এই সংশোধিত আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারা হল বনের সংজ্ঞা নির্ধারণ। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি সংশোধিত বন-সংরক্ষণ আইন ২০২৩ সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয়ে গেল। এই আইনের প্রস্তাবনায় বিভিন্ন লক্ষ্যের কথা বলা আছে। যেমন— ২০৭০ সালের মধ্যে ‘নেট কার্বন নিঃসরণ শূন্য’ ভারত গড়ার লক্ষ্য, বন ও বৃক্ষ-আচ্ছাদন বাড়ানোর লক্ষ্য, অর্থনৈতিক-সামাজিক সুবিধা, বিশেষত জঙ্গলে বসবাসকারীদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের লক্ষ্য ইত্যাদি। কিন্তু কী ভাবে হবে, সেটা স্পষ্ট বলা নেই। বরং কতটা বনভূমি বন-সংরক্ষণ আইনের বাইরে রাখা যায়, এটি তারই এক প্রয়াস।
এই সংশোধিত আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারা হল বনের সংজ্ঞা নির্ধারণ। বন-সংরক্ষণ আইনের আওতায় সেই সব বনভূমিকে ধরা হবে, যা ১৯২৭ ভারতীয় বন আইন অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর ১৯৮০ বা তার পরে নথিভুক্ত করা আছে। দ্বিতীয়ত, যে সব বনভূমি ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বরের আগে অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সব জমিও এই আইনের আওতায় পড়বে না। এই ধরনের বন, যেটাকে বন দফতরের পরিভাষায় ‘আনক্লাসড ফরেস্ট’ বলা হয়, সেটা প্রায় নথিভুক্ত বনের ২৮ শতাংশ। এই সঙ্কুচিত বনের সংজ্ঞা বিখ্যাত টি এন গোদাভরমন মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে বনের সংজ্ঞাকে অর্থহীন করার চেষ্টা। ১৯৮০ সালের বন-সংরক্ষণ আইনের ২নং ধারায় সুপ্রিম কোর্ট বর্ণিত বনভূমি হল: যে কোনও বনজমি, যা সরকারি খাতায় নথিভুক্ত আছে। এই প্রসারিত সংজ্ঞা বন-সংরক্ষণে অনেকটা সাহায্য করেছে। তথ্য বলছে, ১৯৫০-১৯৮০’র মধ্যে প্রায় ৪২ লক্ষ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বন-সংরক্ষণ আইন ১৯৮০ প্রবর্তনের পর থেকে গত চল্লিশ বছরে মাত্র ১৫ লক্ষ হেক্টর হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বনভূমি হস্তান্তরে ছাড়পত্র পেতে হলে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের বন উপদেষ্টা কমিটির অনুমতি দরকার হয়। সম্ভবত এই কারণে বনভূমির চরিত্র বদলে এই শ্লথ গতি।
আবার অনেক জঙ্গল এলাকা আছে যেটা সরকারের খাতায় বন বলে নথিভুক্ত নয়। এর বেশির ভাগই সমষ্টিগত জঙ্গল বা ‘কমিউনিটি ল্যান্ড’। গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত, ওড়িশা, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে এই ধরনের বনভূমি আছে। নতুন আইনে এই সব জঙ্গলে বসবাসকারী অধিবাসীদের নতুন করে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা। কারণ, এই সব জঙ্গল সংশোধিত বন-সংরক্ষণ আইনের বাইরে থাকছে। ফলে এই সব প্রাকৃতিক জঙ্গল কোনও রকম বাধা ছাড়াই বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বেসরকারি পুঁজিপতির হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ২০০৯ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিল, এখন থেকে বন-সংরক্ষণ আইন ১৯৮০ অনুযায়ী অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য জমির চরিত্র বদল করার ছাড়পত্র দেওয়া যাবে একমাত্র বন-অধিকার আইন ২০০৬ সম্পৃর্ণ ভাবে বলবৎ করার পরেই। বন-অধিকার আইন অনুযায়ী, জঙ্গলের বসবাসকারীদের গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া বনের জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। এই আইনের বলেই খনিজ ও লৌহ আকরিক সমৃদ্ধ বিভিন্ন রাজ্যে বহু প্রকল্প আটকে রয়েছে বা বাতিল হয়েছে। যেমন, ওড়িশার রায়গড়া জেলার নিয়মগিরি পাহাড় ও সংলগ্ন বনভূমি থেকে বক্সাইট খনন রোধ করা সম্ভব হয়েছিল ওখানকার ডোংরিয়া কোন্ধ আদিবাসীদের ১২০টি গ্রামের গ্রামসভার অনুমতি ছিল না বলে। আশ্চর্যজনক ভাবে সংশোধিত বন-সংরক্ষণ আইনে বন-অধিকার আইন ২০০৬-এর উল্লেখ নেই।
সংশোধিত আইনে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ও কৌশলগত কারণে সেনাবাহিনী ছাড়া সরকারও ‘লিনিয়র প্রোজেক্ট’ তৈরি করতে পারে এই বনভূমিতে। তার জন্য সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা এই আইনের বাইরে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া ১০ হেক্টর বনভূমি নিরাপত্তাজনিত পরিকাঠামো তৈরি এবং রেল ও রাস্তার ধারে ০.১ হেক্টর বনভূমি আইনের বাইরে থাকছে। ফলে জীববৈচিত্রের ‘হটস্পট’ হিসাবে চিহ্নিত গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত, সিকিম, আরাবল্লী পর্বতমালা বা উত্তরাখণ্ডে এই আইন বলবৎ হবে না। ইকোটুরিজ়্ম বা চিড়িয়াখানা ও সাফারি প্রকল্পের বনভূমিও আইনের আওতার বাইরে রাখা হবে।
অবশ্য সংশোধনীতে এ-ও বলা হয়েছে, নথিভুক্ত বনের বাইরে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বনসৃজনের মাধ্যমে বনআচ্ছাদন বাড়ানো হবে আরও ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টনের কার্বন সিঙ্ক তৈরির লক্ষ্যে। মনে রাখতে হবে, মোনোকালচার প্ল্যানটেশন-এর মাধ্যমে বনআচ্ছাদন বৃদ্ধি প্রকৃত বনভূমির বৃদ্ধি নয়। ভারতীয় বনসর্বেক্ষণ ২০২১-এর রিপোর্টে চা, পাম তেল, কফি, রাবার ইত্যাদির আবাদকে বনভূমি হিসাবে ধরা হয়েছে। ফলে এই আইনের বাইরে থাকা বনভূমিতে বেসরকারি উদ্যোগে এই ধরনের বাণিজ্যিক আবাদ উৎসাহ পাবে। উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক জঙ্গলের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা ‘মোনোকালচার প্লান্টেশন’-এর থেকে অনেক বেশি (একটি হিসাবমতো, প্রায় ৪০ গুণ)।
প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের সংশোধন বনভূমির বাণিজ্যিকীকরণে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এই সংশোধনে বনভূমির চরিত্র বদল হবে, কখনও নিরাপত্তার নামে, কখনও ‘উন্নয়ন’-এর নামে। মনে রাখা প্রয়োজন, জঙ্গলকে ‘পণ্য’ হিসাবে দেখলে পরিবেশের বিপর্যয় অবধারিত। জঙ্গলকে দেখতে হবে বাস্তুতন্ত্র হিসাবে। একমাত্র তবেই জীববৈচিত্র বাড়বে। এবং শেষ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের ধার্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy