প্রতিবাদ: বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ যুব কংগ্রেসের। ১৬ মার্চ ২০২৪, নয়াদিল্লি। পিটিআই।
ঘটনা হল, ২০১৭ সালের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন যে, স্বাধীনোত্তর সাত দশকে বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অর্থসংগ্রহের কোনও স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলি বেনামি উৎস থেকে নগদ টাকায় চাঁদা সংগ্রহ করেই কাজ চালিয়ে এসেছে। এই ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক দলের চাঁদা তোলার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রী একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
নগদ টাকায় কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা কুড়ি হাজার টাকা থেকে কমিয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়। ব্যাঙ্কের চেক বা ডিজিটাল মাধ্যমে কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিলে তার উপর আয়করে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা বজায় রাখা হয়। রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদার উৎস এবং পরিমাণ তাদের বার্ষিক আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে তাদেরও আয়কর থেকে ছাড় দেওয়ার নিয়ম চালু রাখা হয়।
কিন্তু এর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী একটি নতুন চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করার কথাও ঘোষণা করেন, যে ক্ষেত্রে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি সরকার-নির্ধারিত ব্যাঙ্কের থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী ঋণপত্র কিনে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সেই বন্ড কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা হিসাবে দিতে পারবে। বন্ডের প্রাপক রাজনৈতিক দলটি সেই বন্ড ব্যাঙ্কে জমা করে সেটাকে নগদে বদলে নিতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি নির্বাচনী বন্ডে কত চাঁদা দিচ্ছে সেটা জানা যাবে, একটি রাজনৈতিক দল সর্বসাকুল্যে নির্বাচনী বন্ডে কত চাঁদা পাচ্ছে তা-ও জানা যাবে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তি কোন রাজনৈতিক দলকে কত চাঁদা দিচ্ছে, সেটা জনসমক্ষে আসবে না। সেই তথ্য সরকার ব্যাঙ্কের কাছে গোপন রাখবে।
প্রথম থেকেই দুর্নীতির আশঙ্কা
২০১৭ সালের বাজেটে এই নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প ঘোষণা হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা উঠে আসে। কেবল বিরোধী দলগুলিই নয়, সরকারের অভ্যন্তরেও সমালোচকরা বলেন যে, অস্বচ্ছতা দূর করার বদলে এটা বেনামি লেনদেন এবং ঘুষ দেওয়াকে আইনি বৈধতা দেবে। এই প্রকল্প চালু হলে অর্থনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে। নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প চালু করার জন্য যে আইনি সংশোধনী সংসদে পাশ করানো হয়, নির্বাচন কমিশনও সেগুলির বিরোধিতা করে।
জনগণের প্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন-স্বীকৃত সমস্ত রাজনৈতিক দলকে প্রতি বছর কমিশনের কাছে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তির থেকে কুড়ি হাজার টাকার বেশি প্রাপ্ত চাঁদার একটি রিপোর্ট জমা করতে হয়। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আসা চাঁদা এই রিপোর্টের বাইরে রাখার জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে সংশোধনী পাশ করানো হয়। ২০১৭ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে চিঠি লিখে নির্বাচন কমিশন জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই সংশোধনী প্রত্যাহার করার দাবি জানায়।
কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারায় নিয়ম ছিল, কোনও সংস্থার রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া মোট বার্ষিক চাঁদা সেই সংস্থার বিগত তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। আইন সংশোধন করে সেই নিয়ম তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে নির্বাচন কমিশন জানায়, এর ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো ভুয়ো সংস্থা (শেল কোম্পানি) গড়ে উঠবে, যাদের মাধ্যমে রাজনীতিতে কালো টাকার স্রোত বৃদ্ধি পাবে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর উর্জিত পটেল ২০১৭-র সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে চিঠি লিখে জানান যে, বেনামি নির্বাচনী বন্ড চালু হলে ‘মানি লন্ডারিং’-এর ঝুঁকি বেড়ে যাবে। মানি লন্ডারিং অর্থাৎ অর্থশোধন— অবৈধ আয় বা সম্পদকে বৈধ করা; সোজা কথায় কালো টাকা সাদা করা। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর বেনামি বিয়ারার বন্ড চালু না করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে ডিম্যাট বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্বাচনী বন্ড চালু করার পরামর্শও দিয়েছিলেন।
সরকারের ভিতর এবং বাইরের এই সমস্ত আশঙ্কা এবং আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প চালু করে দেয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যুক্তি দেন যে, বেনামি চাঁদা দেওয়ার সুযোগ না-রাখলে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে অনিচ্ছুক হবে, এবং নগদে লেনদেন চলতেই থাকবে। নির্বাচনী বন্ড চালু হলে সম্পূর্ণ না হলেও রাজনৈতিক দলের চাঁদার ক্ষেত্রে আংশিক স্বচ্ছতা আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পরিপন্থী
নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প চালু হওয়ার মুখেই এটিকে আইনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম এবং কমন কজ় নামক দু’টি অসরকারি সংস্থা। সিপিআইএম দলও মামলা করে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই মামলার কোনও নিষ্পত্তি হয়নি, কিন্তু ২০১৯-এর এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড জারি করার জন্য নির্ধারিত স্টেট ব্যাঙ্ককে এই সংক্রান্ত সমস্ত হিসাবনিকাশ রাখার অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশ দেয়।
অবশেষে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্বাচনী বন্ড স্কিমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এবং ২০১৭-র বাজেট অধিবেশনে সংসদে পাশ হওয়া জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং কোম্পানি আইনের সংশোধনীগুলিকে বাতিল করে দেয়। স্টেট ব্যাঙ্ক-কে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন মারফত প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাপে স্টেট ব্যাঙ্ক বহু ধানাই-পানাই করলেও শেষ অবধি ২১ মার্চ সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। লেনদেনের তথ্য-পরিসংখ্যান জনসমক্ষে আসতেই নির্বাচনী বন্ডের ঝুলি থেকে একের পর এক বেড়াল বেরোতে থাকে।
লক্ষণীয়, ২০১৮-র মার্চ থেকে ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছ’বছরে নির্বাচনী বন্ডে সব রাজনৈতিক দলের মোট প্রাপ্ত চাঁদার পরিমাণ ১৬,৪৪৬ কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি, ৮২৫৩ কোটি টাকা, চাঁদা গিয়েছে কেবলমাত্র ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে। জাতীয় কংগ্রেস সর্বসাকুল্যে পেয়েছে ১৯৫২ কোটি টাকা, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ১৭০৮ কোটি, তেলঙ্গানার পূর্বতন শাসক দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি পেয়েছে ১৪০৮ কোটি, ওড়িশার শাসক দল বিজু জনতা দল পেয়েছে ১০১৯ কোটি, তামিলনাড়ুর শাসক ডিএমকে পেয়েছে ৬৩৯ কোটি আর অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস পেয়েছে ৫০৩ কোটি। এই সাতটি দল মিলেই ১৫৪৮২ কোটি টাকা, অর্থাৎ ছ’বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রাপ্ত মোট চাঁদার ৯৪% পেয়েছে। বাকিটা যারা পেয়েছে তারাও নানা রাজ্যে হয় বর্তমান নয় প্রাক্তন শাসক দল।
এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার যে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা মূলত কেন্দ্রের এবং রাজ্যগুলির শাসক দলগুলির কাছেই পৌঁছেছে, রাজ্যগুলিতে যারা বিরোধী দল তারা যৎসামান্য পেয়েছে আর বেশ কিছু দল কিছুই পায়নি অথবা তারা এই মাধ্যমে টাকা নেয়নি। কেন্দ্রে বা রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শাসক দলগুলি যদি বিরোধী দলগুলির তুলনায় অনেক বেশি টাকা আদায় করে নিতে পারে, তা হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সুষম প্রতিদ্বন্দ্বিতার আর কোনও সম্ভাবনা থাকে কি? বহুদলীয় গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই তো এতে ব্যাহত হয়। নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প অসাংবিধানিক ধার্য হওয়ার পিছনে এটাই ছিল প্রধান কারণ।
চাঁদা, না ঘুষ
কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন দলগুলিকেই যদি মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়ে থাকে, তাকে কি আর ‘চাঁদা’ বলা চলে? নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যে সংস্থাগুলি বড় অঙ্কের ‘চাঁদা’ দেওয়ার তালিকার উপরের দিকে আছে, তাদের সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। ইডি, সিবিআই বা আয়কর দফতরের তদন্ত চলছে, বা তারা হানা দিয়েছে এই রকম ২২টি কোম্পানি সর্বসাকুল্যে ৪৮০০ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে দিয়েছে, যার ৪০ শতাংশ বা ১৯১৯ কোটি টাকা একাই পেয়েছে বিজেপি।
আসলে চাঁদা নয়, কেন্দ্রীয় এজেন্সিদের তদন্ত থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলেই বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে লেলিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজির অভিযোগও করেছেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি-কে ঘুষ দিয়ে বিদ্যুৎ, সড়ক বা আবাসন নির্মাণ ইত্যাদি পরিকাঠামো প্রকল্পে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাত বা অন্যান্য সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ-সহ অভিযোগ উঠেছে অনেক বড় সংস্থার বিরুদ্ধে।
কালো টাকার ওয়াশিং মেশিন
ঘুষ দিয়ে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করে নেওয়া ছাড়াও নির্বাচনী বন্ডে দেওয়া ‘চাঁদা’-র ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আশঙ্কা অনুযায়ী ভুয়ো কোম্পানি মারফত কালো টাকা সাদা করার প্রাথমিক প্রমাণও মিলেছে। কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনও নতুন সংস্থা তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে পারে না। অথচ এমন অন্তত ২০টি সংস্থার হদিস পাওয়া গিয়েছে, যারা তিন বছর পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে সব মিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা দিয়েছে, যার মধ্যে ৩১ কোটি টাকা পেয়েছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি আর ২৬ কোটি টাকা গিয়েছে বিজেপির কাছে।
কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারায় কোনও সংস্থার রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া মোট বার্ষিক চাঁদার ক্ষেত্রে বিগত তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি হতে না পারার যে সীমারেখা রাখা হয়েছিল, তা ২০১৭ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে মোদী সরকার তুলে দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই সীমাহীন চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়ে তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের সীমাকে পুনর্বহাল করেছে।
গত দুই বছরে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে, অন্তত ৫৫টি কোম্পানি এই ৭.৫ শতাংশের সীমা উল্লঙ্ঘন করে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিয়েছে। দুই অর্থবর্ষে দেওয়া মোট চাঁদার পরিমাণ ১৯৯৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৩৭৮ কোটি টাকা ওই ৭.৫ শতাংশের সীমা বহির্ভূত চাঁদা। এই ৫৫টি কোম্পানির দুই বছরে বিজেপি-কে দেয় ১৪১৪ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক দলের চাঁদার ক্ষেত্রে তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়ার পরিণতি আরও দেখা যায় ছ’টি সংস্থার ক্ষেত্রে, যারা ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৬৪৬ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে, কিন্তু তাদের গত সাত অর্থবর্ষের নিট মুনাফার যোগফল দাঁড়ায় মাত্র ১৮৪ কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে মুনাফার অতিরিক্ত চাঁদা দেওয়ার টাকা এই সংস্থাগুলির কাছে এল কোথা থেকে?
এই ছ’টি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৪১০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে একটি সংস্থা, যার মধ্যে ৪০০ কোটি টাকাই গিয়েছে বিজেপির কাছে। অথচ বিগত সাত বছরে এই সংস্থাটির মোট নিট মুনাফা মাত্র ১৪৪ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত তথ্যে এটা প্রমাণিত যে, এই কুইক সাপ্লাই চেন সংস্থার ডিরেক্টরদের অনেকেই রিলায়েন্স গোষ্ঠীর বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। স্বভাবতই অভিযোগ উঠেছে যে, কুইক সাপ্লাই চেনের মাধ্যমে সম্ভবত রিলায়েন্স গোষ্ঠীই নির্বাচনী বন্ড কিনে চাঁদা দিয়েছে। এই ছ’টি সংস্থার মধ্যে আরও দুটো হল মদনলাল লিমিটেড, যেটা আদতে মহেন্দ্র কুমার জালান গ্রুপের সংস্থা এবং এবিএনএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, যেটা আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সংস্থা।
কেবল মুনাফার অতিরিক্ত চাঁদাই নয়, এমন ৩৩টি সংস্থার হদিস পাওয়া গিয়েছে যারা গত সাত অর্থবর্ষে বড় অঙ্কের নিট লোকসান করেছে। এরা ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ডে সব মিলিয়ে ৫৮২ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে, যার মধ্যে ৪৩৪ কোটি টাকা বিজেপির কাছে গিয়েছে। লাগাতার লোকসানে চলা সংস্থা থেকে আসা এই চাঁদার সবটাই সম্ভবত কালো টাকা। ব্যক্তি হিসাবে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যেও অনেকে কোনও না কোনও সংস্থার হয়ে বকলমে চাঁদা দিয়েছেন। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলের অর্থসংগ্রহে স্বচ্ছতা আনার নামে চালু হলেও, আদতে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ছ’বছরে বিশাল অঙ্কের কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, আর এই কালো টাকার সিংহভাগ গিয়েছে বিজেপির তহবিলে। এই প্রেক্ষিতেই বিরোধীরা আজ বিজেপি-কে কালো টাকার ওয়াশিং মেশিন বলে বিদ্রুপ করছেন।
সুপ্রিম কোর্টে ভরসা
ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য-পরিসংখ্যান সামনে আসার পর থেকে ঘুষ নিয়ে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত প্রভাবিত করা বা প্রকল্পের বরাত পাইয়ে দেওয়া বা বড় অঙ্কের কালো টাকা সাদা করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মোদী সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ইতিমধ্যেই এর তদন্ত শুরু করে দিত। তা বিজেপিকে আরও বিপাকে ফেলবে বুঝেই ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্যের প্রকাশ আটকানোর জন্য সরকার শেষ পর্যন্ত মরিয়া প্রয়াস চালিয়ে যায়।
রাফাল চুক্তি থেকে আদানি-হিন্ডেনবার্গ কাণ্ড, আজ অবধি সরকারি বা বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগেরই যথাযথ তদন্ত মোদী আমলে হয়নি। বরং হুইসল ব্লোয়ার বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের কণ্ঠরোধ করতেই সরকার সক্রিয় হয়েছে। অগত্যা, একমাত্র প্রত্যাশার জায়গা সুপ্রিম কোর্ট।
আসলে নির্বাচনী বন্ডের বিষয়টা শুধুমাত্র একটা স্বতন্ত্র কেলেঙ্কারি নয়। এই বন্ডের মাধ্যমে বড় কোম্পানি আর শাসক দলগুলির বিভিন্ন লেনদেনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অনেকগুলি কেলেঙ্কারি। এক রাশ আর্থিক দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি আর কালো টাকা সাদা করার ঘটনার সমাহার ঘটেছে পাঁচ বছর ধরে। তাই এটা একটা মেগা স্ক্যাম বা মহা-কেলেঙ্কারি। এর গভীরে ঢুকতে গেলে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বড় লেনদেনের আলাদা করে তদন্ত করতে হবে। জটিল এবং বেআইনি লেনদেনের তদন্তে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে একটা বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেই এমন মহা-কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে ন্যায় এবং সুবিচার সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy