জলাশয় ভরাট পশ্চিমবঙ্গে এক সাধারণ ঘটনা। —ফাইল চিত্র।
ভরাট করে ফেলা একটি পুকুরের পুনঃখননের কাজ চলছিল। প্রায় দু’দশক আগে পানিহাটি পুর এলাকার অন্তর্গত চণ্ডীতলার এই ইটখোলার পুকুরটি বোজানো শুরু হয়েছিল। পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের ফসল এই পুনঃখনন।
বুজিয়ে ফেলা জলাশয়ের পুনঃখনন সে ভাবে না হলেও পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রেই জানেন, জলাশয় ভরাট এ রাজ্যে এক সাধারণ ঘটনা। ২০১৮-১৯’এ জলশক্তি মন্ত্রকের অধীন, ‘জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন, এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন’ বিভাগের এই গণনায় সারা দেশে ২৪,২৪,৫৪০টি জলাশয়ের মধ্যে ৩৮,৪৯৬টি (১.৬ শতাংশ) জবরদখলের শিকার, অর্থাৎ কম-বেশি ভরাট করা হয়েছে। কিন্তু, জলাশয়ের সংখ্যার নিরিখে শীর্ষে অবস্থানকারী (৭,৪৭,৪৮০টি) পশ্চিমবঙ্গে একটিও জলাশয় নাকি জবরদখলের শিকার হয়নি। অথচ, ইটখোলা পুকুরের মতো রাজ্যের বেশ কিছু জলাশয়ই গত কয়েক দশকে ভরাট করা হয়েছে। এই গণনার বছরখানেক আগেই চণ্ডীতলার আরও একটি পুকুর ভরাট করা শুরু হয়। নাগরিক প্রতিবাদে মৎস্য দফতরের হস্তক্ষেপে ভরাটের কাজ মাঝপথে বন্ধ হলেও, ভরাট অংশের পুনঃখনন হয় না। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য আইন অনুযায়ী, ৫ কাঠা বা তার থেকে বড় কোনও জলাশয় বিনা অনুমতিতে ভরাট করা হলে, তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বাধ্যতামূলক।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীন ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিম্যাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজ়েশন’-এর একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে বছর দুয়েক আগে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে দাবি করা হয়েছিল, কলকাতা শহরের মানচিত্র থেকে গত ৩৫ বছরে ৫০০০-এর উপর জলাশয় উবে গিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীনে চলা এই গণনায় এ সব কিছুই ধরা পড়েনি। এমনকি বছর কয়েক আগে রামসার কনভেনশন স্বীকৃত পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ভরাট নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বিরাট সাড়া পড়লেও, এই গণনায় তার কোনও জায়গা হয়নি! স্বভাবতই রিপোর্টের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এই ঘটনা প্রকৃতি থেকে বহু জলাশয়ের পাকাপাকি মুছে যাওয়ার সঙ্গেও সম্পর্কিত, যা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, জলাভূমি মানুষের খাদ্য ও কাজের অন্যতম জোগানদার। প্রথম সেন্সাস রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, জলাশয়গুলির বহুল ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষের কাজে। এমনকি, বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণেও জলাভূমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ, সম্প্রতি এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি জমি মাফিয়াদের সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার। জলাশয় ভরাটের ফলে নিকাশিব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে কী ভাবে বন্যার পরিস্থিতি তৈরি করে, তা মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই বা হায়দরাবাদ শহরের গত দু’দশকের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত। কয়েক বছর আগে চেন্নাইয়ে যে তীব্র পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তারও অন্যতম কারণ ছিল এই জলাশয় ভরাট। তাই, জলাভূমি সংরক্ষণের কাজটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি ত্রুটিমুক্ত গণনা এই সংরক্ষণের কাজটি সহজ করে তুলতে পারে। অথচ, ‘জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন, এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন’ বিভাগ সেই কাজে ব্যর্থ হয়েছে। ডাউন টু আর্থ পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সূত্রে জানা যায়, এই জলাশয় গণনায় দেশের সমস্ত গ্রাম ও শহরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের বহু নিখোঁজ বা আংশিক ভরাট হয়ে যাওয়া জলাশয় এই গণনায় অন্তর্ভুক্ত না-হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অথচ, এর পরও এই গণনাকে একটি জাতীয় গণনারই তকমা দেওয়া হচ্ছে।
কোন ধরনের জলা জায়গাকে জলাশয় হিসাবে বিচার করা হবে, আর কোনগুলিকে নয়, এ সম্পর্কেও এই গণনার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ভেড়িতে রূপান্তরিত কৃষিজমিগুলিকে জলাশয় বলে গণ্য করা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অন্য দিকে, নদী বা খাল জলাশয়ের মর্যাদা পাবে না, এ কথা রিপোর্টে আলাদা করে উল্লেখ করা হলেও, মজে যাওয়া নদী বা খাল বদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হলে, তা জলাশয়ের মর্যাদা পাবে কি না, সুস্পষ্ট ভাবে বলা নেই। ফলে নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার মজে যাওয়া মরালি নদী বহু জায়গাতে জবরদখল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই গণনায় ধরা না পড়ার ব্যাখ্যা নেই। পানিহাটির সোনাই এলাকার মানুষ যাকে নদী হিসাবেই জানেন, তারও একই দশা। পশ্চিমবঙ্গের জলাভূমি মানচিত্রে বিলগুলির গুরুত্ব অপরিসীম হওয়া সত্ত্বেও, এই গণনায় বিলকে জলাশয় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে কি না, স্পষ্ট নয়। জবরদখলের সংজ্ঞাতেও কিছু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কোনও জলাশয় বা তার অংশবিশেষ যদি সরকারি প্রয়োজনে ভরাট করা হয়, তখন তা জবরদখলের আওতায় পড়ছে কি না, এই রিপোর্টে তাও স্পষ্ট করে বলা নেই।
রাষ্ট্রের কাছে এই গণনাকে মান্যতার অর্থ যে, পরিবেশ ধ্বংসের পথে এক কদম এগিয়ে চলা, তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে না। জলাশয় সংখ্যায় শীর্ষ অবস্থানে থাকার কারণে বা জলাশয় ভরাট না-হওয়ার পর্যবেক্ষণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর একাংশ খুশি হলেও, এই গণনা রাজ্যের জলাশয়গুলির ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দেবে। তাই, ভারতের প্রথম জলাশয় গণনাকে বাতিলের দাবিটি চিন্তাশীল মানুষদের কাছে একটি ন্যায্য দাবি হিসাবেই বিবেচিত হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy