সঙ্কটাপন্ন: অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ও ত্রিশটি জনজাতি সংগঠনের নেতারা সিএএ-র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন, ডিব্রুগড়, ১০ মার্চ। পিটিআই।
আবার ফিরে এসেছে নাগরিকত্ব আইন বিষয়ক উৎকণ্ঠা। অনেক টালবাহানার পর চালু হল নতুন নাগরিকত্ব (সংশোধিত) আইন। লক্ষণীয়, ঠিক ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগেই তা চালু হল, এর আগে শেষ বড় শোরগোল শোনা গিয়েছিল ২০১৯ সালে। সুতরাং ‘এনআরসি’ আর ‘সিএএ’-র সঙ্গে ভোটপ্রচারের সংযোগ নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারে না। মাঝের এই পাঁচ বছরে, কিছু ছোট ঘটনাপ্রবাহের হাত ধরে, এই দুই শব্দ মাঝেমধ্যে আঞ্চলিক বা রাজ্য রাজনীতিতে ফিরে এলেও, জাতীয় স্তরে সে রকম কোনও জোরালো অভিঘাত লক্ষ করা যায়নি।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লিতে বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হল। এ দিকে ঘটছে আরও কিছু জরুরি ঘটনা। গত ১২ ফেব্রুয়ারি অসম বিধানসভায় বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থের প্রশ্নের উত্তরে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা এখনও প্রকাশ হয়নি। তাই, সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই-এর আদেশ অনুসারে, অসমে ২৬,৫২,৭৮৪ জনের আধার কার্ড ‘হোল্ড’-এ রাখা হয়েছে।
তা হলে বিষয়টা দাঁড়াল যে, এক দিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান-সহ ‘নির্যাতিত’ অমুসলিম অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য আইন চালু হয়ে গেল। অন্য দিকে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিলেন যে, ২০১৫ সাল থেকে রাষ্ট্রের তৈরি অগ্নিপরীক্ষার এতগুলো পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েও, প্রায় সাড়ে ২৬ লক্ষ অসমের মানুষ এখনও আধার কার্ড হাতে পাননি, এবং ১৯ লক্ষ লোক এনআরসি লিস্টে নাম তুলতে পারেননি। মজার ব্যাপার হল, এই সাড়ে ২৬ লক্ষের মধ্যে অনেকের নাম এনআরসি-র ফাইনাল বা সাপ্লিমেন্টারি লিস্টে থাকা সত্ত্বেও আধার কার্ড আজ অবধি তাঁরা হাতে পাননি। অথচ, কেন্দ্র ও অসম রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ বিজেপি সরকার অনেক বার প্রকাশ্যে বলেছে, আধার কার্ড থাকা বা না থাকার সঙ্গে নাগরিকত্বের কোনও যোগ নেই।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয়— অসমের জনগণ, বিশেষ করে সুরমা বা বরাক ভ্যালির বাঙালিদের নাগরিকত্ব, ডি-ভোটার, এনআরসি, আধার সংক্রান্ত সমস্যা আর পিছু ছাড়ছে না। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলনের জেরে ভোটার আইডি, জায়গার দলিল, এমনকি পাসপোর্ট-সহ কোনও নথিই নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না অসমে, যদি না তা ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর আগের হয়। অসম পাবলিক ওয়ার্কার্স নামের এক বেসরকারি সংস্থা এনআরসি প্রস্তুত করার দাবিতে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে প্রথম জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিল। তার পর রাজ্য সরকারের মডেলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের মতের টানাপড়েনের পর অসমে যখন রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ আরম্ভ হয়, তখন অসমের বাসিন্দারা এনআরসি-তে নাম তুলতে এক রকম বদ্ধপরিকর ছিলেন। এনআরসি-তে নাম নথিবদ্ধ করার মাধ্যমে তাঁদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত এবং অস্তিত্বের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে, এই বিশ্বাসে অনেক হেনস্থা সত্ত্বেও, তাঁরা সব রকম সরকারি নিয়ম মেনে নিয়েছিলেন। অসম সরকার আইএএস আধিকারিক প্রতীক হাজেলাকে এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়কারী মনোনীত করলে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকেই অসমের জন্য ‘ডিরেক্টর অব সেন্সাস’ হিসাবে দায়িত্ব দেয়।
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েনস (এনআরসি), এই দু’টি বিষয় অসমের ক্ষেত্রে কতটা পরস্পর সংযুক্ত, তা বোঝা যায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পাশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ভারতের যে কোনও রাজ্যে যেখানে সাধারণ মানুষের দরজায় ঘুরে ঘুরে পপুলেশন রেজিস্টার করা হয়, অসমের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো হয়েছিল। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য অসমের নাগরিকদের ২০১৫ সালের ১ এপ্রিলকে ‘বেস ডেট’ ধরে এনপিআর এবং এনআরসি সংক্রান্ত আবেদনপত্র জমা নেওয়া হয়েছিল অগস্টের ৩১ তারিখ অবধি। নিয়ম করা হয়েছিল, স্ক্রুটিনির মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে এনআরসি লিস্টে নাম উঠবে। সন্দেহজনক নাগরিক বা অনাগরিকদের নোটিস দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় ৯৬,৯৮৭ জন ছিলেন ‘ডি-ভোটার’।
এত সব কাণ্ডের পর, ২০১৮-র জুলাই মাসে অসমে এনআরসি ড্রাফট লিস্ট-এ প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছিলেন। এঁদের বলা হয় ‘ক্লেমস অ্যান্ড অবজেকশনস’ ফর্ম ফিল-আপ করতে। বায়োমেট্রিক দিয়ে এনআরসি লিস্টে নাম তুলতে হবে, এবং নাম উঠলে আধার কার্ড দেওয়া হবে। প্রথম এনআরসি লিস্ট থেকে বাদ পড়া ৪১ লক্ষ মানুষের মধ্যে বায়োমেট্রিক দিয়েছেন ২৭,৪৩,৩৯৬ জন। তবু ২০১৯ সালের ৩১ অগস্ট প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিতে প্রায় ১৯ লক্ষ ২২ হাজার আবেদনকারীর নাম অন্তর্ভুক্ত না করে এনআরসি-র তালিকা প্রকাশিত হয়। বাকিদের আজও রিজেকশন অর্ডারের কপি দেওয়া হয়নি, তাঁদের নাম বাদ পড়ার কারণ জানানো হয়নি।
এনআরসি-র চূড়ান্ত লিস্ট বেরোনোর পর অসম সরকার বলতে শুরু করে, এই লিস্ট তারা মানছে না। কারণ, এতে নাকি অনেক বিদেশির নাম ঢুকে গেছে। এ দিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতীক হাজেলার তত্ত্বাবধানে তৈরি ২০১৯ সালের ওই তালিকা এখনও সরকারি ওয়েবসাইটে আছে। তার মধ্যেই পেশ করা হচ্ছে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য।
এনআরসি ফাইনাল এবং সাপ্লিমেন্টারি লিস্টে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের আধার কার্ড পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুশকিল হল, এই তালিকার ভিত্তিতে এখন আধার কার্ড দিলে প্রমাণ হয়ে যাবে যে, তা সরকার মেনে নিয়েছে। ফলে সাড়ে ২৬ লক্ষাধিক মানুষের আধার আটকে রেখেছে সরকার, যার মধ্যে ১৭ লক্ষ মানুষের নাম নাকি সাপ্লিমেন্টারি লিস্টে এসে গেছে। এখন রাজ্য সরকার এক দিকে বলছে, তারা সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করবে এনআরসি লিস্টে নাম ওঠা ব্যক্তিদের আধার দেওয়ার জন্য। অন্য দিকে বলছে, এই বিষয়টা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষ। কারণ, এটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় আছে, তাই কোর্টের অনুমতি ছাড়া এই মানুষগুলোকে আধার দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের কিছু করার নেই, কারণ এই সম্পর্কিত কোনও আইন নেই। বিপদের কথা, যাঁদের আধার আটকে আছে, তাঁরা নতুন আধারের জন্যও আবেদন করতে পারছেন না। আধার কার্ড না থাকা এবং আধার-রেশন লিঙ্ক না করার কারণে, অসমে কেটে গেছে অনেকের রেশন কার্ড। পি এম বিশ্বকর্মা স্কিম, পি এম কিসান যোজনা, আয়ুষ্মান ভারত ইত্যাদি যোজনার সুবিধা পাওয়ার জন্য আধার লিঙ্ক জরুরি, কিন্তু তা না থাকায় কোনও স্কিম থেকে টাকা ঢুকছে না। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি, এডুকেশন লোন, এমনকি চাকরির আবেদন করতেও আধার অপরিহার্য।
আধার আইন অনুযায়ী, বায়োমেট্রিক দিয়ে আবেদন করার পরও যাঁদের আধার ইস্যু হয়নি, তাঁরা আধার নম্বর এবং অন্য বিকল্প পরিচয়পত্র দিয়ে বিভিন্ন সরকারি সুযোগসুবিধা পেতে পারেন। অসম সরকার এই নিয়ম মানছে না, যার ফলে বিশেষত চূড়ান্ত এনআরসি-তে নাম থাকা (যাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণিত) এবং বায়োমেট্রিক সংগ্রহ করার পর এনআরসি সংক্রান্ত আধার বেআইনি ভাবে আটকে রাখা প্রায় সাড়ে ২৬ লক্ষ মানুষ আতান্তরে পড়েছেন। এঁদের নিয়ে সরকারের কোনও হেলদোল নেই। উপরন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশিদের জন্য ‘আধার রেগুলেশন ২০১৬’-তে ধারা ‘২৮-এ’ যোগ করেছে ২০২৩ সালে, যার মাধ্যমে অনেকের আধার নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ধারককে আধার নিষ্ক্রিয় করার পর নোটিস পাঠানো হচ্ছে, যা আসলে অবৈধ।
সরকার বলছে, সিএএ-র মাধ্যমে শুধু পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেবে। কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য তা তৈরি হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে কি সন্দেহ থাকতে পারে, এই আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘুরা, দলিতরা এবং দেশের দরিদ্ররা ‘হয়রানি’র শিকার হবেন? অসমিয়ারা অবশ্য সিএএ-র বিরোধিতা করছিলেন আরও একটা কারণে। তাঁদের ভয়, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিলে বাঙালির সংখ্যা বেড়ে যাবে।
গোটা সমস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। কেউ অর্ধেক তথ্য জানেন, কেউ কিছু জানেন না। কেউ সমস্যার কথা জানেন, সমাধানের কথা জানেন না। দেখেশুনে মনে হয়, সরকারও চায় না এই ধোঁয়াশা কাটুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy