Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
তেষ্টা পেলে জল খাবে, ব্যস
Communal Clash

হিন্দু না ওরা মুসলিম? আগে প্রশ্নটাকেই প্রত্যাখ্যান করা জরুরি

মেয়েটি জবাব দিলেন: যে সঙ্কটের মধ্যে আমরা রয়েছি, তার তো কোনও হিন্দু-মুসলমান ভাগ হয় না। ‘যখন একটা মানুষের খিদে পায়, সেই খিদে তো আর হিন্দু খিদে মুসলমান খিদে আলাদা করে হয় না!’

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২১ ০৬:৩৩
Share: Save:

শেষ ফাল্গুনের বেলায় অনেক ক্ষণ পথ চলতে চলতে ছেলেটির তেষ্টা পেয়েছিল। বয়েস তার বছর চোদ্দো, কিংবা আরও কম। রাস্তার ধারে বড়সড় মন্দির, জল খেতে সেখানে ঢোকে সে। এবং বেধড়ক মার খায়। তার অপরাধ, সে ধর্মে মুসলমান। মন্দিরের দরজায় পরিষ্কার লেখা আছে, সেখানে মুসলমানের প্রবেশ নিষেধ।

উত্তরপ্রদেশের গাজ়িয়াবাদের এই সাম্প্রতিক ঘটনাটি নিয়ে কিছুটা শোরগোল হয়েছে। ফলে দু’এক পশলা তদন্ত, গ্রেফতারি ইত্যাদিও। তার পর, যথারীতি, সংবাদ অচিরেই ইতিহাসে পরিণত। সে-দিন সমাজমাধ্যমে ইতস্তত ভেসে বেড়াতে বেড়াতে নজরে এল মিনিট সাত-আটের একটি সংবাদ-ভিডিয়ো। মারধরের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে মন্দিরের কর্তারা সেখানে সাফ সাফ জানিয়ে দেন, তাঁদের জায়গায় ‘ওরা’ ঢুকবে না, ব্যস। তাঁদের উচ্চারণে ‘ওদের’ সম্পর্কে যে মনোভাব ধরা পড়ে, তা আজ আর আমাদের বিন্দুমাত্র বিস্মিত করে না। বরং আমরা বিলক্ষণ বুঝে গেছি, এটাই এখন বহু মানুষের মন কি বাত। কেবল যোগী আদিত্যনাথের আপন দেশে নয়, আমাদের এই সোনার বাংলাতেও।

কিন্তু এ-গল্প সেখানেই ফুরোয় না। সংবাদচিত্র এগিয়ে চলে, ক্যামেরার সামনে আসেন মার-খাওয়া কিশোরের স্বজনরাও। তার দিনমজুর বাবা খুব নিচু গলায় বলেন, ছেলে লেখাপড়া জানে না তো, জানলে মন্দিরের সামনে যে নোটিস লেখা আছে, সেটা পড়ে নিতে পারত, তা হলে আর ভিতরে ঢুকত না (ছেলেটি অবশ্য বলেছে যে, খুব তেষ্টা পেয়েছিল, বোর্ডে কী লেখা আছে খেয়াল করেনি), কিন্তু সে যা-ই হোক, না বুঝে ঢুকে পড়েছে নাহয়, তাই বলে ও রকম মারতে হয়? বার করে দিলেই পারত।— মুখেচোখে এক রাশ ভয়, ভাঙা শরীর, রোগা, রুগ্‌ণ মানুষটির অসহায় কথাগুলো শুনতে শুনতে খুব অস্থির লাগে। একটা ছোট ছেলে ‘মন্দিরে জল খেতে গিয়েছিলাম’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোক তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রহার করছে, এ-দৃশ্য নিশ্চয়ই হিংস্র। ধর্মের ইজারা নিয়ে ক্ষমতার আসনে বসে থাকা লোকজন যখন সেই ঘটনা উপলক্ষে ‘ওদের’ প্রতি নির্মম বাক্যগুলো ছুড়ে দিতে থাকে, তার হিংস্রতা নিশ্চয়ই আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু ছেলে জল খাওয়ার অপরাধে মার খেয়ে এসেছে, এই অমানবিকতার প্রতিবাদে ক্রোধ বা এমনকি ক্ষোভটুকুও প্রকাশ না করে বাবা যখন ‘পড়তে জানে না, তাই ভুল করে ঢুকে পড়েছে’ বলে কার্যত মার্জনা ভিক্ষা করেন, তখন তাঁর ভীতসন্ত্রস্ত আচরণে যে অতলান্ত অসহায়তা প্রকট হয়ে ওঠে, তা সমস্ত হিংস্রতার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর।

আক্ষরিক অর্থেই ভয়ঙ্কর, কারণ তা দেখে ভয় করে— হাড় হিম করা ভয়। ভয়ের দাপট তো তখনই নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে, যখন আর বাইরে থেকে ভয় দেখাতে হয় না, মানুষ নিজেই ভয় পেয়ে গুটিয়ে থাকে, গুটিয়ে থাকাই তার স্বভাবে— স্ব-ভাবে— পরিণত হয়। দেশ জুড়ে এই ‘স্বাভাবিক ভয়’ সঞ্চারিত করে চলারই উৎকট অভিযান দেখছি আমরা, যারাই সাহসের সঙ্গে ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে চায়, তাদেরই ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য বেপরোয়া উদ্যমে সমস্ত রকমের ছল, বল ও কৌশলের প্রয়োগ জারি আছে। সে-চেষ্টা এখনও ষোলো আনা সফল নয়, এখনও প্রতিবাদ সরব হচ্ছে, প্রতিরোধ সক্রিয়। কিন্তু অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, নানা পরিসরে ভয়ের বিষ ক্রমাগত নিজের কাজ করে চলছে, যে বিষ মানুষের স্বাধীন স্বক্ষম চিন্তাকে ক্রমে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় করে দেয়, আত্মরক্ষার তাড়নায় সে চুপ করে যায়, থেমে যায়, গুটিয়ে যায়। এই ভাবে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষাও করা যায় না, ইতিহাস বার বার তা প্রমাণ করেছে, কিন্তু তাতে ওই তাড়নাটা মিথ্যে হয়ে যায় না।

আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষ, বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলমান মানুষ আজ যে মাত্রায় এই ভয়ের শিকার, সেটা বোধ করি অন্য কারও সঙ্গেই তুলনীয় নয়। এই সত্য বোঝার জন্য খুব বেশি মানসিক পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, কেবল মনে মনে, এবং আন্তরিক ভাবে, নিজেকে এক বার তাঁদের জায়গায় রেখে ভাবলেই যে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়, এটা হলফ করে বলতে পারি। গাজ়িয়াবাদের ওই অসহায় শ্রমিক-পিতার মিনতি শুনে তাই এক গভীর আতঙ্ক বোধ করেছিলাম।

সাহস দিলেন তাঁর পাশে থাকা মেয়েরা। কেউ পরিবারের, কেউ বা প্রতিবেশী। সংবাদমাধ্যমের সামনে বাবার মুখে ‘অনপঢ়’ ছেলের ভুল করে মন্দিরে ঢোকার কথা শুনতে শুনতে ওঁরা অচিরেই অস্থির হয়ে পড়লেন এবং তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন: ‘‘বাচ্চা কোনও ভুল করেনি। জল তেষ্টা পেয়েছে, জল খাবে না? মন্দির হোক, মসজিদ হোক, কী এসে গেল?’’ এক জন মুখ খুলতে না খুলতেই সরব হলেন অন্য মেয়েরাও। কোনও সংশয় নেই তাঁদের কণ্ঠস্বরে, এক ফোঁটা ভয় নেই, সমস্বরে বললেন তাঁরা: জল খেয়েছে বলে ছোট ছেলেটাকে অমন করে মারবে? এ কেমন ‘ইনসানিয়াৎ’ হল?

গরিব ঘরের ওই সাধারণ মেয়েদের তীব্র এবং স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে শুনতে মনে হয়, এই জোরটাই আমাদের এখন খুব দরকার। দেশ জুড়ে বিদ্বেষ দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে তৎপরতা, এই মুহূর্তে নির্বাচনী পশ্চিমবঙ্গে যা এক উৎকট রূপ ধারণ করেছে, তার মোকাবিলায় ওই নির্ভীক প্রত্যয়ের কোনও বিকল্প থাকতে পারে না। যারা বিভেদ এবং বিদ্বেষকেই তাদের মূলধন করে ক্ষমতার কারবার চালাতে চায়, প্রথম কাজ হল তাদের খেলাটাকেই অস্বীকার করা। তাদের মুখের উপর বলে দেওয়া— কিসের মন্দির? কিসের ধর্ম? কিসের জাতপাত? লোকের জল তেষ্টা পেলে যেখানে জল আছে সেখানে জল খাবে। এটাই মনুষ্যত্ব, ব্যস।

এ কোনও শেখানো তত্ত্বের বুলি নয়, আন্তরিক বিশ্বাসের কথা। ওই মেয়েদের সে-বিশ্বাস আছে, তাই তাঁরা ওই ভাবে কথাটা বলতে পেরেছেন। আমরা অনেকেই হয়তো এই বুনিয়াদি বিশ্বাসের জোরটা হারিয়েছি, তাই নানা যুক্তির জাল বুনি, রকমারি তত্ত্ব খাড়া করি, কিন্তু ধর্মের নামে যারা চূড়ান্ত অধর্মের কারবার চালায় তাদের প্রথমেই সপাটে প্রত্যাখ্যান করে শুনিয়ে দিতে পারি না: আগে ইনসানিয়াৎ-এর শর্ত মানো, না হলে— নো পাসারান।

কেউ কেউ সেই দরকারি কাজটা করছেন। নির্বাচনী পশ্চিমবঙ্গের এই অদ্ভুত আঁধারেও তৈরি হচ্ছে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী মুহূর্ত, যে মুহূর্তগুলি ভরসা দেয়, সাহস দেয়। যেমন ভরসা দিচ্ছেন ভোটের লড়াইয়ে নামা এক ঝাঁক তরুণতরুণী। তাঁরা কে কেমন ফল করবেন, কত ভোট পাবেন, সেটা মে মাসের দু’তারিখে জানা যাবে। কিন্তু আপাতত ভরসা দিচ্ছে তাঁদের সাফ কথা, চোখে চোখ রেখে সে-কথা বলার দৃপ্ত ভঙ্গি। যেমন তাঁদেরই এক জন, কলকাতার উপকণ্ঠে প্রার্থী হয়েছেন, সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোট এ বার ভাগ হবে কি না, হলে তার ফল কী হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটি শান্ত হয়ে পুরো প্রশ্নটা শুনলেন এবং জবাব দিলেন: দেখুন, যে সঙ্কটের মধ্যে আমরা রয়েছি, তার তো কোনও হিন্দু-মুসলমান ভাগ হয় না। ‘যখন একটা মানুষের খিদে পায়, সেই খিদে তো আর হিন্দু খিদে মুসলমান খিদে আলাদা করে হয় না!’

হয় না, তা আমরা জানি। জেনেও ভুলে যাই। ভুলিয়ে দেওয়া হয়। মনে রাখা আমাদের কাজ। দায়িত্ব। দায়। সেই দায় মেটাতে পারলেই ভয়ও কাটবে। সাহস ক্রমে আসবে। আসছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Communal Clash Religious Discrimination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE