Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
নারীর অধিকারের জমিতে গণ্ডি কাটার অধিকারটা কি পুরুষেরই
Society

স্বাধীন মানেই স্বেচ্ছাচারী?

নারীবাদ এবং নারী-স্বাধীনতা সংক্রান্ত যে সব কথা চায়ের আড্ডায়, বা ট্রেনে-বাসে নিত্যযাত্রীদের কথোপকথনে উঠে আসে, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে এই আশঙ্কাগুলোই সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হয়।

প্রতীকী ছবি।

মল্লারিকা সিংহ রায়
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:০১
Share: Save:

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখোমুখি হয়ে শোনার সুযোগ হল— আজ়াদির অমৃত মহোৎসব উপলক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর নারী আন্দোলন বিষয়ক কথাবার্তা। অভিনব চিন্তাভাবনার কান্ডারি ছাত্র-ছাত্রীরাই তো আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। নারীর অধিকার নিয়ে নানা সংশয়ের নিরসন খুঁজছিলেন তাঁরা প্রশ্ন-উত্তর পর্বে। উত্তরের জোগান দিতে দিতেই বুঝতে পারছিলাম, একটা বাধা আসছে। আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবন যাপনে আমরা যে ভাবে ‘স্বাধীনতা’, ‘অধিকার’ আর ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ শব্দগুলোর অর্থকে ভাগ করে থাকি, তা-ই নিয়ে। অর্থাৎ, নারীর স্বাধীনতার অধিকার কখন, কী ভাবে নারীর স্বেচ্ছাচারিতা হয়ে যাবে, তা নিয়ে দেখলাম সদ্য-তরুণরা ভারী চিন্তিত। তাঁদের ভয়, মেয়েদের অধিকার স্বীকার করে নিলে মেয়েরা যা খুশি তা-ই করতে শুরু করবেন। শুনতে শুনতে মধ্যবয়সিনী আমিও চিন্তায় পড়লাম। সেই সত্যজিৎ রায়ের নায়ক ছবির সংলাপ মনে পড়ে গেল, “ভয়টা যে ঠিক কিসের ভয় তা বলা শক্ত।” মেয়েরা নিজেদের খুশিমতো কাজ করলে কেন যে সদ্য-তরুণের দল চিন্তিত হয়ে পড়বেন, সেটা ওঁদের কাছেও যে খুব স্পষ্ট, তা মনে হল না।

তরুণরা অবশ্য নানা উদাহরণ দিয়ে বেশ করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছিলেন। যেমন, মেয়েরা যদি পুরুষদের মতো সর্বসমক্ষে ধূমপান করতে শুরু করেন, বা হাতকাটা জামা পরে রাস্তায় দৌড়তে বার হন, তা হলে সেটা মোটেই সমাজের পক্ষে কল্যাণকর নয়। এ-ও বোঝা গেল যে, তাঁদের বিচারে নারী এবং পুরুষের বৈষম্য যদি না-ই থাকে, তা হলে যানবাহনে, ভিড়ের সময়েও, কেন মেয়েদের জন্যে সংরক্ষিত বসার জায়গা থাকবে, কেনই বা ‘রাশ আওয়ার’-এ মহিলা সংরক্ষিত ট্রেন চলবে? আর বিশেষ করে তাঁরা চিন্তিত যে, মেয়েরা অনেক সময়েই নারী-নির্যাতন বিরোধী আইনগুলির অন্যায় প্রয়োগ করে থাকেন পুরুষদের ‘ফাঁসানো’র জন্য। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নারীবাদ যে মেয়েদের এই সব উল্টো বুদ্ধি দিচ্ছে, সেই বিশ্বাসেরও আভাস দিলেন কয়েক জন।

বোঝা গেল, নারীবাদ এবং নারী-স্বাধীনতা সংক্রান্ত যে সব কথা চায়ের আড্ডায়, বা ট্রেনে-বাসে নিত্যযাত্রীদের কথোপকথনে উঠে আসে, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে এই আশঙ্কাগুলোই সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হয়। এই তরুণেরা বার বার বললেন, তাঁরা নারী-স্বাধীনতার বিপক্ষে নন, এঁরা নারীর উপার্জন করার অধিকারের বা শিক্ষার অধিকারের সপক্ষেই সওয়াল করছিলেন। কিন্তু, ওই যে, ভয়টা যে ঠিক কিসের সেটা ওঁরাও খুব ভাল করে জানেন না। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ট্রেন যে সংখ্যায় অত্যন্ত অল্প তা ওঁরা জানেন। যানবাহনে মেয়েরা যে বয়স-নির্বিশেষে যখন তখন যৌন হেনস্থার শিকার হন, তাও অস্বীকার করলেন না। প্রকাশ্যে ধূমপান বা রাস্তায় দৌড়নোও (যেমন খুশি পোশাক পরে) যে সমানাধিকারের প্রশ্নে মেনে না নিয়ে উপায় নেই, তা-ও নিমরাজি হয়ে মানলেন। সমস্যা কিঞ্চিৎ জটিল হল মেয়েদের নির্যাতন-বিরোধী আইন অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রে। তেমন ঘটনার সংখ্যা যে অত্যন্ত নগণ্য, বরঞ্চ নির্যাতনের পক্ষে প্রমাণ বেশি, সে পরিসংখ্যান খুব বেশি গুরুত্ব পেল না। কয়েক জন তরুণ তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ দিয়ে সেই ছবিকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেন। তাঁদের সহপাঠিনীরা এই খণ্ডনের চেষ্টার বিরোধিতা করলেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, পরিবারের অভ্যন্তরে চলা নানা কাহিনির অবতারণা করে জোর গলায় সওয়াল করলেন আইনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে।

কিন্তু আমার চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল। এই যে গত দশ বছর ধরে, দিল্লির সেই ভয়াবহ কাণ্ডের পর থেকেই রাস্তায় রাস্তায় এত আওয়াজ উঠল, ‘হাঁ বোলনে কি আজ়াদি/ না বোলনে কি আজ়াদি’ ‘বাপ সে ভি আজ়াদি/ খাপ সে ভি আজ়াদি’ ‘শাদি করনে কি আজ়াদি/ না করনে কি আজ়াদি’, সেই স্বাধীনতার অধিকারের ফল কি ফলেছে মেয়েদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে এই অনাবশ্যক আতঙ্কে?

তলিয়ে ভাবতে বসে কয়েকটা কথা মনে হল। এই আতঙ্ক আদতে এক ধরনের নারী-বিদ্বেষ, যা কিনা আমাদের দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে এমনই ভাবে জড়িয়ে আছে যে, আঙুল তুলে দেখিয়ে না দিলে তাকে ধরা মুশকিল। অনেক সময় যাঁরা এই বিদ্বেষ কথায়-কাজে ব্যবহার করছেন, তাঁরা খুব সচেতন ভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করার জন্য করছেন, এমনও নয়। নারী-বিদ্বেষটা এতই ‘স্বাভাবিক’ যে, মেয়েদের কেরিয়ার গড়ার বদলে ঘরে-বাইরে খেটে মরাটা চোখে লাগে না, যেন মেয়েদের চাকরিতে উন্নতি না করতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার বাইরে গেলেই নারী স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু কেন?

প্রথমত, নারীর স্ব-ইচ্ছা নিয়ে ভয়টা নতুন নয়। তাকে একটা গণ্ডির মধ্যে স্বাধীনতা দেওয়া গেলেও সেটি যেন কখনওই পৌরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে ছাপিয়ে না যায়, সেই প্রবণতা ঊনবিংশ শতক থেকে চলেছে। যখনই কথা উঠেছে নারীর নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেওয়ার অধিকারের, তখনই সমাজ জুড়ে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। নারীশিক্ষার অধিকার মেনেও, কোন বিষয় নারীর উপযোগী, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে দেশে-বিদেশে। সেই শিক্ষাকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে, নারীর শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়েও তার মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর প্রত্যেক বারই যে জুজুকে সামনে রেখে ভয় পাওয়ানো হয়েছে তা হল, নারীর স্বেচ্ছাচারিতার ভয়।

দ্বিতীয়ত, নারীর স্ব-ইচ্ছা যদি তাঁর দেহ এবং তাঁর বুদ্ধি (এ ক্ষেত্রে আমি বুদ্ধি বলতে মেধা, আজন্ম আহরিত সংস্কৃতি এবং আবেগ, সব কিছুকেই বোঝাতে চাইছি) দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তা হলে দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য স্থাপন করার কৌশল ব্যর্থ হয়ে যায়। নারীর দেহই নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু, এই ধারণার বাইরে বেরিয়ে মেয়েরা যদি দেহের স্বাধীনতাকে মনের স্বাধীনতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ আর প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, তা হলে পুরুষের প্রশ্নহীন অধিকারে টান পড়ে। আরও একটু এগিয়ে যদি নারীত্বের দেহগত চিহ্নগুলিকেই প্রশ্ন করা হয়? যদি বলা হতে থাকে যে চিহ্নগুলির যতটুকু শারীরিক উপযোগিতা তার থেকে একটুও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই? তা হলে পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের গোড়া ক্ষয়ে যেতে থাকে।

তৃতীয়ত, এই পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের ধারণার মধ্যে, তার দৈনন্দিন উদ্‌যাপনের মধ্যে যেটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে তা হল, পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ-প্রধান পরিবার ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে যে, পরিবার একটি ক্ষমতাতন্ত্র, তার ব্যবস্থাপনায় কেবল ব্যক্তি পুরুষ নয়, ব্যক্তি নারীও অংশীদার। পারিবারিক হিংসা সেই কারণেই এক অকথিত নীরবতার চুক্তির আড়ালে চাপা পড়তে থাকে। পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষ নারীকে একাধারে নারী হিংসার অংশীদার এবং হিংসার শিকার বানিয়ে চলতে পারে, কারণ এই ক্ষমতাতন্ত্র এক দিকে নারীর দেহ-বুদ্ধি, শ্রম-মনন, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, আর অন্য দিকে ক্ষমতার বিচারে উচ্চতর ‘অপর’-কে খুশি করার তাগিদ— এই দুয়ের মধ্যে বার বার বৈপরীত্য স্থাপন করে। কোনটি শ্রেয় তা গুলিয়ে দিতে থাকে।

এই গুলিয়ে-যাওয়া বাস্তবকে সোজা কথায়, সাদা-কালোয় উপস্থাপনার কঠিন কাজটাই নারীবাদকে করে যেতে হয়। কাজটা শক্ত সন্দেহ নেই, তবে স্বাধীনতার অধিকার বা ‘জান, জ়িন্দেগি, আজ়াদি’ কবেই বা আর সহজে এসেছে!

মানবীবিদ্যা চর্চা বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Society Women Independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy