Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
“মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখননি...”
IIT Bombay

অন্ধকার ক্রমে আসিতেছে

ভারতীয় রামায়ণী কথার বহুজীবনস্পর্শী স্রোতধারাটি যুগে যুগে মৌলবাদীদের আন্তরিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শত চেষ্টা সত্ত্বেও থেকে গিয়েছে বহুবর্ণী।

—প্রতীকী ছবি।

স্বাগতম দাস
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৪ ০৮:২৯
Share: Save:

‘‘এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু

ছেলেমানুষ থেকে গেল

কিছুতেই বড় হতে চায় না

এখনো বুঝলো না যে ...

ঈশ্বর নামে কোনো বড়বাবু এই বিশ্বসংসার

চালাচ্ছেন না

ধর্মগুলো সব রূপকথা

যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে

তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির

কান্না শুনতে পায় না”

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে’,

সুন্দরের মন খারাপ, মাধুর্যের জ্বর

কবি সৌভাগ্যবান, এ সব লেখার পরও তাঁকে জেলে যেতে হয়নি, জরিমানাও হয়নি তাঁর— মানুষের ‘ভাবাবেগ’ কিছু দিন আগেও আজকের মতো এত আঘাতপ্রবণ ছিল না বলেই হয়তো। তবে, মানুষ এখনও ছেলেমানুষই থেকে গিয়েছে। আর, ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে সেটা ভারী সুবিধার। ‘ছেলেমানুষ’ বলেই দেশাত্মবোধের মোড়কে উগ্র ধর্মীয় মেরুকরণ, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বহুত্বের প্রতি অনাস্থা এবং একমাত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রতি ঝোঁক দিয়ে আমাদের কয়েদ করে রাখা যায় বোধশূন্যতার অন্ধকারে, সে আমরা সমাজের যে স্তরেই থাকি বা যত শিক্ষিতই হই না কেন।

সবচেয়ে ভয়ানক বোধ হয় সমাজের শিক্ষিততম অংশ ও প্রতিষ্ঠানগুলির এই অন্ধকারে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাওয়া। সম্প্রতি আইআইটি বম্বে স্নাতক স্তরের একাধিক ছাত্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ঘোষণা করল। এক ছাত্রের উপরে ধার্য করা জরিমানার পরিমাণ লাখ টাকার বেশি। ছাত্রদের অপরাধ— তাঁরা সেই প্রতিষ্ঠানের পারফর্মিং আর্ট ফেস্টিভ্যালে রাহবাণ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন গত ৩১ মার্চ। নাটকটি রামায়ণের একটি ‘নারীবাদী’ ব্যাখ্যার উপরে নির্মিত, যেখানে চরিত্রের নাম এবং কাহিনি পরিবর্তিত হয়েছে। সেই নাটকে দর্শকরা আপত্তি করেননি, বিচারকরাও না। আপত্তি করেছেন ছাত্রদের একটি কট্টরপন্থী অংশ, যার ভিত্তিতে আইআইটি কর্তৃপক্ষ গত দু’মাস ধরে রীতিমতো তদন্ত চালিয়েছেন পুরো বিষয়টা নিয়ে। সত্যিই তো, ভারতীয় বিজ্ঞানের চূড়ান্ত উৎকর্ষ যেখানে কিছু লেন্স সাজিয়ে রামলালার কপালে সূর্যতিলক ফেলা, সেখানে এ রকম তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত সময় যে কর্তৃপক্ষের থাকবে, তাতে সন্দেহ কী!

ভারতীয় রামায়ণী কথার বহুজীবনস্পর্শী স্রোতধারাটি যুগে যুগে মৌলবাদীদের আন্তরিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শত চেষ্টা সত্ত্বেও থেকে গিয়েছে বহুবর্ণী। ভারতের প্রদেশ, জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার রং লেগে আছে তার পরতে পরতে। তাই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রামায়ণের বহু বিকল্প ভাষ্য তৈরি হয়েছে— যুগপৎ সনাতনী এবং লোকায়ত আঙ্গিকে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এ কে রামানুজন তাঁর কর্মজীবনে এ রকম তিনশোটি রামায়ণের হদিস দিয়েছিলেন, যার মধ্যে সংস্কৃত ভাষাতেই রয়েছে ২৫টি। এ কথা বহু-আলোচিত, তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররাও যখন তা মনে রাখতে পারেন না, তখন জনসমক্ষে কথাগুলো আবারও বলার প্রয়োজন আছে বইকি।

আসলে মহাকাব্যে মহিলাদের স্থান সাধারণত গৌরবান্বিত পুরুষ নায়কের প্রয়োজনে। সেখানে তাঁরা অপহৃতা এবং নায়কের দ্বারা উদ্ধার হওয়ার পর আবার পরিত্যক্তা হতে পারেন; তাঁদের পণ রেখে জুয়া খেলা যায়; বা আরও অনেক অত্যাচার ও পাপের পটভূমি নির্মাণ করা যায়, যাতে পরিশেষে কোনও যুগপুরুষ এসে ধর্মের জয় ঘটাতে পারেন। কিন্তু, ভারতীয় সংস্কৃতির অনন্যতা তো শুধু মহাকাব্য নির্মাণে নয়, মহাকাব্যে অবহেলিত চরিত্রের সমান্তরাল ভাষ্যেও। তাই মেয়েদের হয়ে, মেয়েদের জন্য রামায়ণের একাধিক পুনঃকথন হয়েছে এই দেশেই। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সম্ভবত ষোড়শ শতকে বাংলায় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ এবং তেলুগু ভাষায় অথুকুড়ি মল্লা-র রামায়ণ। চন্দ্রাবতীর রাম ‘পুরুষোত্তম’ নন, শুধুই এক স্বার্থভাবনাময় পুরুষ— আর, সীতা জীবনের বিভিন্ন সময় অন্য পুরুষের ইচ্ছাধীন, বঞ্চিতা এবং রাবণবধের পরেও পতির সঙ্গে পুনর্মিলনের লগ্নে চূড়ান্ত ভাবে অপমানিত।

আইআইটি-কাণ্ডের কেন্দ্রে থাকা রাহবাণ নাটকটির বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ, এখানে রাবণের আদলে নির্মিত আঘোরা নামের চরিত্রটিকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে; অবমাননা করা হয়েছে লক্ষ্মণের চরিত্রটির। সেই অপরাধে তো জৈন রামায়ণের রচয়িতাদের কিংবা স্বয়ং মাইকেল মধুসূদনকেও জরিমানা করতে হয়। কারণ জৈন রামায়ণ তীর্থঙ্কর আদিনাথের ভক্ত রাবণকে তাঁর কল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরেছিল। আর মধুসূদন রাবণকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নায়কেরই গৌরবে, বরং লক্ষ্মণকেই ফুটিয়ে তুলেছেন খলনায়কোচিত সংলাপ ও কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে। বন্ধুকে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে মাইকেল প্রকাশ করেছিলেন রাম ও তাঁর অনুচরদের প্রতি নিজের অশ্রদ্ধা; জানিয়েছিলেন, কী ভাবে রাবণ চরিত্রটি তাঁর কল্পনাকে উজ্জীবিত করেছে।

আইআইটি বম্বের কর্তৃপক্ষ এই বহুত্ববাদী আলোচনার কথা উল্লেখমাত্র না করে অভিযুক্ত ছাত্রদের উপরে জরিমানা চাপিয়ে দিলেন কেন, আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে তা আন্দাজ করা নিতান্তই সহজ। এবং, জরিমানার ফরমানের উদাহরণ এই একটিমাত্র নয়। এ মাসেরই ১৩ তারিখ এনআইটি কালিকটের পাঁচ ছাত্রের উপরে ধার্য হল বিরাট অঙ্কের জরিমানা। তাঁরা গত ২২ মার্চ কর্তৃপক্ষের অনেকগুলো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকটি বন্ধ করে ধর্নায় বসেছিলেন— এই তাঁদের অপরাধ। ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের অধিকার হননের ঘটনা এই জমানায় ঘটেই থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ক্রোধের আসল কারণটি ভিন্ন— এ বছর ২২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে রামমন্দির স্থাপনার যে চিৎকৃত উদ্‌যাপন চলছিল, তার বিরুদ্ধে গুটিকয়েক ছাত্রের একটি অহিংস প্রতিবাদ। তাঁদের হাতে ধরা ছিল একটি প্ল্যাকার্ড, যাতে লেখা: ‘ভারত রামরাজ্য নয়’। সে অপরাধেই সম্ভবত শাস্তি হল, দু’মাস পরে একটি অছিলা তৈরি করে।

বাধ্যতামূলক নিরামিষ খাওয়া থেকে শুরু করে আরও অনেক বিধিনিষেধ ভারতের বহু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানেই। খবর পাই, হস্টেলগুলোতে তৈরি হয়ে গিয়েছে জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন অলিখিত দল। ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে পরস্পরকে আড়চোখে দেখতে। কর্তৃপক্ষ কেন এ পথে হাঁটেন, তা বোঝা যায়— কিন্তু, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ স্বনামধন্য বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক মুখে কুলুপ আঁটেন কেন? দেশে-বিদেশে চাকরির অভাব তাঁদের হওয়ার কথা নয়। অথচ, তাঁরা সন্তর্পণে দূরত্ব রেখে চলেন। বহু ক্ষেত্রেই দেখি, তরুণ ছাত্র-গবেষকরা কেমন ভাবে সামান্য গবেষণাভাতায় বাড়ির দায়িত্ব পালন করেও মাস কাবার করেন; কেমন ভাবে তাঁদের দিন কাটে জরাজীর্ণ হস্টেলে, যেখানে প্রায়ই পাওয়া যায় না প্রতি দিনের পানীয় জলটুকুও; পিএইচ ডি বা অন্যান্য উচ্চ ডিগ্রির অনিশ্চিত যাত্রাপথে কেমন থাকে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য— মাননীয় ‘স্যর’ বা ‘ম্যাডাম’রা সে খবর রাখেন না। এ রকম একটা সামূহিক শোষণব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে ছাত্র-গবেষকরা যাঁরা শুধুই কেরিয়ারের কথা না ভেবে একটু বিকল্প চিন্তা করতে পারেন; মঞ্চস্থ করতে পারেন এমন কোনও ভাবনাকে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার মনমতো নয়— তাঁদের কি বিপজ্জনক জ্ঞান করেন শিক্ষকরাও?

এই সব বেয়াড়া ছাত্রছাত্রীকে প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দি থেকে দূর করতে পারলে ক্রমশ বেসরকারি পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের কর্পোরেট প্রভুদের মনপসন্দ রোবট তৈরি করার কাজটি সহজ হয়। ফলে, আশঙ্কা হয় যে, উপরমহলকে খুশি রাখতে ঠিক যেমন ভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা উচিত, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষবিন্দুতে আরোহণকারী মহামহোপাধ্যায়রা সে ভাবেই চালিয়ে যাবেন। অন্যরাও তালে তাল দিয়ে চলবেন, অন্তত নিজের গায়ে আঁচ না-লাগা পর্যন্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

IIT Bombay Ramayana punishment Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy