Advertisement
E-Paper

কেন্দ্র বনাম অঞ্চল?

আঞ্চলিক বৈচিত্রকে ধামাচাপা দেওয়ার সবচেয়ে জ্বলন্ত যে উদাহরণ, সেটা হল জনসংখ্যা। ভারতের জনসংখ্যা চিনকে টপকেছে, তার বেশির ভাগটাই গোবলয়ের অবদান।

An image of Opposition Parties

বিকল্প: সংসদের বাদল অধিবেশনে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’, দিল্লি, ২৪ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৩ ০৬:৫৪
Share
Save

ভারতে আর কোনও আঞ্চলিক দল থাকবে না, বলেছিলেন বিজেপি সভাপতি নড্ডা। তার মোটামুটি এক বছর পরে, তৈরি হল যে যূথবদ্ধ বিরোধী শিবির, তা নানা বর্ণের আঞ্চলিক দলে ভরপুর, তাদের প্রাথমিক ঘোষণাপত্রের শুরুতেই জ্বলজ্বল করছে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো’ শব্দবন্ধটা। ফলে যুদ্ধটা আর ঠিক বিজেপি বনাম অবিজেপি নয়, কেন্দ্র বনাম আঞ্চলিকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

এ নিঃসন্দেহে এক রকম বিজেপির শিকড় ধরেই টান মারা। ‘আঞ্চলিক’ এবং ‘যুক্তরাষ্ট্র’, দুই ধারণার সঙ্গেই বিজেপির বিরোধ প্রকট। কিন্তু ব্যাপারটা তার চেয়েও বড়, কারণ এখানে রাষ্ট্রীয় স্তরে তৈরি হল আস্ত একটা নতুন এবং বিকল্প ন্যারেটিভ। আঞ্চলিক দলগুলো দল বেঁধে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে এতখানি কুণ্ঠাহীন সওয়াল করল। এত দিন রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, বিজেপি একটা করে কাণ্ড ঘটাবে, আর ‘বিজেপি কী খারাপ’ বলে তার পিছনে দৌড়বেন বিরোধীরা। এ বার ন্যারেটিভটাই তৈরি হল বিপরীত পক্ষ থেকে, যার উত্তর দিতে হবে বিজেপিকে। এ এমন এক ন্যারেটিভ, যা স্রেফ বিজেপি-বিরোধিতার জন্য তৈরি নয়, বরং যাকে ভারতের পুনর্নিমাণের নতুন মডেল হিসাবেও দেখা যায়। এত দিন রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, যদিও সংবিধানে ভারত একটি ‘ইউনিয়ন’, যদিও ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ই তার অস্তিত্বের অন্যতম মূলসূত্র, কোনও কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীই বৈচিত্রকে আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না। সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বদলে জোর দেওয়া হবে ‘কেন্দ্রীয় ঐক্য’র ধারণায়। একান্ত ঠেকায় পড়লে তবেই নানা ভাষা নানা মতকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাও যতটা রেখেঢেকে পারা যায়।

আশ্চর্য লাগলেও সত্যি যে, রাষ্ট্রীয় স্তরে জোট বেঁধে তো দূরস্থান, বিস্মৃতপ্রায় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মেমোরান্ডাম’-এর পর এই নিয়ে সংগঠিত কোনও আওয়াজই ওঠেনি। যদিও অনেক আগেই ওঠা উচিত ছিল। কারণ এটা কোনও নতুন আবিষ্কার নয়। ভারতের রাজ্যগুলো যে আসলে জাতিসত্তার সংহত রূপ, স্বাধীনতার পর থেকেই, এই স্বীকৃতির কোনও বালাই নেই। যুক্তরাষ্ট্রকে বস্তুত ভাবা হয় ‘নেশন স্টেট’-এর আদলে। রাজ্যগুলোকে ভাবা হয় নেহাতই প্রশাসনিক একক হিসাবে, যেন মুখ্যমন্ত্রী হলেন নির্বাচিত জেলাশাসক। ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মূলত চাপে পড়ে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনের ঝড় ওঠার পরই। তার পরেও জিনিসটার মূল চরিত্র একেবারেই বদলায়নি— রাজ্যগুলোর ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান।

অবস্থা এমন যে, কোনও জাতিগোষ্ঠীর নিজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধরে রাখার জন্য যেটুকু ক্ষমতা দরকার, তাও ভারতের কোনও রাজ্য সরকারের হাতে নেই। জরুরি অবস্থার সময় শিক্ষাকে রাজ্য তালিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যৌথ তালিকায়, যা রাজ্যের হাতে আর ফেরত আসেনি। বৈদ্যুতিন মাধ্যম ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেন্সর বোর্ডের মতোই, তার নিয়ন্ত্রণও থেকে গেছে সম্পূর্ণই কেন্দ্রের হাতে। এখন ঢক্কানিনাদ সর্বত্র যে, দেশে ‘মুক্ত অর্থনীতি’র রাজত্ব, কিন্তু কার্যত শিক্ষায় কোন বোর্ড প্রাধান্য পাবে, কেব্‌ল টিভিতে কোন চ্যানেল দেখানো যাবে, কোন এফএম চ্যানেল লাইসেন্স পাবে, ওটিটির সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ, প্রায় সবটাই কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারণ করে। এবং দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়ে চলেছে। সোজা বাংলায়, জনগোষ্ঠীর প্রাণভোমরা যে শিক্ষা-সংস্কৃতি, তাকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার এখনও ‘আঞ্চলিক’ কোনও জনগোষ্ঠীর সরকারের নেই। বরং বৈচিত্রকে ধ্বংস করে, কিছু বিশেষ অঞ্চলের খিচুড়ি সংস্কৃতিকে সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়ার প্রকল্প প্রবল পরাক্রমে চালু।

একই ব্যাপার অর্থনীতিতেও। রাজ্য থেকে আদায় করা রাজস্বের বেশির ভাগটাই পায় কেন্দ্র। সেই টাকা কোথায় ব্যয় করা হবে, কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা ছিল না। কেন্দ্রীয় শাসকদের পছন্দমতো রাজ্যে গিয়েছে টাকা-পয়সা, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’ বলে চিৎকার করেছে, কেউ কান দেয়নি। মাসুল-সমীকরণ এবং আরও নানা নীতি চালু করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সমস্বত্বতা রক্ষা করার কারণ দেখিয়ে। সেখানেও, বস্তুত কিছু রাজ্যের সম্পদকে চুষে নিয়ে ঢালা হয়েছে অন্যত্র, ব্যতিক্রমহীন ভাবে। এটা চলেছে দশকের পর দশক ধরে।

কয়েক দশক আগে মাসুল-সমীকরণ উঠে যায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে যেটুকু সওয়াল ছিল, তা তখন একেবারেই মিইয়ে পড়ে। অজ্ঞাত কারণে সমস্ত বিরোধীপক্ষই ভাবতে থাকে— সব বঞ্চনা মিটে গেল, এখন স্রেফ মুক্ত বাজারের রাজত্ব, সব্বাই সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। ক্রমশ চালু হয় জিএসটি, শাসক-বিরোধী সবার সমর্থনে। কিন্তু কোথায় কী। তথ্য বলছে, নতুন সহস্রাব্দে ধনী রাজ্যগুলোর মাথাপিছু আয় বেড়েছে রকেটের গতিতে, পিছিয়ে পড়েছে গরিব রাজ্যগুলো। ২০১৪ সালে ধনীতম তিনটি রাজ্যের মাথাপিছু আয় ছিল দরিদ্রতম তিনটি রাজ্যের তিনগুণ। তফাতটা ভারত-পাকিস্তানের ফারাকের চেয়েও অনেক বেশি। এটাও ‘বৈচিত্র’, যার স্বীকৃতি কোথাও নেই। কেন্দ্রমুখী অর্থনীতিতে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’ যে আঞ্চলিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, এটা আড়ালেই থেকেছে।

আঞ্চলিক বৈচিত্রকে ধামাচাপা দেওয়ার সবচেয়ে জ্বলন্ত যে উদাহরণ, সেটা হল জনসংখ্যা। ভারতের জনসংখ্যা চিনকে টপকেছে, তার বেশির ভাগটাই গোবলয়ের অবদান। এই অসম জনবৃদ্ধির সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বের সরাসরি সম্পর্ক আছে। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, লোকসভায় রাজ্যগুলোর সাংসদসংখ্যা তাদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হতে হবে। জনসংখ্যা যে-হেতু স্থির নয়, তাই মাঝেমাঝেই এই নিয়ে হিসাবপত্র হওয়ার কথা, কিন্তু ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী সংশোধনী এনে পুনর্বণ্টনের ব্যাপারটাকে পঁচিশ বছর, অর্থাৎ ২০০১ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেন। ২০০২ সালে বাজপেয়ী সরকার ‘দেশের বিভিন্ন অংশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অগ্রগতির দিকে নজর রেখে’ পিছিয়ে দেয় আরও পঁচিশ বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসনসংখ্যা ৮০, বিহারের ৪০, পশ্চিমবঙ্গের ৪২, কেরলের ২০। জনসংখ্যাবৃদ্ধির পূর্বানুমান থেকে গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ২০২৬ সালে আনুপাতিক হারে উত্তরপ্রদেশের আসনসংখ্যা বেড়ে হওয়ার কথা ৯১, বিহারের ৫০। পশ্চিমবঙ্গের কমে হবে ৪০, কেরলের ১৫। অর্থাৎ গোবলয়ের আধিপত্য আরও বাড়বে। কিন্তু ২০২৬-এ যে-হেতু কোনও জনগণনা হবে না, কোন সালের জনগণনা অনুযায়ী হিসাব করা হচ্ছে, তার উপর সংখ্যাটা কিছু নির্ভর করবে।

দলগত ভাবে এতে লাভবান হবে কারা? ২০১৪ সালে লোকসভায় বিজেপির আসনসংখ্যা ছিল ২৮২, কংগ্রেসের ৪৪, দুই জোটের বাইরের অন্যরা ১৪৯। ভোটের ফলাফল একেবারে এক রেখে, ২০১১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে যদি আসন পুনর্বণ্টন করা হত, তা হলে ফলাফল যা দাঁড়াত, তাতে বিজেপির আসন বেড়ে হত ২৯৯। কংগ্রেসের ৪২, অন্যদের কমে ১৩৪।

এই জনসংখ্যার বিষয়টা একদম সংখ্যা দিয়ে কয়েকটা জিনিস দেখিয়ে দেয়। এক, যতই র‌্যাঁদা চালিয়ে ‘সুষম’ এক ভারত তৈরি করার চেষ্টা হোক, বৈচিত্র, বিভিন্নতা যায়নি, যাবে না। দুই, লক্ষণীয় যে, গোবলয়ের আসনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বিজেপির আসনসংখ্যা বাড়া একদম সরাসরি সম্পর্কযুক্ত, যেটা পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেয়, বিজেপি আদতে গোবলয়ের একটা আঞ্চলিক দল, যাদের সুষম ভারতীয়ত্বের ধারণা আসলে গোবলয়ের সংস্কৃতিকে সম্প্রসারণ করার প্রকল্প। তিন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, ২০২৬ আর বিশেষ দূরে নেই, এবং পশ্চিমবঙ্গে তেমন শোনা না গেলেও, ভারতে এটা নিয়ে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আছে। দক্ষিণের একাধিক নেতা মুখ খুলেছেন। হিন্দি বলয়ের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আর একটা বক্তব্য যে, আনুপাতিক সাংসদসংখ্যার নীতি অনুসরণ করার অর্থ হল, পরিবার-পরিকল্পনা সফল ভাবে যারা রূপায়ণ করেছে, তাদের শাস্তি দিয়ে যারা ব্যর্থ তাদের পুরস্কার এবং উৎসাহ জোগানো।

প্রশ্নটা আসলে মৌলিক যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিরই। আদর্শ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটা রাজ্যের সমমর্যাদা। আমেরিকার মতো মিশ্র মডেলে সেনেটে প্রতি রাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্ব, কিন্তু কংগ্রেসে অসমান। তা হলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেমন হওয়া উচিত? বর্তমান মডেল ত্রুটিপূর্ণ, তা হলে সমাধান কী? আগামী কয়েক বছর সর্বভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র হবে এই দ্বন্দ্বই। বিজেপি চায় শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রায় আধাসামরিক নেশন স্টেট, এর বিপরীতে বিকেন্দ্রীভূত মডেলটা ঠিক কী হবে?

প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে বিরোধীদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Opposition Parties Anti BJP Alliance

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}