—প্রতীকী ছবি।
দক্ষিণ কলকাতার এক নামী মেয়েদের কলেজের একটি মেয়ে জানাল, সে এই কলেজে ভর্তি হয়েছে, কারণ এখানে ইউনিয়ন নেই। হয়তো বাড়িতে শুনেছে, হয়তো নিজেই ভেবে নিয়েছে যে, ছাত্র সংগঠন বস্তুটি বিপজ্জনক। রাজনীতিই ঘোর ‘ডেঞ্জারাস’। সে একা নয়, তার মতো আরও অনেক ছেলেমেয়েকে দেখি, রাজনীতির কথা ওঠামাত্র জানিয়ে দেয়, সে বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যারা সমাজবিজ্ঞানের কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে, তারাও। রাজনৈতিক স্থানাঙ্ক ছাড়া, সামাজিক স্থানাঙ্ক ছাড়া, ধর্মীয় স্থানাঙ্ক ছাড়া অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান ইতিহাস যে পড়াই সম্ভব নয়, এ কথাটা ওদের আমরা বোঝাতে পারিনি, শিক্ষক হিসাবে, অভিভাবক হিসাবে, ওদের অগ্রজ হিসাবে এ কি আমাদেরই ব্যর্থতা নয়?
রাজনীতির যে প্রশ্ন প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাব ফেলে ওদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে, সে বিষয়েও কি একই রকম চর্চিত উদাসীনতা ওদের? নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে যখন দেশব্যাপী আলোচনা চলছে, এক দিন ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলাম, সে বিষয়ে কার কী মত, কে পক্ষে আর কে বিপক্ষে সেই নীতির? দেখা গেল, মুখ খোলে না প্রায় কেউই, দু’এক জন ছাড়া। কেন, অনেক ভাবে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল, তারা কেউই এ নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবেনি, ফলে কোনও মতামতও নেই তাদের। পাঠ্যক্রম থেকে কী কী বাদ পড়ে যাচ্ছে, কেমন ভাবে সেই ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া পাল্টে দিতে চায় ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্রকেই, কিছু নিয়েই তাদের উদ্বেগ নেই। বস্তুত, ঠিক কী হচ্ছে, সে ধারণাও নেই। এক জন শুধু জানাল, “শুনছি নাকি ইন্টার্নশিপ চালু হবে।” তার পর কথা গড়াল খবরের কাগজ পড়ার দিকে। জানা গেল, কয়েক জন কলেজে আসার পথে অনলাইনে সংবাদ শিরোনামটুকু দেখে নেয়। বড় জোর দু’এক জন বলতে পারে সাম্প্রতিক কোনও খবরের কথা, তার গুরুত্বের কথা।
এ শুধু একটা কলেজের গল্প নয়। গোটা রাজ্যে, গোটা দেশে বেশির ভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিই এই রকম। একটা বুদ্বুদের মধ্যে থাকা যেন— সমসময়ের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে চুপ করে, কোনও যোগদান না করে থাকা। এ ভাবে থাকতে থাকতে মানুষের মননের স্পর্শকাতরতা, অনুভবের ক্ষমতা কমে যায়, তখন আর মনে কোনও প্রভাব পড়ে না পারিপার্শ্বিকের। দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্যমূলক সমাজ প্রসঙ্গে প্রথম এই গবেষণা করেন জোসেফ ওলফে। এই ভাবে ছোঁয়া বাঁচিয়ে থাকতে ভারী আরাম— বালিতে মুখ গুঁজে থাকা উটপাখির মতোই।
সম্প্রতি ২২ জানুয়ারি খুব চেনা খুব ভালবাসা এই মুখগুলোকে অন্য ভাবে দেখলাম। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে, ফেসবুক দেওয়ালে ফুটে উঠছে নানা রকম মত। ২১ তারিখ রাত্রি, পুরো ২২ তারিখ, কিছুটা ২৩ তারিখও কেউ দিতে থাকে প্রদীপের ছবি, কেউ নতুন তৈরি হওয়া মূর্তির, কেউ বা মন্দিরের। প্রথমে একটু অবাক লাগে— যারা ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে, রাজনীতি সম্পর্কে সমাজ সম্পর্কে একেবারে চিন্তিত নয়, ওয়াকিবহালও নয়, তাদের কী হল? কিছু ক্ষণ পরেই দেখি, প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে মতবিরোধ— এক জন যদি বাহবা দেয়, অন্য জন প্রতিযুক্তি দেয়।
তা হলে কি এত দিনের নিস্পৃহতা কাটিয়ে সচেতন হল ওরা? কিন্তু এ কি সত্যিই সমাজ সচেতন হওয়া? ধর্মের বোধ জাগ্রত হওয়া? ভারতের আত্মাকে বুকে রেখে রাজনীতি সচেতন হওয়া? না কি, অপ্রিয় সব সত্য, সব বিভেদের সত্য, ভালবাসার সত্যকে দূরে সরিয়ে রেখে জানতে না দিয়ে আবারও উটপাখি হতে সাহায্য করা? তিন খান পদবিযুক্ত অভিনেতাকে কেন নিমন্ত্রণ করা হয়নি, কেন এক বিশেষ হিন্দু অভিনেতাকে ভিন্নধর্মী বিদেশি অভিনেত্রীকে বিয়ে করা, হয়তো ধর্মান্তরিত করার কৃতিত্বে নিমন্ত্রিত করা হয়েছে, এই সংক্রান্ত কুরুচিকর আলোচনা বাড়ির ড্রইংরুমে, চায়ের দোকানে করে তাদের মনটা আরও বিষিয়ে দিচ্ছি না? একটি পরিচিত মেয়ে সমাজমাধ্যমেই লিখল, “আজ কে কী লিখছে, কে সমর্থন করছে না, তা দেখলেই বোঝা যায় কে আসলে দেশপ্রেমী।” মনে হল, যেন এক আত্মজা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে আর এক জনের বিরুদ্ধে— অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো দেখছি আমরা।
এই ছাত্রীদের নিয়েই দু’দিন পরে পালন করলাম প্রজাতন্ত্র দিবস। এদের হাসিমুখ দোদুল্যমান ৭৫ বছর বয়সি প্রজাতন্ত্রের ভরসাস্থল। আধা ইংরেজি আধা বাংলায় এরা প্রজাতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব বোঝাল। ভুল করে প্রজাতন্ত্র দিবসকে স্বাধীনতা দিবস বলে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
ওদের মন থেকে রাজনীতির বোধ মুছে দিয়ে— বস্তুত, সে বোধ কখনও তৈরিই হতে না দিয়ে— আমরা সেখানে লিখে দিলাম ঘৃণার সহজ পাঠ। বিদ্বেষের বর্ণপরিচয়। অভিভাবক হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে, গুরুজন হিসাবে ক্রমাগত শিখিয়ে গেলাম অন্যদের ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট না করে আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার মন্ত্র। এখন বুঝি, উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা। এই ধ্বংসের দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy