Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
হাতে রইল শূন্যকুম্ভ
Hindutva

শাহি স্নানই বলে দেয় হিন্দু ধর্মের মূল সুর, যা হিন্দুত্ববাদ বোঝেনি

হিন্দুধর্ম গরিব, মহিলা ও দলিতদের হাতে এই অস্ত্রটি তুলে দিয়েছে। বলেছে, স্নান ও দানেই পুণ্য। এই ঘাটে যখন সাধুরা স্নানে, একই জলস্রোতে অন্য ঘাটে নারী, শুদ্দুর সকলের ভিড়।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৭
Share: Save:

হিন্দি বলয়ের পরিচিত এই ব্রতকথাটি অনেকটা আমাদের চেনা সাত ভাই চম্পা, পারুল বোনের গল্পের মতো। তবে একটু তফাত আছে। এদের বাবা-মা আদতে রাজা রানি নন। এরা শ্রেষ্ঠী বা বণিক। সাত ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আদরের বোনটি অনূঢ়া। সকালে বাড়িতে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষা নিতে আসেন, বাড়ির মেয়ে-বৌরা তাঁকে যথাসাধ্য দান করেন। ব্রাহ্মণও বৌদের সুখেশান্তিতে স্বামীসোহাগিনী হয়ে ঘর করো বলে আশীর্বাদ করে যান। শুধু মেয়েটির ক্ষেত্রেই সমস্যা। ব্রাহ্মণ তাকে দেখলেই ভাইদের সংসারে রাজরানির মতো যত্নআত্তিতে থেকো বলে যান।

শ্রেষ্ঠীপত্নী এক দিন আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওকে এই আশীর্বাদ করেন কেন? ও কি স্বামীর ঘরে আদরযত্ন পাবে না? পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণ জানালেন, মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ আছে। বিয়ের রাতেই স্বামী মারা যাবে। তাই তিনি এ ভাবেই আশীর্বাদ করেন। ব্রাহ্মণের পদতলে পড়ে মায়ের অনুনয়, এই দুর্ভাগ্য কাটানোর কি কোনও উপায় নেই?

এ বার অনেক চিন্তাভাবনা করে উপায় বাতলে দিলেন ব্রাহ্মণ। বহু দূরে এক গ্রামে সোনা ধোপানির বাড়ি। মেয়েটি তাকে তুষ্ট করলে, ধোপানি তাকে নিজের সিঁদুর দিলে সে চিরায়ুষ্মতী হবে। ছোট ভাই দিদিকে নিয়ে রওনা হল সেই দূরের পথে।

রুগ্ণ স্বামী, দুই ছেলে ও ছেলের বৌ নিয়ে সোনা ধোপানির সংসার। এখন সেখানে আর অশান্তি নেই, ধোপানি প্রত্যহ উঠে দেখে, পুত্রবধূরা ঘর ঝাঁট, বাসন মাজা থেকে রান্নাবান্না সব সেরে রেখেছে। দুই বৌকেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিল সে, বাহ্, তোমরা সকাল-সকাল এ ভাবে কাজ সেরে রাখো, খুব ভাল লাগে। বৌমারা অবাক, নাহ্ মা, আপনিই তো আমরা ওঠার আগে সব সেরে রাখেন। আমাদের তো আজকাল কুটোটি নাড়তে হয় না তাই।

ধোপানি সে রাতে না ঘুমিয়ে জেগে থাকল। শেষ রাতে নজরে এল, অচেনা এক বালিকা বাড়িতে ঢুকে সব কাজ সেরে রাখছে। সে পায়ে পড়ে গেল, কে মা তুমি ছদ্মবেশী দেবী?

বালিকা জানাল, সে আর তার ভাই গ্রামে নতুন এসেছে। গোপনে ধোপানিকে তুষ্ট করাই তার অভিপ্রায়। নিজের পরিচয়, ব্রাহ্মণের ভাগ্যগণনা সবই খুলে বলল সে। ধোপানি ঘর থেকে সিঁদুরকৌটো নিয়ে বালিকাকে দিয়ে বলল, বিয়ের দিন স্বামীকে অবশ্যই পরিয়ে দিতে বোলো। আমিও যাব।

ঘটনার কয়েক দিন পরে শ্রেষ্ঠীকন্যার বিয়ে। ধোপানি দুই পুত্রবধূকে জানাল, আজ সকাল সকাল খেয়ে নিয়ো। ধোপানি যাবে শ্রেষ্ঠীকন্যার বিয়ের নেমন্তন্নে। বিয়ে শেষ হতেই এক সাপ এসে সেই কিশোর বরকে বিষদাঁত বসিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিল। কিন্তু ওই যে ধোপানির সিঁদুর! ছেলেটি ফের বেঁচে উঠল। ধোপানির উপদেশে শ্রেষ্ঠী পরিবার ও গ্রামের সব লোক তার পর থেকে সোমবারে অমাবস্যা পড়লেই ফুল, বেলপাতা দিয়ে শিবের ব্রত করত। এটাই সোমবতী অমাবস্যার কাহিনি।

ব্রতকথাটি জোগাড় করেছিলাম বারো বছর আগে হরিদ্বার কুম্ভের ফুটপাতে, হিন্দি ভাষায় ছাপা রংচঙে এক চটি বই থেকে। এ বার অতিমারির দাপটে কুম্ভক্ষেত্রে যাওয়া হল না, কিন্তু ঘরে বসে দেখলাম, ইউটিউবেও অ্যানিমেশনে সেই হিন্দি ব্রতকথা চলছে। আগামী কালই হরিদ্বার কুম্ভে সেই মোক্ষম লগ্ন। সোমবতী অমাবস্যার শাহি স্নান। নাগা সাধুরা পুলিশি পাহারায় হাতি, ঘোড়া বা উটে চেপে, মখমলের চাদর-পাতা ট্র্যাক্টরকে রথ বানিয়ে হর-কি-পৌড়ীতে স্নানে আসবেন, আকাশ থেকে ফুল ছড়াবে হেলিকপ্টার। সব কুম্ভ, সব শাহি স্নানই আকারে-আয়তনে-জাঁকজমকে প্রায় এক রকম। তবে সূক্ষ্ম তফাত থেকেই যায়। হরিদ্বারে প্রধান তিথি সোমবতী অমাবস্যা, প্রয়াগে মাঘ মাসের মৌনী অমাবস্যা।

ব্রতকথাটি মনে পড়ল একটাই কারণে! উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিংহ রাওয়ত এসে মেয়েদের রিপড জিনস বা উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ এসে লাভ জেহাদ নিয়ে যে অমৃতবাণীই বর্ষণ করে যান না কেন, হিন্দু ধর্মের সেফটি ভালভটা আছে তার নিজস্ব লোকসংস্কৃতিতে। কুম্ভস্নানে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এই সময়ে হরিদ্বারের রাস্তায় বা প্রয়াগের বালুচরে দাঁড়ালে দেখা যায়, প্রায় চোখ-মুখ ঢাকা ঘোমটা টেনে দেহাতি মেয়েদের দল সারি বেঁধে এগিয়ে চলেছেন। সামনে গাঁয়ের কোনও মুখিয়া বা ছড়িদার আছেন ঠিকই, তাঁর দায়িত্ব দলের সবাইকে নিয়ে তীর্থ সেরে, নিরাপদে ফিরে যাওয়া। ওইটুকুই। রাতের বেলা দলের কে আটার লিট্টি সেঁকবেন, আর কে ছাতুর পরোটা খাবেন তা নিয়ে তাঁর কোনও বিধান থাকে না। গ্রাম থেকে মেলায় আসা এই মেয়েরা অনেক সময়েই দলছুট হয়ে হারিয়ে যান। শাহি স্নানের আগের দিন থেকে ‘ভুলে ভটকে’ শিবিরের মাইকে তাই অনবরত ঘোষণা চলবে, রাজুয়াকি মাই, আপ ইঁহা আ যাইয়ে। প্রতিটি ভোরে দেখেছি, স্নান সেরে দেহাতি মেয়েদের দল ফিরছে। এক জনের হাতে চালের বস্তা, এক জনের হাতে আলু। কারও কোঁচড়ে খুচরো পয়সা। রাস্তায় বসে থাকা ভিখিরি, কুষ্ঠরোগীদের সামনে সেগুলি তাঁরা একটু করে ঢেলে দিচ্ছেন। ভোরের অপার্থিব আলোয় তাঁদের মুখ উদ্ভাসিত। যে মহিলা বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের গ্রামে দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, স্বামীর লাথি-ঝাঁটাও সহ্য করেন, এই আকাশের আলোয় আলোয়, দানের অধিকারে কি ক্ষণিকের জন্যও ঘটে যায় না তাঁর মুক্তি?

উপরে নাগা সাধুদের স্নানের ‘স্পেকটাকল’, নীচে মেয়েদের নিরুচ্চার ব্রতকথা, এই দ্বিস্তরী জোটবন্ধনটাই বোধ হয় শাহি স্নানের আসল কথা। জানি, সোনা ধোপানির গল্পটা দুর্বল। সেই মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের মতো সাপ, নেতি ধোপানি আর সিঁথির সিঁদুরের মোটিফ। বাংলা গল্পটা হিন্দিকে প্রভাবিত করেছিল কি না, সেই বোকা-বোকা বাঙালি অস্মিতা নিয়েও ভাবার দরকার নেই। সর্পসঙ্কুল দেশে লোককথাগুলি এক রকমই হবে, স্বাভাবিক। কিন্তু যেটা বুঝতে হবে, ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ বা ভোটের রাজনীতি নয়, গত দেড়শো বছর ধরে বটতলার ছাপা এই ব্রতকথা এবং তীর্থমাহাত্ম্যের এই চটি বইগুলিও ‘নেশন’ তৈরিতে সাহায্য করে। এখানে আশ্বিনে সিঁদুরখেলা হবে, ওখানে চৈত্র অমাবস্যায় সোনা ধোপানি হবে এই বৈচিত্রই দেশ। জাতপাতে ‘গোলি মারো’! নিম্নবর্ণের ধোপানির আশীর্বাদ না পেলে উচ্চবর্গের শ্রেষ্ঠীকন্যার জীবন-যৌবন ছারখার হবে।

মেয়েরাই যে কুম্ভস্নানের আসল ‘পার্টিসিপেটরি পাওয়ার’, তা এই বাংলারও নজর এড়ায়নি। নবনীতা দেব সেন প্রয়াগকুম্ভে শাহি স্নানের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে-তে লিখছেন, “ওগো পদ্ম গায়েন, ওগো টগরবালা, বিরজুকী মা আর চুন্নুবাই শোনো, তোমাদের সকলের সঙ্গেই আজ থেকে আমিও রইলুম।” তারও বারো বছর আগে ওই প্রয়াগকুম্ভেই অমৃতকুম্ভের সন্ধানে চলেছেন কালকূট, “রঙিন পায়জামা, পাঞ্জাবি ও ওড়নার সঙ্গে ঘাড়ের ওপর এলানো খোঁপা, দোলানো বেণী। বাঁকা খোঁপায় ফুল গুঁজে রঙিন রেশমী শাড়িতে টেনে দিয়েছে কাছা। হাজার কুচি ঘেরা ঘাঘরায় ঢেউ তুলে চলেছে দিল্লীওয়ালী, বিচিত্র বর্ণবহুল চৌদ্দ হাত শাড়িতেও সর্বাঙ্গ উদাস করে চলেছে রাজপুতানী।” মেয়েরা ঘাঘরা, শাড়ি না জিনস পরে কুম্ভস্নানে যাবেন, শাড়িতে কাছা দেবেন না কুচি সে সব নিয়ে কুম্ভের ধর্মক্ষেত্র কোনও দিন ভাবেনি। দেহাতি মেয়েরা দলছাড়া হয়েছেন, কিন্তু হাথরস ঘটেনি। স্বাধীনতার পর প্রথম কুম্ভ ছিল এই হরিদ্বারেই— ১৯৪৮ সালে। ননদ আর নন্দাইয়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকে সেখানে গিয়েছেন রাণী চন্দ, “লোকে লোকারণ্য চার দিক। ঘাটের উপরে, বাড়ির ছাদে, পাহাড়ের গায়ে, গাছের ডালে যে দিকে তাকাই রঙিন ঘোমটা গিজগিজ করে।” স্বামী-পুত্রহারা অসহায় বাঙালি মেয়েরা যে গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে কী ভাবে হরিদ্বার কুম্ভকে আশ্রয় করেছিলেন, তার প্রমাণ আছে রাণী চন্দের পূর্ণকুম্ভ বইতে, “আমাদের সামনাসামনি বসুমতী-মার ছোট্ট তাঁবু। জীর্ণ একখানি কেটের ধুতি পরনে, গায়ে সামান্য সুতির চাদর। মাটিতে বিছানো চাটাইয়ের একধারে ছেঁড়া একটা কম্বলই তাঁর বিছানা।” বসুমতী-মার স্বামী উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য, বসুমতী কাগজের প্রতিষ্ঠাতা। স্বামী, ছেলে, নাতি, নাতবৌ সকলে মারা গেলেন। তিনি চলে এলেন কুম্ভক্ষেত্র হরিদ্বারে রামকৃষ্ণ মিশনের তাঁবুতে।

এই হল হিন্দু ধর্মের বৃহত্তম লোক উৎসব। টিভি ক্যামেরা ও সমাজমাধ্যমের দৌলতে আখড়ার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বড় মহামণ্ডলেশ্বর সাধুদের শাহি স্নানটাই ইভেন্ট। কিন্তু সে দিন লাখো লাখো দেহাতি মেয়ে ওই গঙ্গাস্নান করেন। হিন্দুধর্ম গরিব, মহিলা ও দলিতদের হাতে এই অস্ত্রটি তুলে দিয়েছে। বলেছে, স্নান ও দানেই পুণ্য। হরিদ্বার, প্রয়াগ থেকে উজ্জয়িনী, নাশিক: চার কুম্ভক্ষেত্র তাই কোনও না কোনও নদীর ধারে। এই ঘাটে যখন সাধুরা স্নানে, একই জলস্রোতে অন্য ঘাটে নারী, শুদ্দুর সকলের ভিড়। শাহি স্নানের লগ্ন এবং নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি শেষ হলে, সন্ধ্যায় তাঁরা হর-কি-পৌড়ীর ঘাটেই স্নান করবেন। তার পর রামচরিতমানস বা ব্রতকথা শুনবেন।

হিন্দুত্ববাদীদের তাই মন্দির-মসজিদ, লাভ-জেহাদ বা রিপড জিনসের বদলে হিন্দু ধর্মের কথা জানতে হবে। হিন্দু সংস্কৃতি বুঝতে এখনও বহু পথ হাঁটতে হবে। ওখানেই তাঁদের সবচেয়ে বড় শূন্যতা।

অন্য বিষয়গুলি:

Muslim Hinduism Hindutva Love Jihad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy