—প্রতীকী ছবি।
পাবলো পিকাসো বলেছিলেন, রাফায়েলের মতো ছবি আঁকা শিখতে আমার চার বছর সময় লেগেছে, কিন্তু সারা জীবন ধরে শিখেছি কী করে একটি শিশুর মতো ছবি আঁকতে হয়। এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে আমাদের সবার আগে শিশুমন বুঝতে হবে। ‘শিশুর মতো ছবি আঁকা’ কী, আমাদের এই শহুরে বস্তুনিষ্ঠ ও ব্র্যান্ডসর্বস্ব মন বোঝে না। একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার পথে আমরা তার মনোজগতে নিজেদের মনের বোঝা চাপিয়ে দিই, মগজে পুরে দিই সফল হওয়ার ফর্মুলা। শিশুটি হয়তো বড় হয়ে ‘সফল’ হয়, কিন্তু আমাদের বস্তুগ্রাসী চাপে কবে তার নরম মনটি শুকিয়ে যায়, আমরা বুঝতে পারি না।
শিশু যখন প্রথম দেখতে শুরু করে, তখনই জন্ম নেয় তার শিল্পী সত্তা। এক থেকে তিন বছর, হাতেখড়ির বয়স অবধি ছবি আঁকা চলতে থাকে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মতো। সেই সব হিজিবিজি আঁকিবুকির মধ্যেই তার সুস্থ মানসিক সত্তার প্রকাশ, তার মধ্যেই চলতে থাকে ক্রমাগত এক আত্ম-আবিষ্কারের খেলা। এটাই ‘চাইল্ড আর্ট’। তিন থেকে ছয় বছরে সেই সব হিজিবিজি ক্রমশ মিলতে থাকে শিশুটির চার পাশে দেখা বিভিন্ন ‘শেপ’ বা আকৃতির সঙ্গে। শুরু হয় ‘দেখতে শেখা’র পালা, রং চিনতে শেখা। আর এখানেই ঘটে বিপত্তি: মনের আনন্দে আকাশের গায়ে সবুজ আর গাছের পাতায় নীল রং বোলানো শিশুটির উপর রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। ‘ঠিক রং’ লাগানোর নানা কায়দা, ‘ঠিক ছবি আঁকা’ শেখানোর জন্য খুঁজে বেড়াই আর্ট টিচার। ক্রমে শিশুটি নিজের অস্তিত্ব ভুলে ‘আমাদের মতো’ ভাবতে শেখে, ‘আমাদের ইচ্ছে’ অনুযায়ী বড় হতে থাকে। আমরা তৈরি করি প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন এক ‘যন্ত্র-শিশু’, তার ‘পারফরম্যান্স’ দেখে গর্বিত হই।
শিশুদের শিল্পশিক্ষা এমনই এক বিষয়, যার সঙ্গে ভবিষ্যতে তাদের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু সংবেদনশীল মানুষ হয়ে ওঠার সঙ্গে যথেষ্ট সম্পর্ক আছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি একমাত্র শিল্পমাধ্যম, যেখানে কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে প্রথমে, পরে আসে ব্যাকরণ-প্রকরণ। আমরা ঠিক উল্টোটা করি, শিশুর কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটার আগেই চাপিয়ে দিই প্রকরণের বোঝা। ফলে শিশুটি ভাবতে শেখার আগেই আঁকতে শিখে যায়; বছর ঘুরলে দেখা যায়, পঞ্চাশটি রংওয়ালা প্যাস্টেল-বাক্সের পঁচিশ-ত্রিশটি রং সে ছোঁয়নি, কারণ তাকে ওই সব রঙের ব্যবহার শেখানোই হয়নি। শিশুকাল থেকেই আমরা তাকে রং ব্যবহারেও দমিয়ে রাখি। শিশু-শিল্পশিক্ষার মূল শর্তই হল কল্পনা ও স্বাধীনতা, শিশুমনের কল্পনাকে স্বাধীন ভাবে উড়তে দেওয়াই তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অস্ট্রিয়ান শিল্পী ও শিল্পশিক্ষক ফ্রানৎজ় সিজ়েক ‘চাইল্ড আর্ট’ শব্দটির প্রচলন করেন, তাঁর হাত ধরেই ১৮৯৭-এ শুরু হয় প্রথম ‘চাইল্ড আর্ট’ আন্দোলন। তিনি এক অননুকরণীয় প্রথায় শিশুদের ছবি আঁকার ক্লাস শুরু করেন: পাঁচ থেকে চোদ্দো বছর বয়সি শিশুদের খাতায় ছবি এঁকে দেওয়ার বদলে তিনি নানা গল্প বলতেন, বর্ণনার মাধ্যমে তাদের কল্পনা বা স্মৃতি উস্কে দিতেন। শিশুর কল্পনা ফুটে উঠত রঙে রেখায়, তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। সিজ়েক শিশুদের ভাবতে শেখাতেন, আঁকতে নয়। রুথ কালমার উইলসন, সিজ়েক-এর সেই সময়ের এক শিশু শিক্ষার্থী, পরবর্তী কালে যিনি চিত্রশিল্পী ও বিশেষত শিল্পশিক্ষক হিসাবে নানা দেশে বেশ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন— তাঁর কথায়, সিজ়েক শিল্পী তৈরি করা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না, প্রতিটি শিশুর ব্যক্তিত্বে শৈল্পিক সত্তার প্রকাশই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
শিশুশিক্ষার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নিয়ে আমরা উদাসীন। একটি শিশুকে ‘বড়দের মতো’ ছবি আঁকা শিখিয়ে ঠেলে দিই প্রতিযোগিতায়, পুরস্কারের দৌড়ে। কেউ কেউ পেয়েও যায় সে পুরস্কার; কিন্তু এই দৌড়ে সফল ও অসফল দুই পক্ষই ক্রমশ শিল্পসত্তার বিকাশ থেকে বহু যোজন দূরে সরে যায়। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে: যে শিশুটি ক্লাস ওয়ান টু থ্রি-তে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো ছবি আঁকত, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর ছবি আঁকতেই পারছে না। কারণ তার ছবির কল্পনার উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ চলে গেছে। দোষ আমাদেরই, আমরাই শৈশব থেকে তাকে শুধু ছবি আঁকার প্রকরণ আর ফর্মুলা শিখিয়ে এসেছি; ছবি আঁকা যে তার কাছে আত্ম-আবিষ্কারের মাধ্যম তা ভুলে গিয়ে তার কল্পনার আকাশকে ঢেকে দিয়েছি নিজেদের ইচ্ছা দিয়ে। এতে শিশুটি মনে মনে কষ্ট পেতে পেতে বড় হয়, বাইরে থেকে যা বোঝা যায় না। কৈশোরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যা পরিণত হয় বিদ্রোহে, সে ক্রমশ একরোখা, উদ্ধত হয়ে ওঠে। আমরা ‘এখনকার ছেলেমেয়ে, কিছু বলার নেই’ বলে নিজেদের পিঠ বাঁচাই।
শিশুশিক্ষার এই দিকটি আজও অবহেলিত। স্কুলে ও স্কুলের বাইরে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদানে যাঁরা যুক্ত, বিশেষত ছোটদের ছবি আঁকা ‘শেখানো’র কাজটিতে, তাঁরাই পারেন শিশুমনের বিকাশের পথ সুগম করে তুলতে। শিশু ভোলানাথ গ্রন্থের ‘গ্রন্থপরিচয়’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “প্রবীণের কেল্লার মধ্যে আটকা পড়ে... আবিষ্কার করেছিলুম, অন্তরের মধ্যে যে শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে-লোকান্তরে বিস্তৃত। এইজন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাটলুম, মনটাকে স্নিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে।” শিশুর কল্পনার সবুজ আকাশটা আজ বড় প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy