এক পরিচিত তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে এক মন্দিরগাত্রে লিখিত একটি ফলকের ছবি দিয়েছেন। সেই ফলকে লেখা: “শ্রী শ্রী শ্রী কিরীটেশ্বরী মাতা জয়তী। মরহুম- আব্দুল হাকিম মণ্ডল, মরহুমা- তকিমুননেসা বিবি। তাঁহাদের পুণ্য স্মৃতির স্মরণে— তিন শতক জমি (দাগ নং- আরএস ও এলআর- ৮৪৫) মায়ের মন্দিরে দান করা হইল। দাতাগণের নাম: ১. লুৎফুল হক (পুত্র), ২. মরহুমা- রাবিয়া বেওয়া (কন্যা) ৩. রাফিয়া বিবি (কন্যা), ৪. ফাইজন বেওয়া (কন্যা) ৫. মোঃ হবিবুর হক (পৌত্র)। গ্রাম- মুকুন্দবাগ, পোস্ট কিরীটেশ্বরী, থানা- জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ।”
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন: “নতুন মন্দির হবে বলে/ কেউ-বা মোহর দিল, কেউ-বা কাহন/ যে-শিশু আপনমনে দোলে/ সে তার দোলনাটুকু দিয়ে দিল...।” এই তিন শতক জমি মায়ের মন্দির স্থাপনার্থে দান করা যেন ওই দোলনার দোলনটুকু দিয়ে দেওয়ার মতো পবিত্র।
এই জমিদানের ফলকটি দেখে আমার মনে পড়ল আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে হিন্দু করসেবকদের দ্বারা ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয় ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উপাসনালয়টি ছিল কয়েক শতাব্দী পুরাতন।
তিন শতক জমি মায়ের মন্দিরে দান করা এবং বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনা আমাদের জানায় দু’টি তথ্য। এক, গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যে, হিন্দু-মুসলমানে রেষারেষি ভেদাভেদ তো নেই-ই, বরং গভীর সম্প্রীতি আছে। যেমন, নদিয়ার কৃষ্ণনগরে এক বিখ্যাত মিষ্টান্ন ভান্ডারের গা দিয়ে একটি সরু গলি-রাস্তা আছে, যার নাম কুরচিপোতা। সেই কুরচিপোতার অর্ধেক অংশ নিয়ে বাস করেন হিন্দুরা। বাকি অর্ধেকে সংসার পেতেছেন মুসলিমরা। সেই রাস্তায় একটি মসজিদ আছে। অষ্টমী পুজোর সময় গোটা পাড়ায় মাইক দেওয়া হয়। তখন ওই পাড়ার সর্বত্র অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র মাইক থেকে শোনা যায়। ইদের সময়েও পুরো পাড়াটি সাজানো হয়, মাইকের ব্যবস্থা থাকে। মুসলিমদের প্রার্থনা শোনা যায় মাইকে। দোলের সন্ধ্যায় দেখা যায় মসজিদের সামনের পথেও আবির ছড়িয়ে আছে। মুসলিম ছেলেরাও রং খেলায় যোগ দেয়।
এই হল সম্প্রীতির চিহ্ন। সেই সম্প্রীতি একটি রাজনৈতিক দল ধ্বংস করতে চাইছে। প্রমাণ করা হচ্ছে, রাজনীতির উচ্চ আসন যদি আমি পাই, যদি আমার হাতে আসে দেশবাসীকে যা খুশি বলার অবাধ স্বাধীনতা— তা হলে আমি এ-কথাও বলতে পারি যে, কোনও এক যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং জেলবন্দি হতে হয়েছিল আমাকে। যদিও আমি জানি যে জেলবন্দি হওয়ার দাবিটি এই ভাবে তোলা যায় না, কেননা সেই পর্বে সেটা খুব বেশি হলে ছিল আইন-অমান্যের বিষয়— তবু আমি বা আমার এই আংশিক সত্যভাষণ আমার দলে বা দলের বাইরে কোনও প্রশ্নের সামনে পড়ব না, পড়বে না, এই কথা নিশ্চিত ভাবেই জানি। আমি দেশকে ঠিক এমন জায়গাতেই নিয়ে যেতে চাই, যেখানে কেউ আমাকে কোনও প্রশ্ন করতে সাহস পর্যন্ত পাবে না।
এই হল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব। যাতে স্বৈরাচারীর চরিত্রলক্ষণ প্রকট। এখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল থেকে নাথুরাম গডসে-কে পূজনীয় করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সেই চেষ্টার পিছনে কেন্দ্রীয় শাসক দলের মদত আছে।
পশ্চিমবঙ্গে দল ভাঙানোর খেলায় উঠে পড়ে লেগেছে কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত শাসক দল। লোকসভা নির্বাচনের আগেও এই দল ভাঙার চেষ্টা তারা চালিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচন শেষ হলেও হয়তো তা চালু থাকবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসীরা মর্মে মর্মে জানি যে, কেন্দ্রের শাসকরা হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে নেমেছেন। অনেক বছর ধরে সুহৃদরূপে বাংলায় বাস করা এই ভিন্ন দুই ধর্মমত অবলম্বনকারী মানুষের ভিতর পরস্পরের সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। সেই সঙ্গে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করতে। উগ্র হিন্দু মতবাদের মাধ্যমে আনতে চাইছেন এক সংগঠিত ধর্মীয় সন্ত্রাস, যাতে সবাই কেন্দ্রের শাসক দলকে ভয় পেয়ে চলে।
আমরা বিশ্বাস করি যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সুবিবেচনা দ্বারা চালিত হন। তাঁরা সচেতন। কতটা সচেতন এই রাজ্যের মানুষ, তা বোঝা যায়, ৩৪ বছর ধরে একচ্ছত্র শাসনভার যাদের দখলে ছিল সেই বামফ্রন্টকে গদিচ্যুত হওয়ার দ্রুততা দেখে। বাংলার জনগণ ব্যালটবাক্সে সে দিন অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। গত দশ বছরে এই রাজ্যের সরকার মানুষের জন্য কাজ করেনি, এমন কথা বলা অসম্ভব। সীমাবদ্ধতা কিংবা ভুলভ্রান্তি ঘটেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যাঁরা নিতান্ত সাধারণ মানুষ, তাঁরা একক ভাবে না হলেও, সমষ্টিগত ভাবে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলের বিপদটা বুঝছেন।
প্রশাসনের দায়িত্বে থাকলে দলের উপর উঠতে হয়, সে কথা সাধারণ মানুষও জানেন। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গত কয়েক বছর দেখেশুনে মনে হয়েছে, তিনি কেবল তাঁর নিজের রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবেই নিজেকে গণ্য করেন। ভারতবর্ষ নামক বিস্তৃত উদার ভূখণ্ড ও তার বিভিন্ন ভাষাভাষী বৈচিত্রপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেবল যারা বিজেপি সমর্থক, তিনি শুধুই তাদের প্রধানমন্ত্রী। তাই এই করোনা-কালেও একের পর এক বিল এই প্রধানমন্ত্রী পাশ করিয়ে নিতে পারেন, যাতে একের পর এক জনগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই সরকারের আমলে চাষিরা কত বার প্রবল বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন, দিনের পর দিন মাসের পর মাস রাস্তায় বসে থেকেছেন, কোনও হিসেব আছে কি? বহু চাষি মারাও যাচ্ছেন— অথচ তাঁদের কথা পর্যন্ত শুনতে চান না ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
পশ্চিমবঙ্গবাসী এ সব দেখে কোন দিকে মত দিলেন, তা শিগগিরই জানা যাবে। আমার আশা— বাবরি মসজিদের ধ্বংসের বিরুদ্ধে এ রাজ্যে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে জিয়াগঞ্জ থানার, মুকুন্দবাগ গ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরগাত্রে লিখিত ওই ফলক!
কিছুতেই নষ্ট হবে না এই বাংলার মানুষের সংস্কৃতি, সম্প্রীতির চেহারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy