—প্রতীকী ছবি।
ভারতের গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এখন বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ— বিশ্ব তালিকায় বর্তমান স্থান পঞ্চম; আগে আছে শুধু আমেরিকা, চিন, জাপান ও জার্মানি। সম্প্রতি ভারতের জনসংখ্যা চিনকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে অনুমান, অর্থাৎ ভারত এখন সর্বাধিক জনবহুল দেশও বটে। গত এক বছরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার (৭%) ছিল জি২০ দেশগুলির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, শুধুমাত্র সৌদি আরবের পিছনে। ২০২১ সালেও ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল জি২০ দেশগুলির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, শুধুমাত্র তুরস্কের পিছনে।
এই কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হতেই পারে যে, ভারতের অর্থনীতির হাল বেশ মজবুত এবং যাত্রাপথে গতির চিহ্ন প্রশ্নাতীতই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতেও ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রেকর্ড একদম প্রথম সারিতে। বাস্তব চিত্রটি কিন্তু অতটা সরল নয়। এটা জানা কথা যে, মোট জাতীয় আয়ের গতিবিধি থেকে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা বোঝা সোজা নয়। কারণ যে দেশে আর্থিক বৈষম্য বিপুল, সেখানে বেশির ভাগ মানুষের আয় বিন্দুমাত্র না বাড়লেও যদি শুধুমাত্র অতিধনীদের আয় বিপুল পরিমাণ বাড়ে, তা হলেও সার্বিক বৃদ্ধির হারকে বেশ ভালই দেখাবে। আর, মাথাপিছু আয় দেখলে ভারতের অবস্থান বিশ্ব তালিকায় ১৫০-র কাছাকাছি। শুধু তা-ই নয়, গত এক দশকের আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে একটা বিষয়— ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় আয় মাপার পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন করা হয়, যার ফলে ২০১১ সালের পরের বৃদ্ধির হার খানিকটা অতিরঞ্জিত। তবে, এই পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে এক বছরের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারে যতখানি ফারাক হয়, সেই ফারাক দশ বছরের গড় বৃদ্ধির হারে ততখানি হবে না। কারণ, তা করতে গেলে প্রতি বছরই অতিরঞ্জনের মাত্রা বাড়িয়ে যেতে হয়। সমালোচকরা সেই অভিযোগ করেননি।
এই প্রসঙ্গগুলো যদি আপাতত বাদও দিই, সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রটা প্রথম দর্শনে যতটা উজ্জ্বল মনে হচ্ছে, ততটা কিন্তু নয়। আজকের আলোচনায় শুধু জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের দিকে নজর দেব। ভারতের অর্থনীতি কি সত্যিই বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতহারে বর্ধনশীল দেশগুলোর একটি? প্রথমত, বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্যভান্ডারে যে দু’শোর বেশি দেশের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাদের সঙ্গে ভারতের তুলনা করলে দেখব, ২০২২ সালে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারে ভারতের অবস্থান ছিল ৩৩তম। ২০২১ সালেও চিত্রটি একই রকম— ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রায় ৯% হলেও বিশ্ব তালিকায় তার অবস্থান ছিল ৩০তম।
দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে অতিমারির কারণে সব দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগে, সে বছর সর্বত্রই জিডিপি বাড়ার বদলে কমেছিল। সেই সঙ্কোচনের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে অনেকটাই বেশি ছিল, তাই এই নিরিখে সেই বছরে ভারতের বিশ্ব তালিকায় অবস্থান ছিল ১৩১তম। তাই গত দুই বছরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ভারতের বৃদ্ধির হার আপেক্ষিক ভাবে ভাল হলেও, সাম্প্রতিক এই ইতিহাসটা না মনে রাখলে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। আমরা যদি বাৎসরিক বৃদ্ধির হার না হিসাব করে অতিমারির আগে ও পরে বৃদ্ধির হার হিসাব করি, তা হলে কিন্তু জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির নিরিখে ভারতের আপেক্ষিক অবস্থান অনেকটা ধাক্কা খাবে। যেমন, ২০১৯-২১ সালের মধ্যে হিসাবে করলে তিন বছরে ভারতের মোট বৃদ্ধির হার ৬.৬% (অর্থাৎ, গড়ে বছরে ২.২%) এবং বিশ্ব তালিকায় অবস্থান ৬৩। খারাপ নয়, তবে হইচই করার মতোও নয়।
বৃদ্ধির হার নিয়ে আলোচনায় কতকগুলো কথা মাথায় রাখতে হয়, না হলে প্রচারে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। প্রথমত, একটা দেশ যত সম্পন্ন হবে, তার বৃদ্ধির হার খানিকটা শ্লথ হতে বাধ্য। শতকরা হার গণনা করার পদ্ধতির মধ্যেই এই প্রবণতা নিহিত আছে। একে বলে বেস এফেক্ট বা ভিত্তি প্রভাব। যে ছাত্রী পরীক্ষায় একশোয় নব্বই পেয়েছে তার পক্ষে দশ শতাংশ নম্বর বাড়ানো, আর যে পঞ্চাশ পেয়েছে তার পক্ষে দশ শতাংশ নম্বর বাড়ানো এক কথা নয়। জি২০-র দেশগুলোর মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয় সবচেয়ে কম, তাই এই দেশগুলির মধ্যে তুলনা করলে তার আর্থিক বৃদ্ধির হার একদম উপরের দিকে থাকাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনও কারণে একটি দেশের জাতীয় আয় কমে যায়— অতিমারির মতো কোনও সঙ্কটের ফলে, বা বাণিজ্যচক্রের ওঠাপড়ায়— তবে ভিত্তি প্রভাবের কারণেই তার ঠিক পরে-পরেই বৃদ্ধির হার যান্ত্রিক ভাবে বেশি হবে, কারণ তা নিম্নতর ভিত্তি থেকে হিসাবে করা হচ্ছে। যে-হেতু অতিমারির সময় ভারতে সঙ্কোচনের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব বেশি ছিল, তাই তার পরের দু’বছরে তার বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার একটা বড় কারণ হৃত জমি পুনরুদ্ধার।
তৃতীয়ত, মোট জাতীয় আয় বা জনসংখ্যার দিক থেকে যে দেশগুলো ছোট, তাদের জাতীয় আয়ে শতকরা হিসাবে বছর বছর ওঠাপড়া বেশি হয়, কারণ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অল্প কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এবং যেখানে আন্তৰ্জাতিক পরিসরে যা কিছু হয় (যেমন, আমদানি বা রফতানি করা পণ্যের দামের ওঠাপড়া বা জাতীয় মুদ্রার বিনিময় হার), তার অভিঘাত বেশি হয়। বড় জাহাজের তুলনায় ছোট নৌকা ঢেউয়ে দোলা খায় বেশি। কাজেই, আয়বৃদ্ধির হারের তুলনায় সেই দেশগুলোকেও ধরলে যে ছবিটা পাওয়া যায়, তা যথাযথ না-ও হতে পারে। কেবল যদি বড় দেশের মধ্যে তুলনা করা হয়, তা হলে আয়বৃদ্ধির হিসাবে ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে? যে-যে দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অন্তত এক শতাংশ (ভারতের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১৮%), আমরা যদি শুধুমাত্র তাদের মধ্যে তুলনা করি, তা হলে তেমন কুড়িটি দেশের মধ্যে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারের নিরিখে ভারতের স্থান ছিল পাঁচ নম্বরে— তার আগে ছিল বাংলাদেশ, কঙ্গো, ফিলিপিনস, এবং ভিয়েতনাম।
তবে হ্যাঁ, পরীক্ষার নম্বরের উদাহরণই যদি ব্যবহার করি, তা হলে যারা কাছাকাছি নম্বর পেয়েছিল, তাদের মধ্যে তুলনা করলে যার নম্বরের বৃদ্ধির হার বেশি, সেখানে কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য। ভারতের মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে তুলনীয় দেশগুলোর মধ্যে যদি তুলনা করি, তা হলে যে গোটা ত্রিশ দেশ পাচ্ছি যাদের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় হয় ৫০% বেশি বা কম, তাদের মধ্যে ২০২২ সালে মোট জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের ভারতের অবস্থান হল চার নম্বরে (এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে আছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ)।
যদি ভারতেরই গত কয়েক দশকের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির তুলনা করি, তা হলেও কিন্তু মন্থরতার ছাপ স্পষ্ট। ১৯৯১-এর পরের তিন দশকে মোট জাতীয় আয়ের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.১৫%, তা কিন্তু দশক ধরে তুলনা করলে গত এক দশকে তা ছিল সবচেয়ে কম (৫.৭১%)। গত এক দশকের প্রথমার্ধে বৃদ্ধির হারও (৭.১%) তার পরের অর্ধের তুলনায় (৪.৫%) যথেষ্ট বেশি।
তাই, ভারতের বর্তমান বৃদ্ধির হারের রেকর্ড ভাল হলেও কিন্তু জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের দাবি করার সময় এখনও আসেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy