—ফাইল চিত্র।
ডেউচা-পাঁচামির কয়লা সম্ভারের উপরিভাগে ব্যাসল্ট পাথর উত্তোলন ও বিপণনের দায়িত্ব দেওয়া হবে কোনও বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাকে, জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার জন্য টেন্ডার ডাকা হবে। একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর অনুসারে, প্রস্তাবিত কয়লাখনি এলাকার ৩০৪২ একরের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে ৪২০ একরে কাজ শুরু হবে। আন্দাজ করা হচ্ছে, ১৪.২ কোটি টন পাথর মিলবে, যার বাজারদর ৫৬২০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন হল, বহুজাতিক সংস্থাটি পাথর তোলার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা ও শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন মানবে, তা নিশ্চিত করা যায় কী করে? তার একটা উপায়, যদি টেন্ডারেই এই শর্ত দু’টি ঢোকানো যায়। পাথর শিল্পে পরিবেশ ও শ্রমিকের সুরক্ষা যে উপেক্ষিত হয়, গত দু’তিন দশকে তা সারা দেশেই স্পষ্ট। পাথর শিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়া ধুলো— সে গ্র্যানিট, ব্যাসল্ট, কোয়ার্টজ়, যা থেকেই আসুক না কেন— আশেপাশের এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি, জল, বাতাস, মাটি, গাছপালা, সব কিছু। গত কয়েক বছরে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ রাজ্যের (যেমন, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া-সংলগ্ন রাজমহল পাথর এলাকা, ময়ূরাক্ষী নদী-তীরবর্তী রাঢ় এলাকা) এবং অন্যান্য রাজ্যের (ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বা দিল্লি-সংলগ্ন এলাকা) পাথরখাদান থেকে তথ্য নিয়ে দেখিয়েছেন যে, এই ধুলো এলাকার ষাট শতাংশেরও বেশি বাসিন্দার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। চাষ এবং ব্যবহারযোগ্য জলেরও ক্ষতি করছে। পাথরগুঁড়ো ফুসফুসে ঢুকে শ্রমিকদের একটা বড় অংশ সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত। এ রোগের ব্যাপকতা কতখানি, সরকারি ভাবে তার পরিসংখ্যান মেলে না। দশ বছরের পুরনো একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সারা দেশে অন্তত এক কোটি পনেরো লক্ষ শ্রমিক সিলিকোসিস-ঝুঁকিগ্রস্ত। এখন নির্মাণশিল্প বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পাথরের চাহিদাও বেড়েছে। কত শ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত, তাঁদের কত জন সিলিকোসিস-এ আক্রান্ত, বা হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত, তা জানা কঠিন।
দুর্ভাগ্য, পাথরকে এ দেশে ‘অপ্রধান’ খনিজ বলে ধরা হয়, যার ফলে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনগুলির প্রয়োগ নিতান্তই দুর্বল। সম্প্রতি অসমের বিজনি থেকে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের নিকটবর্তী কছুগাঁও পর্যন্ত জাতীয় সড়ক চওড়া করার বরাত পেয়েছিল দু’টি বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থা। তারা আলিপুরদুয়ারের রায়ডাক নদী থেকে পাথর তুলতে ও ভাঙতে শুরু করে। এই কাজের বিরুদ্ধে মে ২০২২ জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা হয়। দুই সংস্থা দাবি করে, যে শিল্পগুলিকে ‘পরিবেশের উপর প্রভাবের মূল্যায়ন, ২০০৬’-এর রিপোর্ট পেশ করতে হয়, স্টোন ক্রাশার তাদের মধ্যে নথিভুক্ত নয়। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের পোর্টাল-এ পাথরখাদানগুলির কাছ থেকে পরিবেশ-বিষয়ক অনুমোদন চাওয়ার ব্যবস্থাই নেই।
জাতীয় পরিবেশ আদালত অবশ্য এই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে, এবং জানিয়েছে যে, ওই দুই সংস্থাকে পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেট এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অথরিটি’-র থেকে যথাযথ ছাড়পত্র নিতে হবে। পরিবেশ আদালত এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একটি মন্তব্য উল্লেখ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, খনিজের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে (গয়নায় বসানো হবে, না কি রাস্তা বানানোর কাজে) তাকে ‘অপ্রধান’ ও ‘প্রধান’ হিসাবে ভাগ করার রীতি বিশ্বের কোনও দেশে নেই। এই ভাবনা ত্রুটিপূর্ণ। তাই পাথর শিল্পকেও কঠোর পরিবেশ-বিধির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
আশার কথা, মে ২০২৩ পরিবেশ আদালতের এই রায়ের ঠিক দু’মাস পরে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পাথরশিল্পের জন্য বিশেষ নিয়মাবলি প্রকাশ করে। সেখানে বিস্তারিত বলা হয়, পাথর কারখানাগুলিকে কী কী ব্যবস্থা রাখতেই হবে। তবে আশ্চর্য এই যে, এই প্রতিবেদনে সারা দেশের ২৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পাথরখাদান সম্পর্কে তথ্য থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গ সেখানে অনুপস্থিত! সম্প্রতি (৩ জানুয়ারি ২০২৪) শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে জানাতে হবে, জুলাইয়ের নির্দেশিকা জারির পরেও তারা পাথর শিল্পের কারখানাগুলিতে ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, ২০০৬’-এ নথিভুক্ত করা উচিত মনে করে কি না? এর ফলে আশা জাগে যে, পাথর শিল্প দ্রুত পরিবেশ নজরদারির আওতায় ঢুকে পড়বে।
সিলিকোসিস নিরসনে, এবং আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। লাগাতার আন্দোলনের মুখে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার সিলিকোসিস নীতি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। ফলে সমস্ত জেলায় সিলিকোসিস নির্ণয়ের জন্য পর্ষদ গঠিত হয়। ইতিমধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকশো শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে, রোগ নির্ণয়ের পর্ষদের কাছে (ডায়াগনোসিস বোর্ড) পেশ করতে বাধ্য হয়েছে। আশা জাগে, দশকের পর দশক ধরে ডেউচা-পাঁচামির বেআইনি পাথর ব্যবসার জন্য এলাকার মানুষ ও শ্রমিকদের উপর থেকে প্রাণঘাতী দূষণের ধূসর ছায়া এ বার উঠবে। এখনই দাবি করার সময়— প্রস্তাবিত টেন্ডারেই পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষার শর্ত জায়গা পাক, যাতে প্রতিটি বৃহৎ শিল্পোদ্যোগী শুরু থেকেই বিধিনিষেধ মানতে দায়বদ্ধ থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy