Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Qatar

চকমকে বিশ্বকাপের আড়ালে

কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্যে একরাশ অসঙ্গতি চোখে পড়তে বাধ্য। শুধুমাত্র কাতারের গরমের কথা মাথায় রেখে বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতে।

সাতটি স্টেডিয়াম-সহ নানা নির্মাণ কাজে ২০১০-২০ সময়কালে নাকি অন্তত সাড়ে ছ’হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে।

সাতটি স্টেডিয়াম-সহ নানা নির্মাণ কাজে ২০১০-২০ সময়কালে নাকি অন্তত সাড়ে ছ’হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্রনাথ আইচ
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৬:২৭
Share: Save:

তবে কি মৃত্যু উপত্যকায় চলছে আনন্দযজ্ঞ? কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে এমনই প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু মিছিল নিয়ে কথা কিন্তু শুরু হয়েছে বহু আগে। সাতটি স্টেডিয়াম-সহ নানা নির্মাণ কাজে ২০১০-২০ সময়কালে নাকি অন্তত সাড়ে ছ’হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। এর মধ্যে রয়েছেন ভারতের ২৭১১ জন, নেপালের ১৬৪১ জন, বাংলাদেশের ১০১৮ জন, শ্রীলঙ্কার ৫৫৭ জন। পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি শ্রমিক মারা গিয়েছেন অন্তত ৮২৪ জন। ফিলিপিন্স বা কেনিয়ার মতো দেশ থেকে আসা শ্রমিকের তথ্য মেলেনি, অতএব মোট মৃতের সংখ্যা আরও বেশি, দাবি উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ১৫,০২১।

কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্যে একরাশ অসঙ্গতি চোখে পড়তে বাধ্য। শুধুমাত্র কাতারের গরমের কথা মাথায় রেখে বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতে, কারণ গ্রীষ্মে কাতারের গড় তাপমাত্রা হামেশাই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে উঠে যায়। তা বলে পরিকাঠামো নির্মাণ তো গ্রীষ্মে বন্ধ থাকেনি। প্রচণ্ড গরম আর কর্মস্থলে উপযুক্ত সুরক্ষার অভাব শ্রমিকদের কতটা বিপর্যস্ত করেছে, মৃত্যুর সংখ্যা তার ইঙ্গিত মাত্র। তার উপর, সারা বিশ্ব থেকে আসা সমর্থক, সাংবাদিক, কর্মকর্তারা যে সব রাস্তা দিয়ে স্টেডিয়ামে যাবেন, সেই সব এলাকায় বসবাসকারী শ্রমিকদের দু’ঘণ্টার নোটিসে জায়গা খালি করে দেওয়ার ফতোয়াও জারি করেছে কাতার সরকার। ছবিটা মিলিয়ে নিতে পারি— ২০১৭’র যুব বিশ্বকাপের সময় সল্টলেকে হকার উচ্ছেদ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরকালে আমদাবাদে পাঁচিল দিয়ে গরিব মানুষদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টার সঙ্গে।

কাতারে অভিবাসী শ্রমিক প্রায় ৩৮ লাখ, জনসংখ্যার ৮৫%। কাতার-সহ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে তেল, গ্যাসের পাইপলাইন ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত কয়েক লাখ প্রবাসী ভারতীয় নির্মাণ শ্রমিক। কিন্তু এ বিষয়ে ভারতীয় দূতাবাসগুলোর কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই। দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশনের রিপোর্টে (২০০২) প্রস্তাব ছিল, যেন সব দূতাবাসেতে অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি দেখার জন্য একটা পৃথক সেল থাকে, এবং পূর্ণ সময়ের আধিকারিক নিয়োগ করা হয়। সে সব প্রস্তাবই থেকে গিয়েছে।

কাতারে শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন বিমার মতো সুবিধাও নেই। ২০১৬ অবধি বহাল ছিল ‘আল-কাফালা’ নামে একটি ব্যবস্থা, যার বলে নিয়োগকর্তার অনুমোদন ছাড়া দেশত্যাগ নিষিদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার চাপে এই ব্যবস্থা উঠেছে, পরিযায়ী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য নতুন আইন হলেও সেগুলি সুরক্ষায় কার্যকর নয়।

অন্য দেশের কাছে ভারতীয় শ্রমিকদের সুরক্ষা দাবি করলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, ভারত সরকার তার নিজের শ্রমিকদের কতটুকু সুরক্ষা দিতে পেরেছে? ২০১০ সালে কমনওয়েলথ গেমস-এর সময়ে দিল্লির গেমস ভিলেজে দেওয়াল ধসে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। তবে নির্মাণ-শ্রমিকের মৃত্যু ভারতে রোজ ঘটছে। ‌শুধুমাত্র কোভিডের সময়ে অর্থাৎ বিগত দু’বছরে অন্তত তিরিশটা শিল্প দুর্ঘটনায় ৭৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে বিশাখাপত্তনমে গ্যাস লিকের ঘটনা বা অসমের বাগজান তৈলক্ষেত্রে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সংবাদেও এসেছে।

আইআইটি দিল্লির রিপোর্ট (২০১৯) বলছে, প্রতি বছর ভারতের প্রায় ৪৮ হাজার শ্রমিক কাজ করতে করতে দুর্ঘটনায় মারা যান, এঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নির্মাণ-শ্রমিক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রতি দিন প্রতি এক হাজার নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে ১৬৫ জন আহত হন। নিরাপত্তা বিষয়ে মালিক ও কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যই এর কারণ। অথচ কৃষিক্ষেত্রের পরে সর্বাধিক মানুষ জড়িত নির্মাণ শিল্পে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার রিপোর্ট (২০১৬-১৭) অনুযায়ী নির্মাণ শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি। এই অসংগঠিত শ্রমিকরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য দাবি করতে পারেন না। নেই সুরক্ষার সরঞ্জাম, নেই বিমা। যেখানে সস্তা শ্রমের বিপুল বেকার বাহিনী মজুত, সেখানে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে মালিকদের ভারী বয়েই গেছে। মৃত্যু শুধুই কতকগুলো সংখ্যা। যেমন, নির্মাণ-শ্রমিকদের মধ্যে ৬০% মারা যান উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে, ২৫% ছাদ বা দেওয়াল চাপা পড়ে, ১৫% বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।

দু’একরের চেয়ে বড় নির্মাণক্ষেত্রে, এবং ৩০-৪০ মিটার উঁচু বিল্ডিং তৈরি হলে নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষাজনিত যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা। ২৫ কোটির বেশি অঙ্কের প্রজেক্টে শ্রমিক সুরক্ষা বিধি মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে নজরদারি চালানোর নিয়ম রয়েছে নির্মাণ বোর্ডের। পরিদর্শন হয় না বললেই চলে। পর্যাপ্ত ইনস্পেক্টর না থাকায় শ্রম দফতরও অসহায়।

উৎসবের ঔজ্জ্বল্য দেখে অভিভূত না হয়ে পশ্চিমি মিডিয়া তো শ্রমিক সুরক্ষার প্রশ্নগুলো তুলেছে। আমরা তুলতে পারি না কেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Qatar Migrant Workers Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy