যে সংস্থা বলেছিল যোগ্য আর অযোগ্যের ভিতরে সীমারেখা টানা সম্ভব নয়, সেই সংস্থাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে বলে এসেছে, প্রায় উনিশ হাজার যোগ্য আর সাত হাজার অযোগ্য। ফলত একটি স্থগিতাদেশ পাওয়া গেছে, যা আরও মাস দুয়েক কাউকে অক্সিজেন দেবে, কাউকে দেবে না। কিন্তু সেই সময়ে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এই মুচলেকা দিতে হবে যে, তাঁরা যদি ভবিষ্যতে অযোগ্য প্রমাণিত হন, তবে মাসের শেষে অ্যাকাউন্টে ঢোকা বেতন ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন। এই মুচলেকা দেওয়া নিয়ে সমাজ প্রায় নীরব।
ছাত্রছাত্রীরা, ঘরে, পাড়ায়, টিউশন পড়তে গিয়ে অহরহ শুনছে যে, ব্ল্যাকবোর্ডে যাঁরা চক ঘষছেন তাঁরা সবাই চক হাতে নেওয়ার যোগ্য নন। খোদ এসএসসি স্বীকার করে নিয়েছে যে, চালের ভিতর কাঁকর মিশে আছে। তার মানে বেছে নিয়ে, সেদ্ধ করতে হবে। আর এই যে মানুষগুলো দিনরাত সেদ্ধ হবেন? ক্লাসে ঢুকে নিজের অজানতেই দ্বিধাগ্রস্ত হবেন, স্টাফরুমে বয়স্ক সহকর্মীদের মুখ থেকে শুনতে বাধ্য হবেন, আগে সব ভাল না থাকলেও, ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হওয়ার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। শুনতে শুনতে, দগ্ধ হতে হতে আবারও নিজের কাজটুকু করার চেষ্টা করে যাবেন, যতক্ষণ না সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিচ্ছে। সেই রায়ে যাঁরা যোগ্য বিবেচিত হবেন, তাঁদেরও কানে আসবে যে, ‘কপাল ভাল, তাই’। কিন্তু যাঁরা অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হবেন? যাঁদের সম্পর্কে অবলীলায় কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করবেন যে, পানীয় জলের লাইনের থেকে নিকাশির লাইন আলাদা করতেই হবে?
কী করবেন, কোথায় যাবেন তাঁরা? দুর্যোধন যে দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে লুকিয়ে ছিল, সেটা তো অনেক বড় আকারের, এত দিনে নিশ্চয়ই বুজিয়ে বহুতল উঠে গেছে। তবে কি পয়ঃপ্রণালীতেই মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবেন? কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় বন্দি যেমন বাইরে থাকা সবার দিকে প্রতিপ্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “স্বাধীন, স্বাধীন”, তেমন করেই জানতে চাইবে না তো “যোগ্য, আর সবাই যোগ্য?”
উত্তর আমাদের কাছে না থাকলেও, এই যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে আমাদের যেতেই হবে। আর যেতে যেতে আবারও মনে পড়তে পারে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশের বিপুল জনপ্রিয় প্রথা ‘লাবাশা’র কথা। সেই প্রথা অনুযায়ী, একটি গ্রামের কারও বাড়ি থেকে কিছু চুরি গেলে সারা গ্রামের মানুষ সমবেত হন। কোনও একটি জায়গায় এবং একটি বাচ্চাকে ভরপেট মদ্যপান করিয়ে বলতে বলা হয়, চোর কে? বাচ্চাটি যার দিকে আঙুল তুলে দেখায়, তাকেই চোর বলে মেনে নেন গ্রামের সবাই এবং কঠিন-কঠোর শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে তার উপর। এ রকম এক যুবকের খোঁজ পেয়েছিলাম, যে ছোটবেলায়, ওই অবস্থায় পড়ে নিজের বাবার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল। কারণ ভিড়ের মধ্যে সে কেবল নিজের বাবাকেই চিনত। ওই আঙুল তোলার ফলে, শিশুটির বাবার একটি হাত কাটা যায়। সেই বিষয় নিয়ে আগেও লিখেছি। কিন্তু আজ এই বিচারে ব্যস্ত সমাজকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, টাকা দিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা ওই নেশা করা শিশুর মতো যদি নিজের বাবা-মা-প্রতিবেশীদের আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, “এদের জন্যই আমি আজ অযোগ্যের তালিকায়; এরাই বার বার করে আমাকে বলেছে যে আর সবাই ব্যবস্থা করে ফেললেও, আমি পারছি না কেন?”
ওই প্রশ্ন থেকে, এই সত্য বেরিয়ে আসবেই যে, অযোগ্য আসলে মানুষ হয় না। অযোগ্য হয় একটা সিস্টেম। আর সেই সিস্টেমের চক্র, সুদর্শন চক্রের মতোই ক্ষমতাসম্পন্ন এক কুদর্শন চক্র। টাকা যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা তো অন্যায় করেছেনই, কিন্তু কেন দিলেন তাঁরা টাকা? কারা নিল সেই টাকা? কারা পাড়ায় পাড়ায় রটিয়ে দিল যে, অমুক দাদার কাছে গেলে চাকরি পাকা? এই পরিবর্তনটা বিগত এক যুগে ঘটে গেল বাঙালি সমাজে। তার আগে সরকারি, কিংবা বিদ্যুৎ বা দুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ করা কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লোকাল কমিটি থেকে ঠিকুজি-কুলজি মিলিয়ে নিয়োগ হত। কিন্তু এ ভাবে, ‘চাকরি আছে, লাগলে বলবেন’ কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
কল্পনাতীত ব্যাপারটা ঘটেই যখন গেল, তখন সেই বাস্তবকে মেনে নিয়ে যাঁরা নিজেদের জীবন গোছানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় কি? নেপাল থেকে চিনা জিনিস কিনে নিয়ে এসে কলকাতায় বিক্রি করত আমাদের পাড়ারই এক দাদা। আমরাও কিনেছি। সে এক বার গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ায় আমরা ভীষণ অবাক হয়েছিলাম ওই কাজটা অপরাধ জেনে। মেধাবী ছেলে-মেয়েরা তাঁদের প্রাপ্য চাকরি না পেয়ে বছরের পর বছর রাস্তায় বসে আছেন যখন, তখন, “কথা শুনবি, না রাস্তায় বসবি?” বলে কোটি-কোটি টাকা সমাজ থেকে তুলে নিল যে চক্র, তাকে ‘রাজনৈতিক’ বলে এড়িয়ে যাওয়া বা গালাগালি দেওয়া দুটোই অন্ধের হস্তী দর্শন হবে। সমাজের ভিতরে ঘটে চলা এই অপরাধ স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হল কী ভাবে, সেটাই মূল কথা।
শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটা কত দাঁড়াবে, এসএসসি-র বলা ছয়, না কি সিবিআইয়ের আট হাজার, না কি আরও বেশি, আমরা জানি না। সেই সব ছেলেমেয়ের প্রত্যেকের থেকে কত লক্ষ করে নেওয়া হয়েছিল মাথাপিছু, মোট দুর্নীতি পাঁচশো না কি হাজার কোটির, তাই নিয়ে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রভূত হইহল্লা হয়ে থাকে। তাতে এমন কথাও উঠে আসে যে, অতিরিক্ত পদ তৈরি করে অনেক মানুষকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারটা এই প্রথম ঘটেনি। কথাটা সত্যি। কয়লাখনিগুলি যখন জাতীয়করণ হয়েছিল, তখন কয়লাখনিতে কাজ করা মানুষের সংখ্যা রাতারাতি প্রায় পঁচিশ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। ‘সরকারি চাকরি’ হয়ে যাবে এই উদ্দেশ্যে কোলিয়ারির বাবুরা চেনা-অচেনা বাড়ি থেকে প্রায় লোক ডেকে এনে রেজিস্টারে নাম তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু একে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ বলতে পারব না, ‘পাইয়ে দেওয়ার জননীতি’ বলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষপিছু আউটপুট কমে গিয়েছিল ‘কোল ইন্ডিয়া’র। কিন্তু কোথাও, কারও ওএমআর শিট নষ্ট করে দিতে হয়নি। ও-দিকে শিক্ষাক্ষেত্রে, একের প্রাপ্য চাকরি অন্যকে দেওয়ার নামে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে, তাতে অনেক গভীর একটি বিশ্বাস টলে গেছে। আর তা হল, শিক্ষকতার চাকরি (যাকে পুরাকালে ব্রত মনে করত কেউ কেউ) সৎ ভাবে পাওয়া যায়।
টাকা দিয়ে কেউ চাকরি পেয়েছেন, সেটা যদি যিনি টাকা দিয়েছেন তিনি নিজে না বলেন, তবে কী ভাবে প্রমাণিত হবে? তর্কের খাতিরে যদি ধরা যায় যে, অযোগ্যদের বেছে বেছে বরখাস্ত করা সম্ভব, তার পর কী হবে? ওই মানুষগুলো যে ব্যাঙ্কঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন, কে তা শোধ করবে? যাঁদের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তাদেরও তো টাকার অভাবে ছাড়িয়ে আনতে হবে। কী কারণ দর্শানো হবে সেই শিশুদের? বাবা কিংবা মা, অথবা দু’জনেই অসৎ পথে চাকরি পেয়েছে, তাই শিশুটিকে শাস্তি পেতে হবে? সেই মুহূর্তেই শিশুটির কাছে এই সমাজ ‘অযোগ্য’ হয়ে উঠবে না? সে-ও ওই আফ্রিকার শিশুর মতোই আঙুল তুলে দেখাবে না নিজের বাবা কিংবা মাকে?
ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা-য় বিজন ভট্টাচার্য অভিনীত চরিত্রটি বলে ওঠে “আই অ্যাকিউজ়”, আর, “কারে” জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তর দেয়, “কারেও না”। যোগ্য-অযোগ্য খুঁজে বার করার এই মহারণে বলি হয়ে যাওয়া কোনও শিশু হয়তো ভবিষ্যৎ হারিয়ে বলে উঠতে পারে, “আই অ্যাকিউজ়। সবাইকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy