—প্রতীকী চিত্র।
গত কয়েক বছর বাংলা ভাষা নিয়ে একটা উদ্বেগ মধ্যবয়স্ক বাঙালি মানসে দেখা দিচ্ছে, বলা ভাল মধ্যবিত্ত মানুষই এই উৎকণ্ঠার শিকার। তার দুটো দিক। প্রথমত আপন সন্তানটি যাতে দুধেভাতে থাকে সেই মনোবাঞ্ছায় নিজেরটিকে বাংলা ভাষা থেকে দূরে রাখা। সে-ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা। আর দ্বিতীয়ত নিজে যদি ভাষাজীবী হয়ে থাকি, নিজের ভবিষ্যৎ বাংলাভাষী দেশে কতটা সুরক্ষিত সে ভাবনায় মন দেওয়া।
এর বাইরে একটা বাংলা ছিল, আছে এবং থাকবে। বঙ্কিমচন্দ্র যে বলেছিলেন ‘তুমি আমি লইয়া কি দেশ’, সেটা এই দু’টি আশঙ্কায় তাই স্থান পায় না। সেই বাংলাটা কিন্তু বেড়েই চলেছে নিজের নিয়মে, কলকাতা হয়তো বা তোমাকেই ভুলে যাবে, পুরুলিয়া বলবে চলে এসো। এ কলকাতায় বাংলা কোথাও নেই ঠিক কথা, কিন্তু মেদিনীপুরে সমুদ্রের ধারে বাংলা পুস্তক-বিপণিও খুলছে। কথাটা তথ্যভিত্তিক, বাংলা ভাষার এই বিস্তারের কথা উঠে আসছে গবেষণাতেও। তবে এই দু’টি আশঙ্কার বাইরে একটা সত্যিকারের সংবর্তের ইশারা দেখা যাচ্ছে।
বাংলা ভাষা কেন এই সাধারণ ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে গেল, এ-পার বাংলায় তার সাংস্কৃতিক আর সামাজিক ইতিহাস-চর্চা নীহাররঞ্জন রায়ের মতো ইতিহাসবিদের লাঞ্ছনা থেকে পড়া যেতে পারে। উনি ইংরেজি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উঠিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। বাঙালির সার্বিক অবক্ষয় নিয়ে ওঁর অসামান্য লেখা আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাতায় ঠিক তেতাল্লিশ বছর আগে বেরিয়েছিল। সে লেখা আর্কাইভে স্থান পেয়েছে। এ কালের দুঃখ এ কালের মাপে ঢেঁকি-ছাঁটা। যার যেমন নজর। পাতা ঝরে কালের নিয়মে, সেটাই তার স্বাভাবিক গতি, তা নিয়ে ভাদ্র মাসে কান্নাকাটি করা চলে না। কিন্তু সংস্কৃতির পতন কালের নিয়ম নয়, তার যোগ বাজারের সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে, গোটা সমাজটার সঙ্গে। ধরা যাক মধ্যশ্রেণির ভাষাজীবী ‘ক’-বাবু ভাবছেন: বাংলার সব্বোনাশ হল, ভারতের সিংহাসনে সে ভাষাটি নাই— তিনি এক বারও ভাবতে পারছেন না, সিংহাসনই একমাত্র আসন নয়। মহাভারতে বলছে মৃত্তিকাই শ্রেষ্ঠ আসন। সেখানে কি পৌঁছনো গেল? না গেলে কেন গেল না? এটাই তো হওয়া উচিত আসল প্রশ্ন। তা হলে দুর্ভাগা দেশটার এত বীরের প্রয়োজন হত না।
এই না-পহঁছ’এর উৎকণ্ঠা যেখানে দেখা দিচ্ছে সেটাই প্রকৃত, বাকি সব নাকি কান্না সন্তানের সঙ্গে এই দেশেতে জন্ম নিয়ে ওই দেশেতে মরে যাবে (দীপেশ চক্রবর্তীর কথায়)। সে কাজ কিন্তু হচ্ছে। বাঙালির সেরা মননের মানুষ আজ বাংলা ভাষায় লেখার তাগিদ অনুভব করছেন। বাংলার সর্বভারতীয় প্রসারের কথা ভেবে এগিয়ে আসছেন। প্রবন্ধ চর্চায় দেখতে পাচ্ছি, রণজিৎ গুহর মতো ইতিহাসবিদ তাঁর শেষ জীবনের সমস্ত লেখা লিখলেন বাংলা ভাষায়। সুদীপ্ত কবিরাজের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পর পর লিখে চলেছেন বাংলা প্রবন্ধ। সুকান্ত চৌধুরীর প্রথম বড় বাংলা বইটি কোনও পূর্বপ্রকাশিত লেখার সঙ্কলন নয়, মৌলিক গবেষণা। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোপাল রাখাল দ্বন্দ্বসমাস অনুবাদ হল ইংরেজি ভাষায়। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর লেখা এবং আলোচনা গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে। শোভনলাল দত্তগুপ্ত মশাই গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাবেরমাস আর আলথুসের বাংলায় পড়িয়ে এলেন। ইউটিউবে সেটা দেখতে পাচ্ছে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজের রাজু মাহাতো। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জরুরি বই ট্রুথস অ্যান্ড লাইজ় অব ন্যাশনালিজ়ম একই সঙ্গে ইংরেজি আর বাংলায় বেরিয়ে গেল চোখের সামনে। স্বপন চক্রবর্তীর বাংলা লেখাগুলো নিয়ে কী অপূর্ব এক জানলার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে আমাদের বাঙালি ছেলেমেয়ের দল। ফল বললেই ফল ফলে না, গাছের নাম যদি আঙুর হয় তখন প্রাণীর নামও খেয়াল রাখা চাই।
গত কয়েক বছর আগে থেকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক একটি কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন। ঘটনা ঘটছে ধীর লয়ে, কিন্তু এর ফল অটাম্-এর সঙ্গে জুড়ে নেই। চিরকালের। বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সাহিত্যকাজগুলি যোগ্য মানুষের হাতে বিলিতি ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। কবি শঙ্খ ঘোষ এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। আবার সিগাল পাবলিশিং হাউস অরুণাভ সিংহর অনুবাদে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন, স্পিভাকের অনুবাদে বেরিয়েছে মহাশ্বেতা দেবী। কবি জয় গোস্বামীর গোটা একটি বাংলা কবিতাবই সূর্য পোড়া ছাই আর একটি সঙ্কলন সম্পূর্ণা চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন হার্পার কলিন্স প্রকাশনা থেকে। তাই একই সঙ্গে জাতীয় স্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা লেখা এবং বাংলায় লেখার কাজ বরং এখনই আশাপ্রদ ভাবে শুরু হয়েছে। দিল্লি থেকে বিদেশের প্লেনের টিকিট এল বা এল না, এটা আমাদের না ভাবলেও চলে। ভাষা-পুলিশের হাতে না দিয়ে ভালবাসার উপর ভাষাকে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। নইলে বাঙালি কলকাতাবাসী অনেক ভদ্রজনকে উকিল নিয়ে থানায় ছুটতে হবে, সন্তানের ‘বেল’ পাওয়ার জন্য।
স্বকীয়তা বড় প্রয়োজনের জিনিস। আর প্রয়োজনের জিনিস সময়ের সম্পূর্ণ জ্ঞান। নুহ-মণিপুর-কলকাতা-গুজরাত-ইউক্রেনে যা ঘটছে তা নিয়ে লিখব না নীরব থাকব সেটা শিল্পীর নিজস্ব ভাবনা। তার সঙ্গে ধ্রুপদ খেয়ালের কোনও সংস্রব নেই। কিন্তু যা লিখব নিজের ভাবনায় নিজের প্রকাশ ভঙ্গিতে লিখলে তবেই সে লেখা আলোচনার যোগ্য হবে। নইলে সংস্কৃতে যাকে বলে চিত্রকাব্য, মানে ‘লেখার-মতো’ জিনিস ‘প্রায়-লেখা’— সেটাই হয়ে যাবে। তা আবার চার দিকে ছড়িয়ে পড়লে সমস্যা।
এই পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয়তেই এ বছরের পয়লা জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। ‘প্রথম দিনের সূর্য’। তাতে পড়তে পাচ্ছি— “খামাজের আরোহণে রেখাব লাগে না। এ রকম অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কোনও রাগ কি আছে যেখানে ‘সা’ বর্জিত স্বর? রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে সেই ‘সা’। এই ‘সা’ যেন আমার জীবনকে ছেড়ে না যায়।” আর গত ১৫ সেপ্টেম্বর এই পত্রিকায় প্রকাশিত উত্তর-সম্পাদকীয়তে শেষ চার লাইনে লেখক লিখছেন: “তার পরেও একটা জিনিস লাগে। ‘সা’।... বহু লেখক ‘সা’ লাগাতে পারেন না। ‘সা’ সবার কাছে আসে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এসেছিল।” কবি রামপ্রসাদ মায়ের কাছে তবিলদারি চেয়েছিলেন, কিন্তু তহবিল তছরুপের মামলায় বাঙালি সাহিত্যজীবীকে ফাঁসানো মুশকিল। গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।
বাংলা ভাষা নিয়ে ‘কী-করি কী-হল দশা’র কথা আমাদের সবার ভাবা দরকার তা সন্দেহাতীত। একই সঙ্গে ভাষা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কী করে যুঝব তার কিছু স্পষ্ট চিন্তাও অবশ্য দরকার। আর সে-দরকারে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সমঝোতার বড় প্রয়োজন আছে। এবং দরকার ভারতীয় ভাষা সাহিত্যের স্পষ্ট বিচার। ভাষা-সাহিত্য নিশ্চয়ই শক্তিক্ষেত্র রচনা করে। কিন্তু তাই বলে ভারতের মতো দেশে ভাষা-সাহিত্যকে ঠিক রেসের মাঠ ভাবা অপরাধ। কে এগোল কে পিছোল বিচার করার আধুনিকতা আমরা ছেড়ে এসেছি। এখন সাহিত্য অকাদেমির মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ হওয়া উচিত ভাষা-সাহিত্যকে মানবিক ভাবে প্রয়োগ করা। সে কাজ একদা হয়েছে মণিপুরে উত্তর-পূর্ব ভারতে, রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের হাতে। যে কাজে শঙ্খ ঘোষ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল।
ঐতিহ্যের বিস্তার এখনও হল না। শুধু প্রাধান্যের বোধ দিয়ে ভাষাকে ছোঁয়া অসম্ভব। তার থেকে ভাল, আমরা বরং হতাশা কাটিয়ে যে যার কাজ সমান মূল্যে মন দিয়ে করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy