Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Iran

তীব্র জেদে ঠাসা হাসি

এ ছবি তৈরির সাত বছর আগে সেই প্রদীপ আর জানলা নিয়ে শ্রীময়ী হাজির হয়েছিলেন কবির দেশে— ইরান। সঙ্গে ছিল আর এক জাদু-লন্ঠনের আলো: ইরানের চলচ্চিত্র।

iran.

—ফাইল চিত্র।

নীলাঞ্জন হাজরা
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৭
Share: Save:

আমি রাত্রির গভীর থেকে কথা বলি/ কথা বলি অন্ধকারের গভীর থেকে/ আর রাত্রির গভীর থেকে বলি/ যদি আমার বাড়িতে তুমি আসো, মেহেরবান, আমার জন্যে এনো প্রদীপ একটা/ আর একটা জানালাও এনো/ চেয়ে রইতে পারি যেন কলকলে আনন্দে ভরপুর রাস্তার পানে।— শ্রীময়ী সিংহের নন-ফিকশন চলচ্চিত্র বেহ্ কুচা-এ-খুশবখ্ত-এর (ছবি) উড়ান ‘উপহার’ কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তি থেকে: আনন্দময় পথের পানে (অ্যান্ড, টুওয়ার্ডস হ্যাপি অ্যালিজ়)। কবি: ফুরুঘ ফারোখজ়াদ— ১৯৬৭ সালে ৩২ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণের আগে যে নারী অপবাদে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে মাত্র শ’দেড়েক কবিতা লিখে ফারসি কবিতার ধারাটাকেই বদলে দিয়েছিলেন।

এ ছবি তৈরির সাত বছর আগে সেই প্রদীপ আর জানলা নিয়ে শ্রীময়ী হাজির হয়েছিলেন কবির দেশে— ইরান। সঙ্গে ছিল আর এক জাদু-লন্ঠনের আলো: ইরানের চলচ্চিত্র। সেই থেকে ছবিটি তৈরির আকুতিতে তিনি বারংবার হাজির হয়েছেন ইরানে।

কিন্তু কেন? ছবিতেই পরিচালক কবুল করেন গতানুগতিক সংবাদমাধ্যম ইরানের যে ছবি আমাদের মনে তৈরি করে ফুরুঘের কবিতা আর ইরানি চলচ্চিত্র তাঁর মনে সে ছবি ভেঙে দিয়েছিল। কোন ছবি? অকল্পনীয় অঙ্কের অর্থ এবং সামরিক শক্তির জোরে আমেরিকা সরকারের নেতৃত্বাধীন ‘গ্লোবাল নর্থ’ ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের যে ছবি বিশ্বব্যাপী কায়েম করেছে, দুনিয়ার তাবৎ মূলধারার গণমাধ্যম যার অনুগত, সেই ছবি— সারা দুনিয়ার দুষ্টচক্রের পালের গোদা ইরান। ‘গণতন্ত্র’ রফতানির অজুহাতে গ্লোবাল নর্থ-এর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধে যার অর্থনীতি জর্জরিত, উন্নয়ন স্তব্ধপ্রায়— নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া, ওষুধের আকাল, শিশুদের পথ্য বাড়ন্ত, পর্যটন পর্যুদস্ত।

ভালবাসার অদম্য টানে প্রোপাগান্ডা অগ্রাহ্য করে বারংবার ইরান সফরে শ্রীময়ীর প্রতি দিনের যে একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তারই নির্যাস আমরা দেখি সারা ছবি জুড়ে। কী দেখি? রাষ্ট্রীয় জাঁকজমক নয়, ভূগোল নয়, স্থাপত্য, জাদুঘর, চিত্রকলা, সুখাদ্য— যা কিছু ইরানে ‘পর্যটকের দ্রষ্টব্য’, তার কিচ্ছুটি নয়। কেবলই দেখতে থাকি হিন্দ থেকে আসা এক নবীন মুসাফিরের মুখোমুখি অনেক চেনা-অচেনা মানুষের মুখচ্ছবি। পাথুরে নয়— পর্দা জুড়ে অজস্র অভিব্যক্তিতে ভরপুর সে সব মুখের পেশির, গালের, কপালের ভাঁজ, চোখ। এবং প্রায় সততই তাঁরা মুখর— শ্রীময়ীর সঙ্গে কথোপকথনের সময় স্মৃতিচারণে, কবিতায় আর সঙ্গীতে।

সারাটা ছবি জুড়ে দেখি এক বিরল দক্ষিণ-দক্ষিণ কথোপকথন (সাউথ-সাউথ ডায়ালগ)। সে কথোপকথনে চাপা-দম্ভ-ঠাসা গণতন্ত্রের বুকনি নেই। ইরানের ধর্মীয় স্বৈরাচারী শাসনের দীর্ঘ ছায়া আছে, কিন্তু ‘আহা বেচারা অত্যাচারিত লোকগুলোর কী হবে’ নেই। একটি অনবদ্য দৃশ্যে এক অভিনেত্রীর অনেক চেষ্টায় অভিনয় করে দেখানো ছাড়া কোত্থাও উপচে পড়া চোখের জল নেই। প্রায় সারা ক্ষণ অজস্র রঙের হাসি আছে— যে হাসির কানায় কানায় ভরা আছে এক সাংঘাতিক জেদ— মানব না, মানছি না।

এই ‘মানছি না’ কখনও ফুটে ওঠে শাসনযন্ত্রের প্রতি ধারালো শ্লেষের হাসি-ঠাট্টায় চলচ্চিত্রকার মহম্মদ শিরওয়ানির সঙ্গে কথোপকথনে, কখনও হঠাৎ ক্যামেরায় ধরে রাখা এক নারীর হাড়-হিম-করা চিৎকারে। কণ্ঠরুদ্ধ, একাধিক বার কারারুদ্ধ পরিচালক জাফর পানাহি গাড়ি চালাতে চালাতে একেবারে আটপৌরে চলনে নিজের রাজনৈতিক চেতনার কথা, হতাশার কথা, সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার কথা বলতে বলতে উচ্চারণ করেন “কেন পালাব আমি, আমার দেশ ভাল লাগে আমার। আমি স্বদেশ হারাতে চাই না...”। তড়িৎ গতিতে আমরা পৌঁছে যাই অর্ধশতক আগে ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসনের কঠোর নীরবতায় মুখর কবি ফৈজ় আহমেদ ফৈজ়-এর সেই আশ্চর্য উচ্চারণে— সর ওহি হ্যায় তো আস্তাঁ হ্যায় ওহি / জান ওহি হ্যায় তো জান-এ-জাঁ হ্যায় ওহি। শির যদি সেই থাকে আস্তানাও সেই/ প্রাণ যদি সেই থাকে প্রাণাধিকও সেই। এর অভিঘাত লিখে বোঝানো অসম্ভব।

অসম্ভব বোঝানো, কী ভাবে সারা ছবি জুড়ে ইসলামি বিপ্লবের অনেক আগে লেখা ফুরুঘের কবিতায় ফিরে ফিরে গিয়ে ক্রমাগত তৈরি করা হয় এক ইঙ্গিত— এ ছবির মর্মের কথা— পুরুষতান্ত্রিক নির্দেশের বিরুদ্ধে ইরানি নারীর প্রতি দিনের রুখে দাঁড়ানো স্বর। আমেরিকানদের চাটুকার মহম্মদ রেজ়া শাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন হিজাব পরা। ইসলামি শাসনে দণ্ডনীয় হয়েছে হিজাব না পরা। রাজা বদলায়, শুধু পোশাকের রং বদলায়, ঢং বদলায়, দিন বদলায় না। এ ছবির কথোপকথন জুড়ে, দু’পক্ষেরই নিজের-কথা-বলতে-চাওয়া জুড়ে, সঙ্গীতের স্ফুরণের অভিঘাত। হয়তো বা তা কবিতায় ধরা যায়— জীবন জানতেই পারত না/ আমরা তার কাছে কী চাই/ যদি আমরা গান না গাইতাম (আফজ়ল আহমেদ সৈয়দ)।

ছবির কথোপকথন জুড়ে আছে নানা কিসিমের স্বৈরাচারী শাসনের পাথুরে দেওয়াল কুরে কুরে প্রতিনিয়ত বার করে আনা ছোট ছোট জয়ের আনন্দ। আনন্দে ভরপুর রাস্তার পানে আর শুধু তাকিয়ে নেই ইরানের মানুষ। সেই পথের পানে পা বাড়িয়েছেন। এক দিন সে পথ অবারিত হবেই। কেবল প্রশ্ন থেকে যায়, সে দিন আনার সুযোগ কি ইরানের মানুষকে দেবে বর্ণবিদ্বেষী, নব্য সাম্রাজ্যবাদী ‘গ্লোবাল নর্থ’? না কি গণতন্ত্রের বাহানায় ইরাক, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইনের মতো ইরানও এক দিন পড়ে থাকবে অরাজকতা আর ধ্বংসস্তূপের নীচে?

অন্য বিষয়গুলি:

Iran Society cinema
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy