Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Environment

পুুজো আর আমাদের পরিবেশ  

প্যান্ডেল এখন শিল্পভাবনার উদ্‌যাপন, পুজো এখন হপ্তাব্যাপী চলমান, রাজ্যব্যাপী বিস্তৃত চারুকলা শিল্পপ্রদর্শনী, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যবাহার— ধর্ম সেখানে অনুষঙ্গ, আধারমাত্র।

—ফাইল চিত্র।

ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৮
Share: Save:

কলকাতায় প্রতি বছর বর্ষার পর পরই আসে ডেঙ্গির মরসুম। বছর-বছর তার বাড়বাড়ন্ত হয়েই চলেছে। আর তার কিছু দিন পরেই আসে পুজো, তারও আকার আর চাকচিক্য বেড়ে চলেছে। একটা সময় ছিল, যখন দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের থেকে বিয়ে বা অন্নপ্রাশনের প্যান্ডেলের তফাত করা যেত না। সেই সাবেক পুজো যে কবে ঝাঁপ দিল এই থিমপুজোর রমরমায়, তার সুনির্দিষ্ট সময়কাল আজ আর ঠিক করে ঠাহর করা যায় না। তবে মুনশিয়ানা এখন বেড়েছে বিস্তর, সৌকর্য-সৌন্দর্যের সৃজনে, ভাবনার অভিনবত্বে। প্যান্ডেল এখন শিল্পভাবনার উদ্‌যাপন, পুজো এখন হপ্তাব্যাপী চলমান, রাজ্যব্যাপী বিস্তৃত চারুকলা শিল্পপ্রদর্শনী, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যবাহার— ধর্ম সেখানে অনুষঙ্গ, আধারমাত্র।

একই সঙ্গে বেড়েছে খাদ্যরসিকদের আনন্দ। আগে হাতে-গোনা দামি রেস্তরাঁ আর কিছু হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা পাড়ার দোকানে সান্ধ্যকালীন রোল বা মোগলাই, এই ছিল এক সময়ের উৎসব যাপন। এখন হরেক রকম অ্যাপে অজস্র খাদ্যসম্ভার, আধুনিক ডেলিভারি ব্যবস্থা প্লাস্টিকের বা থার্মোকলের বাক্সে করে দ্রুতগতিতে খাবার পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে, থরে-থরে। সব মিলিয়ে উৎসব এখন কার্নিভাল। পুজোর শেষে সত্যিকারের ‘কার্নিভাল’, যা টিভিতে দেখানো হয় সরাসরি।

আর এই উদ্‌যাপনের পিছনে কী পড়ে থাকে? প্রতিমা বিসর্জন হয়, প্যান্ডেল ভেঙে যায়, পড়ে থাকে রাশি রাশি সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, চিপসের প্যাকেট, বাঁশের খুঁটি, ভাঙাচোরা মৃৎপাত্র। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে ডেঙ্গি বা মশার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। যে কোনও ধরনের খোলা পাত্রে পরিষ্কার জল জমলেও তা হয়ে ওঠে মশার আদর্শ বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র, অপরিষ্কার জল হলে তো কথাই নেই। খাবারের সাদা কৌটো পড়ে থাকে যত্রতত্র, একটু বৃষ্টি হলেই জমে জল। আর একটু জল থাকলেও তাতে এডিসের লার্ভা কী পরিমাণে থাকতে পারে, হিসাব করা যেতেই পারে। আর এতে থাকে প্রচুর পরিমাণে লার্ভা, যা থেকে ল্যাবে মশা জন্মানোর পরে মাইক্রোস্কোপে দেখা যেতে পারে তার মধ্যে আছে ডেঙ্গির ভেক্টর; ভেক্টর মানে যারা ভাইরাস বহন না করলেও বহনে সক্ষম।

জল জমে মাটির পাত্রে, মিষ্টির ভাঁড়ে, ডাবের খোলায়, কিংবা আপাত-নিরীহ বাঁশে। বেড়ার বাঁশে জল তো বটেই, পুজোর প্যান্ডেলের বাঁশেও এডিসের লার্ভার রমরমা। পুজোর মরসুমে, আগে এবং পরে, বাঁশ তো যত্রতত্র পড়ে থাকে। নানা জায়গায় ত্রিপলের ভাঁজেও জমে থাকে জল, সেও মশার সম্ভাব্য আবাদভূমি।

প্রতি বছর ডেঙ্গির বাড়বৃদ্ধির পিছনে এ সবের অবদান কিছু কম না। দেখেশুনে মনে হয়, পুজো এক ক্ষণিকের ব্যাপার, আনন্দটুকু করে নিলেই জীবন সার্থক, তার আগের বা পরের কিছু নিয়ে আমাদের আর মাথাব্যথা নেই। বৃহত্তর সমাজজীবনের সঙ্গে পুজো-উৎসব এবং তার আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলিকে যোগ করা, এবং সমাধান করার কোনও ইচ্ছে নেই।

সমস্যাটা চিন্তা প্রক্রিয়ারই মনে হয়। পাঁচ দিন, বড়জোর দু’সপ্তাহে ভেঙে ফেলা হয় তাবৎ শিল্পকর্ম। এত শিল্পকর্ম দিনশেষে স্রেফ আবর্জনাস্তূপে জমা হয়ে মশার বংশবৃদ্ধিতেই কাজে লাগে। অথচ সমস্ত সরঞ্জাম আর ব্যবহৃত জিনিসের পুনর্ব্যবহারের একটা সুনির্দিষ্ট ভাবনা থাকলে তা এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় হতে পারত। কিছু বাছাই করা জায়গায় প্যান্ডেল মিউজ়িয়ম করে সেখানে সংরক্ষণ করা যেতেই পারত, হতে পারত ছবি দিয়ে ভার্চুয়াল মিউজ়িয়ম। তার সঙ্গে প্যান্ডেলের টুকরোটাকরা মোটিফ, যা আবার ব্যবহার হবে না কোনও ভাবেই, যাদের একমাত্র গন্তব্য গঙ্গা কি আঁস্তাকুড়, সে সব রেখে দিয়ে বা কিনে নিয়ে বাড়ি, পাড়া, আবাসন, ছোট-মেজ-বড় রাস্তা, রাস্তার ধার জুড়ে দেওয়াল, সেতু বা উড়ালপুলের দু’বাহু, আনাচকানাচ, এ সব দিয়ে সাজিয়েই ফেলা যায়, পরের পুজো অবধি।

বিষয়টা ভেবে দেখা যেতে পারে না কি? ঘটা করে আলাদা ব্যয়সাপেক্ষ সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের প্রয়োজন হয় না তা হলে, আর শহরও অনেকাংশে রক্ষা পায় ধ্বংসস্তূপের আবর্জনা থেকে। আর যাঁরা এত সৃজনশীলতার ছাপ রাখেন প্যান্ডেল-প্রতিমায়, তাঁদের ভাবনাচিন্তনে যে সংরক্ষণ আর সৌন্দর্যায়ন নিয়ে এ বিষয়ে আরও অনেক অভিনব আইডিয়ার জন্ম হতে পারে, সে তো বলা বাহুল্য।

পুজোয় এখন প্রতিযোগিতার ঢল। এই প্রতিযোগিতা শুধু এই ক’দিনের পুজো আর প্যান্ডেল নিয়েই কেন, পুজোর পরেও সারা বছর ধরেই হোক না কেন, পাড়া বনাম পাড়া, আবাসন বনাম আবাসন, সৌন্দর্য, পরিবেশ সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, সুরক্ষা— সব কিছুর নিরিখেই বিচার হোক। থাকুক স্বাস্থ্যবান্ধব পাড়ার পুরস্কারও। বিশেষ করে এই পুজোর ক’দিনের সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, চিপসের প্যাকেট, পড়ে থাকা বাঁশের খুঁটি কারা কত দ্রুত এবং সহজে সরিয়ে ফেলল— তাই নিয়ে হোক সেরা হওয়ার লড়াই। পুজোর সৌন্দর্যায়ন পুজো-পরবর্তী পাড়ার কেমন সৌন্দর্যবৃদ্ধি করছে, তাতে পয়েন্ট যোগ হোক। আর কোনও পাড়ায়, আবাসনে, মশার লার্ভা জমার মতো জল কিংবা তাতে লার্ভা পাওয়া গেলে থাকুক পয়েন্ট কাটার বন্দোবস্ত। তার উপর সরকারি অনুদান বা পুরস্কার পাওয়া না-পাওয়া নির্ভর করুক। জনস্বাস্থ্যের একটা বড় দিক হল, ঘটনা ঘটার আগেই তার প্রতিরোধ করা। আর একটা দিক হল, জনতাকে স্বাস্থ্যের উদ্যোগে অংশীদার করে তোলা। এই দু’টো দিকই থাকে এই ব্যবস্থায়।

শুধু পাড়াই নয়, প্রতিযোগিতা আসুক মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশনের নানা ওয়ার্ডের মধ্যেও। পাড়া, আবাসনের কোণে কোণে পড়ে থাকা আবর্জনাস্তূপ বরাবরের ডেঙ্গি বা অসুখের আঁতুড়ঘর না হয়ে নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় আসুক। নানাবিধ প্রকল্পের জন্য জমে থাকা জল, আবাসন তৈরির কাজে নানা পাত্রে জমা জল, জল সঞ্চয়ের নানা ছোট বড় খোলা পাত্রে জমা জল— এ সব পরীক্ষা করা হোক লার্ভার জন্য, আর তার উপর মূল্যায়ন হোক সেই ওয়ার্ডের। এডিস লার্ভা সার্ভের জন্য স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নানা সূচক তো আছেই, তার উপর নির্ধারিত হোক কার কত নম্বর।

এই পাঁচ দিনের রেশ থেকে যাক সম্বৎসর। মায়া কিছু রয়েই যাক বছরভর।

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Durga Puja 2023 Dengue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy