কোভিডের ভয়কে দূরে ছুড়ে ফেলে গ্লাসগো শহরের কুইন্স পার্ক ও তার আশপাশের অঞ্চল তখন উপচে পড়ছে সারা পৃথিবী থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষে। সমুদ্রের গর্জনের মতো প্রতিবাদ উঠছে কয়েক কিলোমিটার দূরে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের ব্যর্থতা নিয়ে, যেখানে তখন সারা পৃথিবীর তাবড় রাজনৈতিক নেতারা দিনরাত এক করে আলোচনা করেও কোনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছেন না। আন্দোলনের অন্যতম মুখ গ্রেটা থুনবার্গ ব্যঙ্গ করে যে আলোচনার নাম দিলেন ‘ব্লা ব্লা ব্লা’— অর্থাৎ যে আলোচনায় কথাই সার, কাজের কাজ কিছুই হয় না।
কথাটা মনে পড়ে গেল পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ আলোচনা পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার প্রাক্কালে, যার শুরু ১৯৭২ সালের ৫ জুন সুইডেনের স্টকহোম শহরে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ আলোচনা মধ্যবয়সে পৌঁছলেও, আদৌ কি তাতে কোনও কাজের কাজ হয়েছে, না কি আকচাআকচিতেই অধিকাংশ সময় চলে গিয়েছে? মানতেই হবে যে, স্টকহোম সম্মেলনের পর ভারত-সহ বহু দেশে পরিবেশ আইন ও প্রশাসন জন্ম নেয়। দিল্লির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ আইনের সংখ্যা গত পঞ্চাশ বছরে প্রায় আটত্রিশ গুণ বেড়েছে। প্রশ্ন হল, তার পর?
অভিজ্ঞতা বলে, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো সেই আইন ভাঙার সংখ্যাও রেকর্ড ভেঙেছে। বাজার অর্থনীতি আর চটজলদি পকেট ভরার রাজনীতির যুগলবন্দিতে আইনগুলি অধিকাংশ সময়েই অকেজো হয়ে থেকেছে— মাঝেমধ্যে কোনও পরিবেশবিদ বা ব্যতিক্রমী কোনও আমলার চেষ্টায় আদালত কোনও কোনও বিষয়ে বাদ সেধেছে! প্রসঙ্গত প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এক বার বলেছিলেন যে, পরিবেশের ক্ষেত্রে ‘ল আছে, অর্ডার নেই’। এটাই সার কথা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কিছু আলটপকা ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুখে পরিবেশের পক্ষে কথা বলেন অধিকাংশ রাজনীতিক বা আমলাই। কিন্তু তাঁদের অনেকের মনেও ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’-এর আসন অক্ষয়। তাই নিয়মকানুনকে থোড়াই কেয়ার করে প্রতিনিয়ত অরণ্য সাফ হয়ে যাচ্ছে। ২০৫০ সালে হয়তো প্রতি পাঁচটি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে একটিতে তীব্র জলসঙ্কট দেখা দেবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আদৌ এই পৃথিবী কয়েক দশক পরে বাসযোগ্য থাকবে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। পৃথিবীর প্রতি দশ জন মানুষের মধ্যে ন’জন বায়ুতে থাকা সবচেয়ে ক্ষতিকর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পিএম ২.৫ কণার দূষণে আক্রান্ত। ১৯৭০ থেকে ২০১৯ অবধি ১১,০০০ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে বিশ্ব জুড়ে; যার ফলে মারা গিয়েছেন প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। আগে যে মাপের বিপর্যয় প্রতি দশ বছরে এক বার হত, তা এখন প্রায় প্রতি বছরই হাজির হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি পড়ছে গরিব মানুষের উপর। আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জের এ বারের পরিবেশ দিবসের স্লোগান ‘শুধুমাত্র একটি পৃথিবী’ বলে চিৎকার করলেও সেই ‘এক’ পৃথিবীর মধ্যে অনেক পৃথিবীর বাস!
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে এটা এই দেশেরও ছবি। তাই পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি আর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েও এই মুহূর্তে দেশের প্রতি চার জনের এক জন সরকারি ভাবে ‘গরিব’, পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অধিকাংশ সরকারি প্রকল্প খুঁড়িয়ে চলছে, নদীগুলির প্রায় চল্লিশ শতাংশ দূষণে আক্রান্ত। এর ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মৎস্যজীবীর ভবিষ্যৎ। দেশের সমুদ্রতটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি গত পঞ্চাশ বছরে হয় সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে, অথবা যেতে চলেছে। ২০৩০ সালে হয়তো বা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জঙ্গল ‘ক্লাইমেট হটস্পট’-এ রূপান্তরিত হবে। এই তালিকা অন্তহীন।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তথৈবচ। সুস্থায়ী উন্নয়নের পনেরোটি মাপকাঠির মধ্যে রাজ্যে যেগুলি পরিমাপ করা হয়, তার মধ্যে দশটিতেই পশ্চিমবঙ্গ ‘টার্গেট’ থেকে দূরে। ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে অধিকাংশের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে যেটা ভাবার তা হল— দেশ তথা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম ক্লাইমেট হটস্পট বলে খ্যাত পশ্চিমবঙ্গ ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’ বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজের নিরিখে ১০০-র মধ্যে স্রেফ ৩৯ পেয়েছে!
স্পষ্টতই পরিবেশ দিবসে আর একটিও স্লোগান দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। প্রসঙ্গত ১৯৭৪ সাল থেকে এই বছর অবধি ‘শুধুমাত্র একটিই পৃথিবী’ বা সমজাতীয় স্লোগান দেওয়া হয়েছে মোট ন’বার, এমনকি ১৯৭৪ সালের প্রথম স্লোগানটিও ছিল হুবহু এক। কাজের কাজ যে বিশেষ কিছুই হয়নি, তা একই স্লোগানের পুনর্ব্যবহারে স্পষ্ট। আসলে চাই এমন একটা বাজার তৈরি করা, যাতে পরিবেশ নিয়ে চর্চা চলতে পারে, রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনিক আধিকারিকরা চান বা না চান। বিষয়টা তখন সামাজিক মূলস্রোতে এসে পড়বে।
এটা মানতে হবে, বেশ কিছু দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ আদালত এ বিষয়ে একটা দরজা খুলেছে। চাই সেই ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সিআরপিসি-র (ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর কোড) ধাঁচে বিস্তারিত ইসিআরপিসি বা এনভায়রনমেন্টাল ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর কোড-এর প্রবর্তন; এবং পরিবেশ থানা তৈরি, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন-সহ বায়ুদূষণ বা বালি তোলা— যাবতীয় পরিবেশ অপরাধের ক্ষেত্রে আক্রান্ত মানুষ সুরাহা পান। গতানুগতিক ভাবে পরিবেশ দিবস শুধুমাত্র বক্তৃতা, স্লোগান আর প্যাকেটে আঁকতে থাকলে তাকে ‘ব্লা ব্লা ব্লা’ বলা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না! দেশের প্রথম পরিবেশ মন্ত্রী, দেশের প্রথম পরিবেশ আদালত তৈরি করা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কি এই বিষয়ে আরও এক বার ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’ বাক্যটি মনে করিয়ে দিতে পারে না?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy