নির্বাচনের উত্তাপে একটি সাম্প্রতিক খবর ততটা গুরুত্ব পায়নি— ফেব্রুয়ারির শেষে জাতীয় আয়ের যে আগাম হিসেব পেশ করা হয় জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর থেকে, তাতে জানা যাচ্ছে যে, গত এক বছরে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার -৮%। ধারণা হিসেবে, ঋণাত্মক বৃদ্ধি খানিকটা ট্রেনে-বাসে ‘পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়া’-র মতো। জাতীয় আয় বাড়ার বদলে কমছে, এই কথাটা বোঝাতে ঋণাত্মক বৃদ্ধির পরিবর্তে জাতীয় আয়ের হ্রাস বা সঙ্কোচনের হার বলাই ভাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারতে জাতীয় আয় কমেছে মাত্র চার বার— ১৯৫৭, ১৯৬৫, ১৯৭২ এবং ১৯৭৯ সালে। এর মধ্যে হ্রাসের হার সর্বাধিক ছিল ১৯৭৯-তে (৫.২%), যখন দেশব্যাপী খরার দরুন এবং ইরানে বিপ্লবের ফলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় অর্থনীতির হাল বেশ টলোমলো হয়ে দাঁড়ায়।
এ কথা ঠিকই যে, শতাব্দীব্যাপী সময়সীমায় সবচেয়ে বিপজ্জনক অতিমারির প্রত্যক্ষ প্রভাব ও তার মোকাবিলা করাতে যে পদক্ষেপই করা হোক না কেন, অর্থনীতির উপর তার প্রভাব মন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। সব দেশেই গণস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি— দুই দিক থেকেই বড় ধাক্কা লেগেছে। ভারতের আপেক্ষিক অবস্থা কী, অন্য দেশগুলির তুলনায়?
জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক-এর সংযোজিত সংস্করণ এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের গ্লোবাল ইকনমিক প্রস্পেক্টস। দু’টি রিপোর্টই দেখাচ্ছে যে, সব দেশের অর্থনীতিতেই বড় ধাক্কা লেগেছে, কিন্তু তার মধ্যেও ধাক্কার তীব্রতায় ভারতের স্থান উপরের দিকে— সারা বিশ্বের তুলনায় এবং আর্থিক উন্নয়নের নিরিখে সমগোত্রীয় দেশগুলির তুলনায়। যেমন, আইএমএফ-এর রিপোর্টটি দেখাচ্ছে, গোটা বিশ্বে জাতীয় আয় হ্রাসের গড় হার হল ৩.৫%, উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে তা হল ৫%, কিন্তু অনুন্নত দেশগুলির গড় হল ২.৪%। আগেই বলেছি ভারতের ক্ষেত্রে জাতীয় আয় হ্রাসের হার হল ৮%। এই রিপোর্টে উল্লিখিত অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ফিলিপিন্স আর মেক্সিকোয় জাতীয় আয় হ্রাসের হার ভারতের
থেকে বেশি। অর্থাৎ, সব দেশেই এই অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আপেক্ষিক ভাবে দেখলেও ভারতের ক্ষেত্রে তা হয়েছে বেশি মাত্রায়।
এটা ঠিকই যে, এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের জন্য যে আনুমানিক হিসেব পাওয়া যাচ্ছে এই দু’টি রিপোর্টে, তাতে খানিক আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে যে, এই ধাক্কাটা খানিকটা সামলে উঠবে সব দেশই, আর গণনায় দেখা যাচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে এই পুনরুদ্ধারের হার অন্য দেশের তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু যে হেতু প্রাথমিক ধাক্কাটা বেশি লেগেছিল বেশি, তাই পুনরুদ্ধারের হারও বেশি হবে— যে অসুস্থ হয় বেশি, অসুস্থ অবস্থার তুলনায় আগের অবস্থার কাছাকাছি ফিরলেই তার স্বাস্থ্যোন্নতির হার বেশি দেখাবে। কিন্তু অতিমারির আগে ভারতের বৃদ্ধির হার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে যা ছিল, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরে সেই জমি ফিরে পেতে আরও সময় লাগবে।
জাতীয় আয় দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের একটা মাপকাঠি মাত্র, এবং সেটা ব্যবহার করার অনেক সমস্যা। তার কিছু সমস্যা সর্বজনীন— যেমন, যদি আয় এবং সম্পদের বণ্টনে অনেকটা অসাম্য থাকে, তবে গড় বা সামগ্রিক আয় দিয়ে দেশের দরিদ্রতর শ্রেণির মানুষদের অবস্থা সচরাচর ঠিকমতো ধরা পড়ে না। তাই গড়ে ৮% হ্রাস মানে এমন নয় যে, সবার আয় ৮% হ্রাস পেয়েছে— বরং এই সময়েও বিত্তবান শ্রেণির অনেকের আয় ও বিত্ত বেড়েছে। যাঁদের বাঁধা মাইনে, তাঁদেরও আয় হ্রাস পায়নি। ভারতের মতো আর্থিক ভাবে অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি আরও বেশি, কারণ ভারতের অর্থনীতিতে যে অসংগঠিত ক্ষেত্র, তা জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধেক। আর আমাদের সামগ্রিক যে শ্রমশক্তি, তার প্রায় ৮০% এই ক্ষেত্রে নিয়োজিত এবং অনুমান করা শক্ত নয় যে, এঁরা আপেক্ষিক ভাবে দরিদ্রতর। জাতীয় আয় যে ভাবে গণনা করা হয়, তাতে এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান অনেকটাই আন্দাজের ভিত্তিতে করা হয়। তাই, ঠিক বলা মুশকিল আসলে জাতীয় আয় কতটা কমেছে এবং দরিদ্রতর শ্রেণির উপরে অতিমারির আর্থিক অভিঘাত কতটা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে অনেকগুলো সমীক্ষা করা হয় অতিমারি ঘোষিত হওয়ার পরবর্তী সময় ধরে। তার থেকে যে সাধারণ ছবিটা উঠে আসছে, তা হল— জাতীয় আয়ের হ্রাসের হারের থেকে এই দরিদ্রতর শ্রেণির মানুষদের আয় কমেছে অনেকটা বেশি। অথচ, সামাজিক নিরাপত্তামূলক যে নানা প্রকল্প আছে, তাতে এই পর্যায়ে অতিরিক্ত সরকারি অনুদান অন্যান্য দেশের তুলনায় সামগ্রিক সরকারি ব্যয় বা জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে ভারতে তুলনায় কম শুধু নয়, আরও দুশ্চিন্তার কথা হল, এই রকম প্রকল্পগুলোতে এ বারের বাজেটে সরকারি যে বরাদ্দ, মূল্যবৃদ্ধির হারকে হিসেবের মধ্যে ধরলে, তার প্রকৃত পরিমাণ কমেছে বই বাড়েনি।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা কোভিড-১৯’পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের সরকার লোকজনের চলাফেরা থেকে শুরু করে স্বাভাবিক সময়ের জীবনযাপনের উপর কী কী কড়াকড়ি বা বিধিনিষেধ জারি করেছে, তার একটা মাপকাঠি প্রকাশ করেছেন, যাকে স্ট্রিনজেন্সি ইনডেক্স বা কঠোরতার সূচক বলে উল্লেখ করা হয়। এই মাপকাঠিতে দেখলে, এখন খানিকটা শিথিল হলেও সঙ্কটের প্রথম পর্যায়ে অন্য নানা দেশের তুলনায় ভারত একদম উপরের দিকে ছিল। এই কড়াকড়ির সঙ্গে যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধাক্কার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, তা অনুমান করা শক্ত নয়। এখন প্রশ্ন হল, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, এই কড়াকড়ির ফলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যতটা বিপর্যয় হতে পারত, তা কি এড়ানো গিয়েছে?
কোভিড-১৯’এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সর্বত্র, তার প্রাথমিক সূচক হিসেবে আমরা মোট জনসংখ্যার কত অংশ
এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, এবং এই রোগের কারণে মৃত্যুর হার কত, তার পরিসংখ্যান দেখতে পারি। এখানে যে ছবিটা বেরোচ্ছে সেটা খানিকটা ভাল-মন্দ মেশানো।
এই সঙ্কট শুরু হওয়ার পর প্রথম ছ’মাস অবধি এই রোগের সংক্রমণ যে ভাবে ছড়াচ্ছিল, এবং তার ফলে মৃত্যুর হার যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তা বেশ আশঙ্কাজনক ছিল। তখন ভারতের অবস্থা অন্য দেশগুলোর তুলনায় এই দুই মাপকাঠিতে আপেক্ষিক ভাবেও একেবারেই খুব একটা ভাল জায়গায় ছিল না— সে উন্নত দেশই হোক, বা তুলনীয় উন্নয়নশীল দেশ। তাই বিধিনিষেধের বজ্রআঁটুনি এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও যে উদ্দেশ্যে সেগুলো করা, সেখানেও খুব একটা ভাল ফল পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, সৌভাগ্যক্রমে তার পরের পর্যায়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশ খানিকটা কমেছে, আর তার ফলে এই রোগের প্রকোপ বোঝার জন্যে যে দু’টি মাপকাঠির কথা বলেছি, তাদের নিরিখে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের আপেক্ষিক অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এখনও ভারতের আপেক্ষিক অবস্থান মাঝারি বলা যায়। এবং, আশঙ্কার কথা হল, কোভিড-১৯’এর দ্বিতীয় প্রবাহের ফলে সংক্রমণের হার ফের ঊর্ধ্বগামী হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই রোগের সংক্রমণ যতটা মারাত্মক হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততখানি হয়নি কেন, সেই বিষয়ে মহামারিবিদরা নিশ্চিত নন। ভৌগোলিক, আবহাওয়াগত, জীবতাত্ত্বিক, এবং জনবিন্যাসের ধরন— এই ধরনের অনেক রকম কারণের কথা উঠছে, যদিও গবেষণাভিত্তিক প্রমাণ এখনও আয়ত্ত নয়। যেমন, উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা
যেতে পারে যে, ভারতে জনসংখ্যার গড় বয়স আপেক্ষিক ভাবে কম আর এই রোগের প্রভাব বয়স্ক মানুষদের উপরে বেশি; জনসংখ্যার একটা বড় অংশ গ্রামবাসী, যেখানে সংক্রমণের সম্ভাবনা নগরাঞ্চলের তুলনায় কম।
শুধু তা-ই নয়, জাতীয় আয়ের হ্রাসের হার যেমন সাধারণ মানুষের উপর এই অতিমারির অর্থনৈতিক অভিঘাত পুরোপুরি ধরতে পারে না, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা খানিকটা একই রকম। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, কোভিড-১৯ বাদ দিলেও অন্যান্য নানা রোগে গত এক বছরে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, যার পিছনে আছে অতিমারি এবং তজ্জনিত সরকারি বাধানিষেধের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নানা রকম ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া।
এ বিষয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই যে, এই অতিমারি অভূতপূর্ব এবং সারা বিশ্ব জুড়ে ধনেপ্রাণে তার আঘাত সামলে উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে যতটা বজ্র-আঁটুনি দিয়ে তার মোকাবিলা করা হয়েছে, তা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে— আর্থিক দিক থেকেই হোক বা জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে— তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy