ইউনিসেফ প্রতি বছরই তাদের রিপোর্ট দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড’স চিলড্রেন-এ পৃথিবীর সব দেশের ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট (আইএমআর) বা শিশুমৃত্যুর হারের চিত্র তুলে ধরে। মানব উন্নয়নের প্রশ্নে শিশুমৃত্যুর হার— অর্থাৎ, জীবিত প্রসবের পর প্রথম এক বছরে প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ক’টি মারা যাচ্ছে— একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সিয়েরা লিয়োন এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। দু’টি দেশেই শিশুমৃত্যুর হার ৮১। এই হার ১০ বা তার নীচে, দুনিয়ায় এমন দেশের সংখ্যা ৭৫।
ভারত রয়েছে ১৩৯তম স্থানে— বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চিনের পিছনে। শ্রীলঙ্কা ও চিনে শিশুমৃত্যুর হার যথাক্রমে ৬ এবং ৭; ভারতে ২৮। ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসআরএস)-এর বুলেটিন থেকে জানা যাচ্ছে যে, ভারতে গ্রামাঞ্চলে শিশুমৃত্যুর হার ৩১, শহরে ১৯— ফারাকটি উদ্বেগজনক। পশ্চিমবঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার ১৯— গ্রামে ১৯, শহরে ১৭। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে কেরল (৬), তামিলনাড়ু (১৩), মহারাষ্ট্র (১৬) ও পঞ্জাব (১৮)। সবচেয়ে পিছিয়ে মধ্যপ্রদেশ (৪৩), উত্তরপ্রদেশ (৩৮)।
শিশুমৃত্যুর হার কমাতে রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক, জনতাত্ত্বিক এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরিষেবার বৈষম্য চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রকাশিত এনএফএইচএস-৫’এর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের রাজ্যে ধৰ্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে শিশুমৃত্যুর বৈষম্য তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। তবে মায়ের শিক্ষাস্তরের সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীর। যেখানে মা নিরক্ষর বা প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন, সেখানে শিশুমৃত্যুর হার ২৭.৫; আবার মায়ের শিক্ষাস্তর মাধ্যমিকের উপরে হলে এই হার মাত্র ৬.৮। বাচ্চার জন্মের সময় মায়ের বয়স যদি ২০ বছরের কম হয়, সে ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার ২৮.৫; অন্যথায় ১৯.৫। প্রসবের সময় বাচ্চার ওজন স্বাভাবিক, বা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হলে শিশুমৃত্যুর হার যেখানে ১৫.১, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের বাচ্চার ক্ষেত্রে তা ৫০.৮। ধনী-দরিদ্রের মধ্যেও বৈষম্য অনেক। তবে, আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, এ রাজ্যে যে পাঁচটি প্রশাসনিক বিভাগ আছে, তাদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হারে বিস্তর ফারাক। প্রেসিডেন্সি বিভাগে এই হার মাত্র ১২.৪, জলপাইগুড়ি বিভাগে ৩৩.৭। অন্য তিনটি বিভাগ— মালদহ, বর্ধমান ও মেদিনীপুরে যথাক্রমে ২৯.২, ২৫.৮ ও ১৯.৪।
শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিষেবার ভূমিকা অপরিসীম। স্বাস্থ্য পরিষেবার ভূমিকা আরও স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে হলে পেরি-নেটাল মর্টালিটি রেট (পিএমআর)— অর্থাৎ প্রতি হাজার প্রসবে মৃত প্রসব, ও জন্মের ৭ দিনের মধ্যে শিশুমৃত্যুর সংখ্যার যোগফল— নিয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এসআরএস-এর স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিপোর্ট বলছে, ভারতের পিএমআর ১৯, পশ্চিমবঙ্গের ১৬। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির নিরিখে যে সব রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কেরল (৮), পঞ্জাব (১১), তামিলনাড়ু (১১), মহারাষ্ট্র ও তেলঙ্গানা (১২)।
এসআরএস-এ পরিসংখ্যান তুলনায় নতুন, কিন্তু তাতে আন্তঃরাজ্য আঞ্চলিক বৈষম্য ধরা পড়ে না। তার জন্য এনএফএইচএস-৫’এর তথ্যভান্ডার ব্যবহার করতে হবে। এই সমীক্ষার সময়কাল ছিল ২০১৯ থেকে ২০২১। তার পূর্ববর্তী পাঁচ বছর সময়কালের চিত্র এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এনএফএইচএস-৫’এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের পিএমআর ৩১.৯, পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক পিএমআর ২৭.৫। কিন্তু, রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য উদ্বেগজনক। প্রেসিডেন্সি বিভাগের পিএমআর ১৮.০, মালদহ বিভাগে ৩৯.৮, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। বাকি তিনটি বিভাগে পিএমআর যথাক্রমে জলপাইগুড়ি ৩১.৯, বর্ধমান ২৮.৬ ও মেদিনীপুর ২৪.১।
দু’দশক আগে, ২০০২ সালে, যোজনা কমিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ইনস্টিটিউট অব ম্যানপাওয়ার রিসার্চ উত্তরবঙ্গের তুলনামূলক অনগ্রসরতার উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির (কিছু ক্ষেত্রে দার্জিলিং ব্যতিক্রম) পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে এই আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের সুপারিশ করা হয় এই প্রতিবেদনে। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও উত্তরবঙ্গের দু’টি প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে রাজ্যের বাকি তিনটি প্রশাসনিক বিভাগের বৈষম্য বিদ্যমান থাকার যে ইঙ্গিত এই লেখায় বর্ণিত পরিসংখ্যানে প্রতিভাত হচ্ছে, তা গভীর উদ্বেগের বিষয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি এই আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy