিত্র
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৭
Share: Save:

আবাস যোজনা নিয়ে রাজ্যের দিকে দিকে যে অশান্তি চলছে, তার কারণ কি নিছক রাজনীতি— ‘আমরা ওরা’ ভাগাভাগি, শাসক দলের অনুগতদের সুযোগ লাভ? না কি অন্য কিছু? একটা বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের দেশে গরিব কারা, তা নিরূপণ করতে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়। আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমা হল প্রতি দিন মাথাপিছু ১.৯ ডলার (অর্থাৎ কম-বেশি দেড়শো টাকা)— অর্থাৎ, যাঁর আয় এর চেয়ে কম, তাঁকে দরিদ্র বলে গণ্য করতে হবে। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতিতে এই হিসাব অনেক ক্ষেত্রেই গোলমেলে ঠেকে। এমন লোক, যাঁর কাঁচা বাড়ি অথচ মোটর সাইকেল আছে, দামি মোবাইল ফোন আছে, বিভিন্ন ভাবে রোজগার করেন (হয়তো অসংগঠিত ক্ষেত্রে), ভাল রোজগারও হচ্ছে, তিনি কি বাড়ি পাওয়ার যোগ্য? অন্য দিকে ধরা যাক, অতীতের কোনও সম্পন্ন মানুষের এখন অবস্থা খারাপ। জমিজায়গা সে রকম নেই, পাকা বাড়ি কিন্তু তা ভেঙে পড়ছে, রোজগার নেই— তাঁকে কী বলব? ধরা যাক, গ্রামের ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। যজমানের দৌলতে একটা বাড়ির অংশ পেয়েছেন। তাঁকে কী বলব?

এই সব নিখুঁত ভাবে করতে গেলে দরকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য। সমীক্ষার মাধ্যমে যদি সঠিক তথ্য উঠে আসে, তার ভিত্তিতে গরিব-বড়লোক বাছাই খানিকটা সম্ভব। সেখানেও গোলযোগ। কারা সমীক্ষা করছেন? যত্ন করে করছেন কি না? তাঁদের ঠিকমতো ট্রেনিং হয়েছে কি না? না কি অতি স্বল্প সময়ে প্রশাসনের জরুরি প্রয়োজনে নমো নমো করে একটা সমীক্ষা হল। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হল, কিছু উত্তর সমীক্ষক নিজের মন থেকে লিখে দিলেন!

বিপত্তি আরও আছে। অনেক সময় তথ্য চাইলে সাধারণ মানুষ জানতে চান যে, এর থেকে তাঁরা কী পাবেন। সেখানে গরিব সাজার প্রবণতা থাকে, রোজগার বা সম্পত্তি কম দেখানোর চেষ্টাও হয়। হাঁসের ঘর, গোয়াল ঘরকে বাসস্থান হিসাবে দেখানোর প্রবণতাও থাকে। যৌথ পরিবারকে আলাদা আলাদা দেখিয়ে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা হয়। সমীক্ষককে যে উত্তর দেওয়া হয়, তিনি তা-ই শুনতে বাধ্য। চ্যালেঞ্জ করার অধিকার তাঁর নেই। প্রশাসনের কর্তারা আবার তাড়াতাড়ি তথ্য জমা দেওয়ার দিকে নজর বেশি দেন।

ঢাল-তরোয়ালহীন ভাবেই সমীক্ষায় নেমে পড়তে হয়। বিডিও-দের কথা ধরা যাক। হাজার প্রকল্প, তার জন্য অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ, কিন্তু হাতে সর্বসাকুল্যে ক’জন মাত্র লোক। প্রয়োজনে প্রাথমিক শিক্ষকদের ধরা। সংগৃহীত তথ্যের মান যাচাই করার মতো দক্ষ কর্মী নেই। ফলে, যে তথ্য সংগ্রহ হল, তা-ই কোনও ক্রমে উপরে পাঠিয়ে তাঁরা পিঠ বাঁচাতে বাধ্য হন। এক-এক প্রকল্পে এক-এক রকম প্রয়োজন। তথ্যের পাহাড়। তথ্য বিভ্রাট তাই অস্বাভাবিক নয়।

প্রশ্ন এ বার, এই সব তথ্যভিত্তিক অরাজকতা দেখেও রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার চুপ থাকে কেন? কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য সংগ্রহ করার সংস্থাগুলি সাধারণত বছরের পর বছর সরকারের পূর্ব-নির্ধারিত চিরাচরিত সমীক্ষাগুলিই করে যায়। আবাস যোজনা বা বার্ধক্য ভাতা— এই সব প্রয়োজনে তাদের তথ্য সংগ্রহ করার অধিকার নেই। অথচ, এই সব সংস্থাতে (যেমন ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশন বা সেন্সাস সংস্থা) বা রাজ্য সরকারের সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ক দফতরে যথেষ্ট পারদর্শী কর্মচারী আছেন।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বেশির ভাগ প্রকল্প পুরনো সমীক্ষা ও তথ্যের উপর কাজ করছে। ২০১১-র কাস্ট সেন্সাস বা ২০১৮-র কোনও সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে আবাস যোজনা, বার্ধক্য ভাতা সব কিছুই চলছে। কোনও পরিবর্তন এই সব তথ্যভান্ডারে করা যায় না। কারণটা খানিকটা প্রযুক্তিগত, খানিকটা সরকারি ব্যবস্থায় দুর্বলতা।

উপায় কী? অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকার সোশ্যাল অডিট বা সমাজ-মানুষের দ্বারা স্বীকৃতি ঘটানোর পদ্ধতির কথা ভেবেছে। অন্ধ্রপ্রদেশ এই বিষয়ে পথ দেখিয়েছে। কিন্তু সেখানেও হাজারো প্রশ্ন, অল্প সময়। আর একটা ঝামেলা সেখানে আছে। যাঁরা প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের সবাইকে প্রশ্ন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সংখ্যাতত্ত্বে নমুনা সংগ্রহ করে অতি সহজে ও অল্প সময়ে সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। আজকাল স্যাটেলাইট তথ্য ব্যবহার করেও অনেক দেশে প্রকৃত গরিব চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। সরকার সীমিত ক্ষমতায় প্রয়োজনে এক-এক জায়গায় এক-এক বছর কোটা বেঁধে দিতে পারে পূর্ব-তথ্যের ভিত্তিতে। গ্রামের লোকেরাই তাঁদের গ্রামসভায় ঠিক করুন প্রায়োরিটি লিস্ট, সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক সোশ্যাল অডিট-এর কাজ চলুক। জনমানুষের সমক্ষে তা হলে চিত্রটা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy