গরুর রচনা লেখা সহজ নয়। কেন? কারণ, গরুর রচনা লিখতে গেলে বলতে হবে ইঁদুরের কথা। এবং বেড়ালের কথা। মনে করে দেখুন, গোমাতা-ভজনাকারী দলকে আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘৫-১০ টাকা তুললে তাকে তোলাবাজ বলে। যাঁরা কোটি কোটি টাকা তোলেন? দেশ কে দেশ বিক্রি করে দেন। কাটমানি খান। তাঁরা কি ক্যাটমানি খান না র্যাটমানি? নেংটি ইঁদুরের দল সব। বড় বড় কথা।” এখন র্যাটমানি কী, ক্যাটমানি কী? এখন বেড়াল ইঁদুর ধরে, ইঁদুরকে আপনি চোর বলতে পারেন, তা হলে বেড়াল পুলিশ। তা হলে পুলিশ পার্টি কি এখন চোরের পার্টি হয়েছে? বিষয়টা বেশ গোলমেলে। তিনি এক বার বললেন ইঁদুর, আর এক বার বললেন বাঘ বেড়ালকে ভয় পায় না। তা হলে ইঁদুর না বেড়াল? ব্যাপারটা দাঁড়াল কী?
কেউ কেউ বলবেন, ব্যাপারটা বেশ সোজা। শুধু মাথায় রাখতে হবে, বেড়াল ইঁদুর ধরে। এবং চিনের সংস্কারক মহামতি বলেছিলেন, রং যা-ই হোক, বেড়াল ইঁদুর ধরতে পারলেই হল।
সুতরাং, মোটা বেড়াল না রোগা, পাংশু বেড়াল না লালচে, সে সময়মতো নখদাঁত বার করে না সময়মতো ঢুকিয়ে রাখে, তার পর সে বেড়াল বাঘ হয়ে তোমাকে খাবে কি না, দেখার দরকার নেই। ইঁদুর ধরতে পারলেই বেড়ালকে স্টেজে তুলে দাও। র্যাট-ক্যাট-কাউয়ে সে এক কিম্ভূতকিমাকার গল্প।
অতএব বুঝতেই পারছেন, গরুর রচনা লেখা সহজ নয়।
গরু বললে প্রথমে বলতে হবে কী গরু— জার্সি কাউ না হরিনাভি গরু। মাঠের ঘাস খেয়ে, বনের মোষ তাড়িয়ে, গুচ্ছের মশার কামড় খেয়ে খাটালে নোংরা মেখে দাঁড়িয়ে থাকা গরু না আশ্রমের চকচকে গরু? তার পর শান্ত গরু না অশান্ত গরু? অর্থাৎ, দুপুরবেলা ডালা সাজিয়ে, খুর ছুঁয়ে প্রণাম তথা খুর-নাম করতে গেলে চাট মারবে কি না, রথ বার করলে রথের রঙিন কাগজ, শিকলি খেয়ে ফেলবে না কি টুং টুং করে ঘণ্টা দুলিয়ে মানুষের পিছে পিছে যাবে? নাহ্। গরু আগে আগে যায়, মানুষ পিছনে পিছনে যায়। গরুর গাড়ি বলুন আর লাঙল দেওয়াই বলুন, মানুষ ভাবত, সে গরুকে চালাচ্ছে, কিন্তু মোদীতান্ত্রিক দেশে বোঝা যাচ্ছে, গরুই মানুষকে চালাচ্ছে। তাতে অসুবিধে নেই, কারণ, গরু ঘাস খায়, মানুষও ঘাস খায়। (জীবনানন্দ দাশ মহাশয়কে আত্মস্থ করা খুব কঠিন, নইলে “আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি,” লাইনটা ধরে ‘ঘাস’ কবিতাটি জাতীয় কবিতা হতে পারত।) গরুকে ঠুলি পরালে সে বাঁধা রাস্তায় চলে, মানুষ নিজেই ঠুলি পরে বাঁধা রাস্তায় চলে। সুতরাং গরুর পিছনে যেতে অপমানিত বোধ করবেন না।
এই গরুর সূত্রেই মনে পড়ে পদিপিসিকে। লীলা মজুমদারের পদিপিসিকে। পদিপিসির বর্মিবাক্স হারিয়ে গিয়েছিল বলে উনি গরুর ন্যাজ তুলে বাক্স খুঁজছিলেন। ভাবার কারণ নেই যে গরুর দুধে সোনা খোঁজার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। সোনা তো সোনা, গরুর ন্যাজে মস্তিষ্ক বাঁধা রাখলে সোনা, মণিমাণিক্য, পায়রার ডিমের মতো চুনি, নীলা খোঁজারও দরকার পড়বে না। সে যা-ই হোক, পদিপিসি যেই না গরুর ল্যাজ তুলে বাক্স খুঁজতে গেলেন, দুই গরু মারল কষে হাঁটুতে। পদিপিসি এবং পিসিদের মাহাত্ম্য যদিও তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না। কারণ, বেঁটেখাটো বিধবা মানুষ পদিপিসির ‘গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর মনে জিলিপির প্যাঁচ।’ সিংহের মতো তেজও ছিল তাঁর। রাঁধতেনও চমৎকার। এক বার ঘাস দিয়ে এইসা চচ্চড়ি রেঁধেছিলেন যে ‘বড়লাট খেয়ে বলেছিলেন, এই খেয়েই তোমলোককো দেশকো এইসা দশা!’ এইসা দশা মানে কী, লীলা মজুমদার তা উহ্যই রেখেছিলেন। এহেন পদিপিসি যাচ্ছিলেন নিমাইখুড়োর বাড়ি। পথে এল ডাকাতের দল। তারা সকলকে মেরেধরে যখন একশা করে দিয়েছে, পাল্কি থেকে নেমে পদিপিসির হুঙ্কার, “ওরে বাটপাড়েরা, গাড়োয়ান, রমাকান্ত সবাইকে তো আধমরা করে ফেললি, গোরুগুলোরও কিছু বাকি রেখেছিস কি না জানি না। এ বার তোরাই আমাকে কাঁধে করে নিমাইখুড়োর বাড়ি পৌঁছে দে।” শুনে তো ডাকাতেরা পদিপিসির পায়ে গিয়ে পড়লে— নিমাই সর্দারকে কিছু বলবেন না। নিমাইখুড়োই তো ডাকাতের সর্দার! ব্যস, পদিপিসি বুঝলেন, স্টেট সিক্রেট ফাঁস! আর সেই গোপন কথা জেনে ফেলার ফল? পদিপিসি নিমাইখুড়োর ডাকাতির ভান্ডার থেকে চুনি, পান্না, হিরে নিয়ে পুরলেন বর্মিবাক্সে।
আর এখন? গুপ্তকথা জেনে ফেললে সোজা গারদ। সামান্য বইপত্র ঘরে থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে যাচ্ছে, ‘স্টেট সিক্রেট’-এর তো কথাই নেই। তবে স্টেট সিক্রেট-এর কথা যদি বলেন, উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত কাহিনিটি ফের না বললেই নয়। সম্প্রতি কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি কাহিনিটি টুইটও করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এক জনকে গ্রেফতার করা হল, তিনি নাকি চার্চিলকে ‘বোকা’ বলেছিলেন। বিরোধীরা হইচই করলেন— এটা কি পুলিশ-স্টেট নাকি? চার্চিল বললেন, প্রধানমন্ত্রীকে বোকা বলেছে বলে নয়, যুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রের গোপন কথাটি ফাঁস করেছে বলেই গ্রেফতার হয়েছে!
আর এখন রাজনীতিকদের রসবোধ বলতে ফুফি! বুক ফুলিয়ে বলছেন, কৃষি আইন নিয়ে কেন কথা বলিনি? বলিনি, বেশ করেছি। আরে, সব জায়গাতেই এক জন ফুফি থাকেন, যিনি কথায় কথায় কেন আমাকে বলা হল না বলে গোসা করেন।
আসলে মহামান্যদের পদিপিসির বর্মিবাক্স পড়া অবশ্যকর্তব্য। তা না পড়লে ফুফাদের নিয়ে রসিকতা (উত্তর ভারতে জনপ্রিয় রসিকতা, সব বিয়ে বাড়িতেই এক জন ফুফা থাকেন, যিনি লাঠি হাতে সারা বাড়ি ঘুরে খুঁজে বেড়ান। কী খোঁজেন? নিজেই বলেন, রাগ করার বাহানা) ফুফিদের ঘাড়ে চাপানো হবে। এই যে ফুফিকে নিয়ে রসিকতা করায় কৃষকবিরোধী এবং লিঙ্গবৈষম্য নামক মনোভাবটি গলগল করে বেরিয়ে পড়ল, ঢাকা দেওয়ার কাপড় পর্যন্ত পাওয়া গেল না! তার বেলা! অবশ্য কাপড় না থাকলেও গরুর মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ হয় না।
অথচ ঘোড়ার কপাল দেখুন। গরুর সঙ্গে তুলনা করলে ঘোড়া অতি দুর্ভাগা। মরা হাতি লাখ টাকা, আর মরা ঘোড়া? জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল। প্রভুকে বাঁচিয়ে মরে যাবে, তবে তার মূর্তি-টুর্তি হবে। বেঁচে থাকতে যতই সেবা করো, ইতিহাসে মানমর্যাদা পাবে না। অথচ বীরত্বের ভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে ঘোড়ায় চড়া। সে খোকার বীরপুরুষ হওয়াই হোক, বা যোদ্ধাদের অমরত্ব প্রাপ্তি— সবের পিছনে একটা টগবগে ঘোড়া থাকবেই। ফিল্মে বা মেগা সিরিয়ালে, যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত চনমন করা মৃত্যু যদি দেখাতে হয়, ঘোড়ার শরণ নিতে হবে। বেন হার-এ রথের দৌড় কী বিখ্যাত, কিন্তু সেখানেও বেচারা ঘোড়াই দৌড়ে দৌড়ে ছেতরে পড়ল। শ্যামবাজারে নেতাজির মূর্তির ঘোড়া বিখ্যাত, অথচ মাঠেময়দানে হাড়জিরজিরে ঘোড়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনায় সে পেলে না কিছুই। অবশ্য বলতেও ভয় করে। নেতাজিকে সম্মান দেওয়া বাঙালিকে কে শেখাল, তা নিয়ে ছাতি চাপড়ানো এত দূর পৌঁছেছে যে, কোন দিন না কেউ বলে বসে, ঘোড়ার ফোলানো ন্যাজই সুভাষচন্দ্র বসুকে নেতাজি করেছে।
অবশ্য ঘোড়া বেচারা হিসেবে গোলমালও করে ফেলেছে। ঝাঁসির রানি কঙ্গনার ঘোড়া-ছোটানো দৃশ্যে যখন দর্শকমণ্ডলী অহো অহো করছে, তখন কে যেন ফাঁস করে দিলে, ওটা আসলে মেকানিক্যাল হর্স, যার উপর বসে দাপট দেখিয়েছিলেন কঙ্গনা। ফিল্মে তো এমন হয়েই থাকে। কিন্তু তা নিয়ে গর্ব করতে গিয়েই ঝোলা থেকে ঘোড়া বেরিয়ে পড়ল।
তবে ঘোড়ার কপালটা দেখুন। ঝোলা থেকে বেড়াল বেরোলে কেলেঙ্কারি আর ঝোলা থেকে ঘোড়া বেরোলে মেরিল স্ট্রিপ (কঙ্গনা নিজেই বলেছেন, অস্কারজয়ীর অভিনয়ক্ষমতা তাঁরও রয়েছে)। এ জন্যই ঘোড়া ঘোড়া হয়েই রইল।
আর গরু গরু। মাঠ থেকে গপ্পোর মই বেয়ে গাছে উঠত আগে, আর এখন দেশই তার সামনে দণ্ডবৎ।
এই সব দেখে রেণুকা চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। বছর দুয়েক আগে রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর আধার সংক্রান্ত বক্তৃতা শুনতে শুনতে কংগ্রেস সাংসদের অট্টহাস্য তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, রামায়ণ সিরিয়ালের পর এমন হাসি শুনছেন। বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেছিলেন, মানসিক চিকিৎসা করাতে। সত্যি, এক জন মেয়ের হাসি কী ভাবেই না পৌরুষের রাজনীতি তছনছ করে দেয়!
অশ্রুপাতের রাজনীতির মধ্যে হঠাৎ মনে হল...এই আর কী। কোনও কথা নয়, শুধু প্রচণ্ড হাসি।
বলছিলাম না, গরুর রচনা লেখা সহজ কথা নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy