ধ্বস্ত: ধস নেমে ভেঙে গিয়েছে চণ্ডীগড়-মানালি হাইওয়ের একাংশ, ১৬ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।
কয়েক দিন আগে সমাজমাধ্যমে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল: হাওয়ায় ঝুলছে কালকা-শিমলা হেরিটেজ রেললাইনের একটা অংশ। রেললাইনের তলার মাটি রেকর্ড-ভাঙা বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে সাফ। আঁতকে উঠেছিলাম। কালকা থেকে সকালে রওনা দিয়ে ছোট-বড় টানেল, সবুজ পাহাড়, তিরতিরে ঝোরা পেরিয়ে চলা খেলনাগাড়ির মতো ট্রেনে এই পথেই শিমলা পৌঁছনোর অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার, আমাদের অনেকেরই। সেই রেলপথ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তছনছ! শুধু রেলপথ কেন, রাজধানী শিমলা-সহ গোটা রাজ্যের চেনা ছবিটাই যেন পাল্টে গিয়েছে এই এক বর্ষায়। মেঘভাঙা বৃষ্টি আর হড়পা বানে শুধুমাত্র অগস্টে হিমাচলে মৃত্যুসংখ্যা পেরিয়েছে ১০০। দুর্যোগ এখনও থামেনি। মাঝেমধ্যে বিরতি এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা সাময়িক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে না হতেই ফের তাণ্ডব শুরু করেছে বর্ষা।
হিমাচলের সঙ্গে প্রায় সমান ভাবেই ভুগছে পার্শ্ববর্তী উত্তরাখণ্ড। হিমালয়-রাজ্যগুলিতে কেন এমন বিপর্যয়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং পশ্চিমি ঝঞ্ঝার জোড়া ধাক্কাতেই পাহাড়ি রাজ্যে এমন লাগাতার বৃষ্টি। পাহাড়ে অবশ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় নতুন নয়। আচমকা বন্যায় এক রাতে ভেসে গিয়েছে আস্ত জনপদ— এমন ঘটনা বহু বার ঘটেছে। ১৯৯৮ সালে পিথোরাগড়ের কাছে এক কাদার বন্যায় মৃত্যু হয় নৃত্যশিল্পী প্রতিমা বেদীর, আরও শতাধিক তীর্থযাত্রীর সঙ্গে। কিন্তু সম্প্রতি যেমন ঘন ঘন মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বানের সংবাদ মিলছে, তার নমুনা আগে বিশেষ দেখা যায়নি। বিশেষত গত দশ বছরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিরিখে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা যেন নিয়ম করে ফেলেছে উত্তরাখণ্ড এবং পার্শ্ববর্তী হিমাচলপ্রদেশ। এর মধ্যে ভয়ঙ্করতম ঘটনাটি অবশ্যই ২০১৩ সালের কেদারনাথের মহাপ্লাবন। সরকারি হিসাবেই সেখানে প্রাণহানি ছাড়িয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজারের গণ্ডি। বেসরকারি মতে, এখনও বহু মৃতদেহ চাপা পড়ে রয়েছে কাদামাটির স্তরের মধ্যে। তার উপর দিয়েই তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তা, নতুন ভাবে শুরু হয়েছে কেদারনাথ যাত্রা। এই বছর সেই মহাবিপর্যয়েরও দশ বছর পূর্ণ হল।
অতিবৃষ্টি অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে ভারতের হিমালয়-লাগোয়া অঞ্চল এবং উপকূলবর্তী এলাকা। সেই পরিণতিই ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। তবে, এমন অঘটনের জন্য প্রাকৃতিক পরিবর্তন যতখানি দায়ী, মানুষের কাজকর্মের দায়ভার তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। পাহাড়ি রাজ্য দু’টিতে গড়ে ওঠা কংক্রিটের জঙ্গল আর ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে আসা সবুজের চিহ্ন দেখলেই তা বোঝা যায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গায়ে গা লাগিয়ে গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্তরাঁর সারি: এর ক’টি নিয়ম মেনে হয়েছে? ভূপ্রাকৃতিক ভাবে স্পর্শকাতর এলাকায় পর্যটনের স্বার্থে যথেচ্ছ চওড়া করা হয়েছে রাস্তা, উপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ছাড়াই। যে ভাবে আড়াআড়ি পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে, তার ফলে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেই সৃষ্টি হচ্ছে বিরাট ভূমিধসের। রেহাই পাচ্ছে না নবগঠিত রাস্তাগুলিও। হিমাচলপ্রদেশে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত শিমলা এবং কুলু-মানালি উপত্যকা। গত পাঁচ বছরে সেখানে নির্মাণকাজ তুঙ্গে উঠেছে। ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, পাহাড় কাঁপিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আরও চওড়া হচ্ছে রাস্তা। নদীর ঠিক ধার ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে হোটেল, রাস্তা। চওড়া দেওয়াল তুলে পাহাড়ি নদীর স্বাভাবিক স্রোতকে ব্যাহত করে তাকে সঙ্কীর্ণতর করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে জল যখন বাড়ছে, তখন মানুষ-নির্ধারিত গণ্ডি ছাপিয়ে জল ভাসিয়ে দিচ্ছে আশপাশের এলাকা।
আসলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা যত তীব্র হয়, তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম। ২০১৩ সালের কেদারনাথের ভয়াবহ বন্যার পর জাতীয় সবুজ আদালত একটি মোক্ষম কথা উচ্চারণ করেছিল— এই মহাপ্লাবনের পিছনে ঈশ্বরের কোনও হাত নেই। একই সঙ্গে আদালত অলকানন্দা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে নির্দেশ দিয়েছিল, ৯.২৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। কারণ, তাদের নির্মাণজাত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল— এই কোম্পানি ভালমতোই জানত যে, প্রকল্পটি ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে হিমালয়ের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকার মধ্যে পড়ে, যেখানে মেঘফাটা বৃষ্টি প্রায়শই ঘটে। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এই ধরনের প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নির্দেশ জারি করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোম্পানি কোনও সাবধানতা না নিয়েই প্রকল্পজাত বর্জ্য জমা করতে থাকে বাঁধের দরজাগুলির কাছেই। ফলে, মেঘভাঙা বৃষ্টি যখন নামে, তখন প্রবল স্রোতের সঙ্গে এই বর্জ্যও নেমে এসে ভাসিয়ে দেয় পৌড়ী-গাড়োয়াল জেলা। একই অবস্থা দেখা গিয়েছে সম্প্রতি হিমাচলে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পজাত বর্জ্য হামেশাই সঞ্চিত হচ্ছে নদীর খাতে। বাধার সৃষ্টি করছে নদীর সহজ গতিতে, ভরাট করে দিচ্ছে নদীখাত। ফলে, অতিবৃষ্টিতে যখন জলতল বাড়ছে, তখন নদীর জলের সঙ্গে সেই বর্জ্যও ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকায়। পার্বতী, বিয়াস, শতদ্রু-র মতো নদীতে এই চিত্রই এখন বাস্তব।
পাহাড়ি এলাকায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি কী ক্ষতিসাধন করছে, তা খতিয়ে দেখতে ইতিপূর্বে বহু আলোচনা হয়েছে। ২০১৩ সালের উত্তরাখণ্ড বন্যার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল উত্তরাখণ্ডে কোনও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া পর্যন্ত আর যেন পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র না দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে রবি চোপড়ার নেতৃত্বে গঠিত ১৭ সদস্যের কমিটি জানায়, উঁচু পাহাড়ি এলাকায় হিমবাহের গলন এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মিত কাঠামো এবং বাঁধ নীচের দিকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত এই বিশেষজ্ঞ কমিটি স্পষ্টই জানিয়েছিল যে, ২০১৩ সালের বন্যার ধ্বংসলীলা ওই মাত্রায় পৌঁছনোর পিছনে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তারা প্রস্তাব দিয়েছিল, উত্তরাখণ্ডে অন্তত ২৩টি বাঁধ প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করার। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কর্ণপাত করেনি। বরং আরও একাধিক কমিটি গঠন, শুনানি এবং বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব সংশোধনের পরেও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি নিয়ে সরকারের কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার কথা আজও জানা যায়নি।
উন্নয়নকে একেবারে থমকে দিয়ে পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখার ভাবনাটি হয়তো যুক্তিযুক্ত নয়। উভয়কেই সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই কাজ করবে কে? আশ্চর্য এটাই, এ দেশে ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকে স্পর্শকাতর এলাকায় উন্নয়ন কোন পথে হবে, সে বিষয়ে প্রতি বার উদ্যোগী হতে হয় বিচারবিভাগকে, জারি করতে হয় নির্দেশিকা। অথচ, প্রয়োগগত দিকটি দেখার দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যস্ত থাকে আদালতের নির্দেশিকার ফাঁকফোকর খুঁজে লাভের কড়িটি পকেটস্থ করার কাজে। পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়নের পথ খোঁজার তাগিদ বা ইচ্ছে— কোনও সরকারেরই থাকে না। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি কমিটি চার ধাম যাত্রায় দৈনন্দিন পর্যটকের সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। পর্যটক নিয়ন্ত্রণের কারণটি সহজবোধ্য। এখানকার ভঙ্গুর মাটি অত্যধিক চাপ সইতে পারে না। আর পর্যটন তো শুধু মানুষের সংখ্যাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের আয়োজনটিও বিপুল, এখানকার মাটির স্বাভাবিক সহনক্ষমতার বহু গুণ বেশি। উত্তরাখণ্ড সরকার পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ মানল ঠিকই, কিন্তু যে সীমা নির্দিষ্ট করল, তা প্রস্তাবিত সংখ্যার অনেক বেশি। এই বছর মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী সেই সীমারেখাটিও তুলে নিয়েছেন। ফলে, পর্যটকের ঢল নেমেছে পাহাড়ে।
ঠিক একই ছবি কি আমরা দার্জিলিং, সিকিমের ক্ষেত্রেও দেখিনি? সেই একই রকম পাহাড় ফাটিয়ে, কেটে রাস্তা বানানো, সবুজ উড়িয়ে পাহাড়ের ঢালে সারি সারি হোটেল, রেস্তরাঁ, পাহাড় কাঁপিয়ে টানেল গড়ার কাজ... এর মধ্যে কতগুলি পরিবেশ আইন মেনে তৈরি হয়েছে? কিলোমিটারের হিসাবে আজ হয়তো হিমাচল-উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়কে অনেক দূরের বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কালই যে সে ঘরের কাছেই নেমে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy