Advertisement
E-Paper

পতঙ্গরা বাঁচলে বাঁচব আমরাও

প্রকৃতির বদল, বিশ্ব উষ্ণায়ন বিভিন্ন পতঙ্গের প্রজননের সময়কাল বিগড়ে দিয়েছে। কীটনাশক প্রয়োগও পতঙ্গদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে।

A Photograph of insects

মৌমাছিরা বিলুপ্ত হলে মানব সভ্যতার আয়ু নাকি মাত্র চার বছর। প্রতীকী ছবি।

সুমন প্রতিহার

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩ ০৪:২৭
Share
Save

বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ছিলই, তা সত্ত্বেও আন্দোলন ঘনবদ্ধ হচ্ছিল না। ১৯৯৪ সালে ইউরোপের ব্রাসেলস শহরে মধুচাষিরা কম মূল্যে মধু আমদানি, চিনির ঊর্ধ্বমূল্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন। কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনায় মিলছিল না সাড়া। এমন সময় আন্দোলনের প্রতিভূরা বাড়ি বাড়ি বিলি করলেন একটি লিফলেট। নিরীহ সে বয়ানের শেষে ছিল একটি উদ্ধৃতি: “ইফ দ্য বি ডিসঅ্যাপিয়ারড ফ্রম দ্য সারফেস অব দি আর্থ, ম্যান উড হ্যাভ নো মোর দ্যান ফোর ইয়ারস টু লাইভ।” বক্তা হিসাবে লেখা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম। লিফলেটের প্রকাশমাত্রই জনমানসে ব্যাপক সাড়া পড়ল। আন্দোলনকারীরা বেজায় খুশি। অর্থাৎ, মৌমাছিরা বিলুপ্ত হলে মানব সভ্যতার আয়ু নাকি মাত্র চার বছর। মৌমাছি নিয়ে আইনস্টাইন কি এত তলিয়ে ভেবেছিলেন? তথ্য খননে পাওয়া গেল বিশেষ চমক।

ধান, গম যেমন বায়ুপরাগী, তেমন কাজু, আপেল, সর্ষে, তিল, কুমড়ো, লাউ, শসা মূলত মৌমাছি-নির্ভর। এনভায়রনমেন্ট হেলথ পার্সপেক্টিভ-এ প্রকাশিত রিপোর্টে উঠে এল ভয়ঙ্কর তথ্য। বিশ্বব্যাপী পাঁচ লক্ষ মানুষ পরিণত বয়সের আগেভাগেই মারা পড়ছেন শুধুমাত্র ফল, বাদাম ও আনাজের দাম নাগালের বাইরে যাওয়ায়। কারণ হিসাবে উঠে আসছে পরাগসংযোগী পতঙ্গগুলোর সংখ্যা তলানিতে পৌঁছে যাওয়া। পরিবেশে বিশৃঙ্খলা ব্যাখ্যায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’ চমৎকার। ক্ষুদ্র পরিবর্তনও যে মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সেটা বোঝাতেই এই রূপকের ব্যবহার। ঠিক যেমন মৌমাছি-সহ অন্যান্য পতঙ্গের ডানার গুঞ্জন কমলে বিশ্ব জুড়ে খাদ্য-সঙ্কট অবশ্যম্ভাবী। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ভিয়েতনাম, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া প্রথম সারিতে। চিন, ভারত-সহ রাশিয়া খাদ্য-সঙ্কটের আভাস পেতে শুরু করেছে। জোয়ারের মতো এসেছে রোগ, লাফিয়ে বাড়ছে হার্ট অ্যাটাক। প্রকৃতি, পরাগযোগ ও ফলনের সমীকরণ নিয়ে ২০১৬-য় সায়েন্স পত্রিকায় প্রাসঙ্গিক একটা গবেষণা প্রকাশ হয়েছিল। তাতে বলা হয়, তিনশো চৌত্রিশটি শস্য, আনাজের চাষাবাদ, তেত্রিশটি পতঙ্গের পরাগযোগের উপর নির্ভরশীল। গবেষণায় উঠে আসে শস্য, আনাজ ফলনে চোয়াল ঝুলে যাওয়া ঘাটতির কথাও।

পরিবেশ-প্রকৃতির বদল, বিশ্ব উষ্ণায়ন বিভিন্ন পতঙ্গের প্রজননের সময়কাল বিগড়ে দিয়েছে। বাসস্থান ধ্বংস, কীটনাশক প্রয়োগ— পতঙ্গদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে। তা-ই শুধু নয়, মৌচাকগুলোও ভাইরাস আক্রমণে এলোমেলো হয়েছে। মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস, বিশ্ব খাদ্য-সঙ্কট, মৃত্যু— এ সবের সমীকরণ কি আইনস্টাইনের সেই উদ্ধৃতিতেই লুকানো ছিল?

১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রায় সকল বক্তব্য, উদ্ধৃতি উদ্ধার করা হয়। যুক্তিনিষ্ঠ গবেষকরাও আইনস্টাইনের মৌমাছি ও মানব সভ্যতার আয়ু সংক্রান্ত উদ্ধৃতি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। এ দিকে, মৌমাছির ডানায় ভর করেই আইনস্টাইনের খোঁজ মিলল, তবে অন্য ভাবে। গবেষক স্কারলেট হয়ার্ডের মৌমাছির সঙ্গে ওঠাবসা। তিনি দেখলেন, মৌমাছিদের শূন্যের একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। শুধু তা-ই নয়, চারের উপর যে কোনও সংখ্যা তারা বুঝতেও পারে। এমনকি চার ও পাঁচের প্রভেদটাও ভালমতো ঠাহর করে। গবেষণা প্রকাশ পেতেই জনগণের তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। হয়ার্ডের রিসার্চ গাইড প্রফেসর এড্রিয়ান লন্ডন থেকে পেলেন একখানি চিঠি। পত্রলেখিকা লন্ডন নিবাসী জুডিথ ডেভিস। জুডিথের স্বামী গ্লেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, মারা গিয়েছেন ২০১১ সালে। আর এই গ্লেনকেই আইনস্টাইন পত্র মারফত জানিয়েছিলেন নিজের মৌ-ভাবনা। চিঠিটি তখন জুডিথের কব্জায়। জুডিথ সেটি তুলে দিলেন এড্রিয়ানের হাতে। ১৯৪৯-এর অক্টোবরে একশো শব্দে লেখা একটা চিঠি।আইনস্টাইন লিখেছেন, কার্ল ফন ফ্রিচের গবেষণার বিষয়ে তিনি অবগত এবং কার্লের সঙ্গে তার সাক্ষাৎও হয়েছিল। তবে মৌমাছিদের নিয়ে কার্লের গবেষণার পরিধি কতটা পদার্থবিজ্ঞানের পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন। সেই সঙ্গে পরিযায়ী পাখি ও বার্তাবাহক পায়রা নিয়ে আগ্রহের কথাও চিঠিতে লেখেন।তবে ঠিক কোন চিঠির উত্তরে আইনস্টাইন চিঠিটি লেখেন, খোঁজ মেলেনি তার। উত্তর দেখে আন্দাজ পাওয়া যায় যে, প্রাণীদের উপলব্ধি ও পদার্থবিদ্যার পরিসরে তার সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে জানতে চেয়ে গ্লেন ডেভিস আইনস্টাইনকে চিঠি লেখেন। অন্য দিকে, কার্ল ফ্রিচ মধুসন্ধানী মৌমাছিদের মৌচাকে ফিরে এসে বিশেষ নৃত্যের সূত্র সমাধান করে নোবেল পান। তথ্য ঘেঁটে এটাও মেলে যে, ১৯৪৯-এর এপ্রিলে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌমাছি সংক্রান্ত বক্তৃতা দেন তিনি। শ্রোতার আসনে ছিলেন আইনস্টাইন।

১৯৯৪-এ ইউরোপে মধুচাষিদের রাজনৈতিক সেই আন্দোলনকে জনগণের কান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে আন্দোলনকারীরা আইনস্টাইনের নাম ব্যবহার করে ফয়দা তুলতে দ্বিধা করেননি। তাঁর উদ্ধৃতি সহজেই আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। আর যে উক্তিকে আইনস্টাইনের মুখে বসিয়ে প্রচার, সমসময়ে সেই উদ্ধৃতি নিদারুণ সত্য হয়ে উপস্থিত। একেই কি বলে নামমাহাত্ম্য?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

insects Bee Environment

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}