প্রস্তুতি: অতিমারির মধ্যেও দিল্লির রাজপথে সেন্ট্রাল ভিস্টার কাজ চলছে। ৬ মে, ২০২১। ছবি: পিটিআই
যাঁরা নরেন্দ্র মোদীর সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন, ৩১ মে দিল্লি হাই কোর্টের কড়া ভাষায় তিরস্কার তাঁদের কাছে সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরাও হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন দু’টি ঘটনা দেখে— এক, উচ্চ আদালতগুলিতে সেন্ট্রাল ভিস্টার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলির শুনানি কী দ্রুত হচ্ছে, আর মামলা খারিজ হয়ে যাচ্ছে চটপট; এবং দুই, প্রধানমন্ত্রী কী দক্ষতার সঙ্গে দেশের বিক্ষোভের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন সেন্ট্রাল ভিস্টার দিকে। অতিমারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম অক্ষমতাকে কেন্দ্র করে জনতার প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভকে যখন তাঁর মিডিয়া ও প্রচারবাহিনী কমাতে পারল না, তখন তিনি নিজেই একটি গুগলি দিলেন। আক্রোশের উত্তাপ নিয়ে গেলেন দিল্লির রাজপথের দিকে। আর এখন সব সমালোচনাই কেন্দ্রীভূত হয়েছে এই ভয়াবহ পরিকল্পনার উপর।
নরেন্দ্র মোদীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, যাঁদের তিনি ঘৃণা করেন, তাঁদের চটিয়ে তিনি এক নির্মল আনন্দ পান। অতএব এই মুহূর্তে এত রাগ দেখে তিনি নিজেকে জয়ী বলে মনে করছেন। দিল্লি শহরের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছাড়া আর কোনও অনুভূতি যে নেই, তা বুঝতে মনোবিজ্ঞানীর প্রয়োজন নেই। রাজধানীকে অপছন্দ করা কোনও বিশেষ অপরাধ নয়। কিন্তু এই স্তরের বিদ্বেষ এবং তার সঙ্গে ধ্বংসাত্মক আচরণ কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক। লুটিয়েন্স-এর স্থাপত্য সেন্ট্রাল ভিস্টা হল দিল্লির প্রধান প্রশস্ত রাজপথ। এটি পৃথিবীর কয়েকটি দেশের রাজধানীর শ্রেষ্ঠ সুসজ্জিত বীথির আদলে তৈরি। যেমন, ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মল বা প্যারিসের শঁজেলিজে— যদিও আয়তন আর জাঁকজমকে সেগুলির তুলনায় কম। যাঁরা স্বচক্ষে দেখেননি, তাঁরাও প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির এই সুন্দর রাজপথকে টিভির পর্দায় দেখেন। উভয় পার্শ্বস্থিত দৃশ্যময় এলাকাকেই স্থাপত্যশিল্পীরা সেন্ট্রাল ভিস্টা বলে চিহ্নিত করেন।
রাইসিনা পাহাড়ের উপর অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে এই রাজপথ (ব্রিটিশদের কিংস-ওয়ে)— দুই কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্রিটিশ অট্টালিকা, নর্থ ও সাউথ ব্লককে দু’পাশে রেখে নেমেছে এক সুবিশাল বিজয় চকে। সংসদকে বাঁ দিকে রেখে এই রাজপথ একদম সোজা চলেছে তিন কিলোমিটার ধরে ওয়ার মেমোরিয়াল বা ইন্ডিয়া গেট অবধি। এই বীথির অদূরে দুই দিকে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভবনগুলি— উদ্যোগ, কৃষি, বায়ু, রেল, নির্মাণ ও শাস্ত্রী। আছে দিল্লির সেই ‘বিজ্ঞান ভবন’, যা প্রেক্ষাগৃহ থেকে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। জনপথ ও রাজপথ যে চৌরাস্তায় বিভক্ত হয়েছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে পণ্ডিত নেহরু তাঁর শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী মৌলানা আজাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন ওই চার খণ্ড জমির সদ্ব্যবহার নিয়ে। এক পাশে ছিল জাতীয় সংরক্ষণাগার বা ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর তাঁদেরই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি দুই দিকে গড়ে উঠল জাতীয় জাদুঘর আর জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। চেষ্টা করেও জাতীয় গ্রন্থাগারকে যখন কলকাতা থেকে নিয়ে আসা গেল না, তখন চতুর্থ প্লটটি বিদেশ মন্ত্রককে দেওয়া হল। প্রচুর অর্থব্যয় করে প্রাসাদতুল্য জওহরলাল নেহরু ভবন স্থাপন করার পর, মোদীর আমলেই এখানে মন্ত্রী ও সচিবেরা কাজ করতে শুরু করেন।
এখন এই বিশাল ভবন আর সব জাতীয় ঐতিহ্যের গৌরবময় প্রতীকগুলি সেন্ট্রাল ভিস্টার সৌন্দর্য বৃদ্ধির স্বার্থে ভেঙে ফেলা হবে। ধ্বংসলীলার পর ওই জায়গায় মোদী গড়ে তুলবেন দশটি প্রকাণ্ড ৪০ ফুট উঁচু বেলেপাথরের ইমারত। এই নতুন ভবনগুলিতে ভারত সরকারের ৫৯টি মন্ত্রককে একত্রিত করা হবে। প্রাক্তন কূটনীতিবিদ ও মোদীর খাস ভক্ত এবং তাঁর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর খুব খারাপ লাগে যে, ১০,০০০ সরকারি কর্মচারী তাঁদের বাকি ৪১,০০০ ভাই-বোনদের সঙ্গে এক এলাকায় কাজ করতে পারছেন না। অর্থাৎ, এই সুবৃহৎ পরিকল্পনা যেন ৫১,০০০ আমলার সুবিধার্থে। চাকরিজীবনের ষোলো বছর বিভিন্ন ভবনে কাটানোর সময় পরিকাঠামো নিয়ে তেমন কোনও অসুবিধে তো আমার হয়নি, অন্তত রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পায়রার খোপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। এই মোদীই না বারংবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, সরকারের আয়তন ও খরচ কমাবেন আর আমলাদের সংখ্যা কাটছাঁট করবেন? আমলাতন্ত্রের দৃঢ়মুষ্টি থেকে মানুষকে মুক্তি দেবেন?
সেন্ট্রাল ভিস্টার সবচেয়ে বিতর্কিত পরিকল্পনা হল নতুন সংসদ ভবন। এর কি আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল বা আছে? যে প্রধানমন্ত্রী সংসদ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে সবচেয়ে উপেক্ষা করেছেন, তাঁর মুখে ‘সংসদের উপকারের জন্যেই করছি’ শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে। গণতন্ত্রের এই হৃৎপিণ্ড নিয়ে কোনও গণতান্ত্রিক আলোচনায় বিশ্বাস করেন না মোদী। কেউ সঠিক জানে না, কেন বা কত খরচ হচ্ছে। আগামী অগস্টে স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিক অনুষ্ঠানের আগেই নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমান ভবনটির কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। সংসদের দেওয়ালে আঁকা প্রায় ৮০টি অমূল্য চিত্র বা ফ্রেস্কোর কী হবে, তাও আমরা জানি না।
ভিস্টার আর একটি অংশ যেখানে বুলেট গতিতে কাজ হচ্ছে, তা হল রাজপথের আধুনিকীকরণ ও শোভাবর্ধন। কিন্তু এখনও তো এই রাজপথকেই সবচেয়ে ভাল ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তবে এত টাকা কিসে খরচ হবে? বর্তমান নগরোন্নয়ন মন্ত্রী সংক্ষিপ্ত ভাবে জানিয়েছেন, এই টাকা দিয়ে ‘ল্যান্ডস্কেপিং’ করা হবে, আর ‘গ্রিন কভার’ প্রচুর বাড়ানো হবে। কিন্তু তার জন্যে শত শত পুরনো, ছায়াময় গাছ কেন কাটা হচ্ছে, তার সদুত্তর নেই। রাজপথে নাকি প্রসাধন কক্ষ তৈরি হচ্ছে, পানীয় জলের ব্যবস্থা হচ্ছে, রাস্তা পার করার জন্য সাবওয়ে বা সুড়ঙ্গপথও নির্মাণ হবে। কিন্তু কেউ বলছেন না, গত ৯০ বছরে কি কিছুই ছিল না? করোনা সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় খরচ অগ্রাহ্য করে ৪৭৭ কোটি টাকা এই রাস্তা প্রকল্পে কেন ঢালতে হচ্ছে?
লুটিয়েন্সের দিল্লিকে এত তিরস্কার করেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এই উপশহরের সবচেয়ে মূল্যবান ১২ একর জমির উপর পাঁচটি বাংলো জুড়ে বসবাস করেন। তাঁর সব পূর্বসূরি এতে সন্তুষ্ট হলেও, নরেন্দ্র মোদী চান ওই সেন্ট্রাল ভিস্টায় তাঁর এক নতুন বিশাল প্রাসাদ নির্মিত হোক। আর একটি নয়া রাজগৃহ বানাতে বলেছেন উপরাষ্ট্রপতির জন্য। এ ছাড়া দেহরক্ষীদের কলোনিও তৈরি হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এই সবের জন্য মাত্র ২০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। বিজ্ঞরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন যে, সব মিলিয়ে খরচ হবে এর অনেক গুণ বেশি।
ভিস্টা বিতর্ক নিয়ে দিল্লির সচেতন সম্প্রদায় এখন জ্বলছে, আর তাঁদের প্রবল সক্রিয়তাকে কোভিড সংক্রমণ থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে। মোদী ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু অনুমান করতে পারেননি যে, আন্তর্জাতিক স্তরে এত সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। ওরহান পামুকের মতো নোবেল বিজয়ী, বা গায়ত্রী স্পিভাক, কেউ-ই ছেড়ে কথা বলছেন না। দেশের প্রচুর চিন্তাশীল ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও প্রতিবাদ করেই চলেছেন। কিন্তু, কেউ বলতে পারেন, শিক্ষা-সংস্কৃতির দুনিয়া থেকে মোদী এতটাই দূরে যে, তাঁর সত্যি কিছু যায় আসে না। দম্ভের সৌধ স্থাপন করতে গিয়ে তিনি জাতীয় জাদুঘরের ক্ষেত্রে কী গুরুতর অপরাধ করতে চলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়তো তা পুরোটা বুঝছেন না। এখানে দু’লক্ষেরও বেশি দুর্মূল্য বস্তু সংরক্ষিত আছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি এমন, যার একটিরও ক্ষতি হলে ভারতের ইতিহাসের একটি অংশ চিরকালের জন্যে লুপ্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে, সম্পূর্ণ জাতীয় রত্নভান্ডারকে তুলে নিয়ে যেতে হবে নর্থ আর সাউথ ব্লক-এ। এই সব মূল্যাতীত বস্তুর উপর মাফিয়া চক্রের নজর আছে। একটু অসাবধান হলেই আসল বস্তু উধাও করে নকল জিনিস বসিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, ওই দু’টি বাড়িতে এদের রাখার এত জায়গাও নেই। মোদীকে কেউ বোঝাতে পারছেন না যে, যে কক্ষগুলি অফিসার আর করণিকের জন্যে নির্মিত হয়েছিল, সেখানে ঐতিহাসিক জিনিসের প্রদর্শন করা যায় না। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ থেকে আলোর বৈজ্ঞানিক জটিলতার মতো আরও বিষয় আছে।
একই অজ্ঞতা আর জেদের কারণে তিনি হেরিটেজ সংরক্ষণের নিয়ম লঙ্ঘন করেই চলেছেন। ইচ্ছাকৃত ভাবেই পুরো চিত্রটি এক সঙ্গে পেশ করা হচ্ছে না। এই বিশাল পরিকল্পনার মানচিত্র শুধু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর গুজরাতি স্থাপত্যকার বিমল পটেল জানেন। অবাক হওয়ার কারণ নেই, যদি তাঁরা নতুন এক ‘হিন্দু প্রাসাদিয়া স্থাপত্য’ আবিষ্কার করেন, তবেই না তিনি আট শতকের মুসলিম আর ঔপনিবেশিক শাসনের লাঞ্ছনা ঘোচাতে পারবেন?
আসল কথা হল, ২০১৪ সালের মে মাসে শপথ নেওয়ার পর থেকেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অমরত্বের সন্ধানে। এই মূল্যায়ন সাধারণত বাদশার মৃত্যুর পরে হয়ে থাকে। তখন তাঁর শাসনের প্রধান সাফল্যের সঙ্গে দোষত্রুটির পাল্লাও ওজন করা হয়। কোনও সম্রাট গায়ের জোর দেখিয়ে এ সম্মান কখনও পাননি, বা পাওয়া সম্ভবও নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy