অভিজ্ঞান: গড়িয়াহাটের ফুটপাতে পুরনো বইয়ের দোকান, নব্বইয়ের দশকে। এখন অবশিষ্ট আছে কয়েকটি। প্রতীকী ছবি।
কিছু দিন আগে পড়ছিলাম সঙ্গীতজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যালের অতুলনীয় সৃষ্টি, স্মৃতির অতলে বইটি। প্রথমে ‘মিত্রালয়’ থেকে প্রকাশিত হলেও এক সঙ্গীতরসিক বন্ধুর মাধ্যমে আমার হাতে এসে পৌঁছয় বছর পঁচিশ-ত্রিশ আগে বেরোনো ‘জিজ্ঞাসা’ সংস্করণটি। এই সংস্করণটি যখন বেরোয়, তখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর উপর ‘জিজ্ঞাসা’-র বইয়ের দোকানটি ছিল আমাদের অনেকের কাছে ওই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান দিকচিহ্ন। এখন ঠিক ওইখানে হয়েছে একটি পোশাকের শো-রুম।
ভাবছিলাম, বছর পনেরো-কুড়ি আগেও জামাকাপড়-বাসনকোসনের দোকানের পাশে গড়িয়াহাট-রাসবিহারী অঞ্চলে দু’-তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অন্তত এক ডজন বইয়ের স্টলের কথা, যেগুলোর মধ্যে বড় জোর একটি কি দু’টি এখনও টিকে আছে। উৎকৃষ্ট মানের ফোটো স্টুডিয়োগুলোর বেলাতেও ছবিটা মোটামুটি এক।
এগুলো টিকে না থাকতে পারার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণ নিয়ে আলোচনা, অথবা ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরানোর কথা বলছি না। ভাবতে চাইছি পাড়াভিত্তিক ইতিহাসচর্চার সম্ভাবনা নিয়ে। শহরের বনেদি অংশগুলোর তো দু’-চারটে সুপরিচালিত ‘হেরিটেজ ওয়াক’ আছে, যেগুলোতে মূলত ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস তুলে ধরা হয় এবং বিদেশি/প্রবাসী অথবা শহরের অন্য পাড়ার বাসিন্দারা সেগুলোতে দর্শনার্থী হিসেবে যোগ দেন। আবার যে অঞ্চলগুলোয় ‘হেরিটেজ’ তকমা নেই, সে রকম কিছু দূরে-সরিয়ে-রাখা পাড়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চেষ্টা করে ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর মতো প্রয়াস— ‘গাইডেড ওয়াক’-এর মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এখানে বলতে চাইছি পাড়ার মানুষদের নিয়ে ব্যক্তিস্মৃতি, গোষ্ঠী-স্মৃতি ও কিছু নথিপত্রের সাহায্যে ছোট ছোট উদ্যোগের কথা। কারণ, দেখছি যে, পুরনো ঠিকানাগুলোয় নতুন সাইনবোর্ডের জোরালো উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাচ্ছে এই শহরের নানা সাংস্কৃতিক চিহ্ন, যেগুলো জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ঐতিহ্য’ হিসাবে সংরক্ষিত হওয়ার তালিকায় দাবিদার না হলেও, আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
যেমন আনোয়ার শাহ রোডে আশির দশক পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে চলা ‘ঊষা’ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক দিন টিকে ছিল ঊষা বাস স্টপ। আগে যেখানে সকাল ন’টার ভোঁ পড়লে আমরা বাড়িতে বসে ঘড়ি মেলাতাম, এখন সেখান থেকে ‘ঊষা’ নামটাই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। বছর পনেরো আগে তৈরি অত্যাধুনিক শপিং মল ও তৎসংলগ্ন আবাসনের নামটাই এখন মুখে মুখে ফেরে। ‘ঊষা’ গেট থেকে ‘নবীনা’ সিনেমা হল পর্যন্ত অনেক ছোট ছোট কারখানাও ছিল, যেখানে তৈরি হত টিনের ও প্লাস্টিকের নানা জিনিস; ছিল রং কল, বেকারি।
দেশভাগের পরের দু’দশকে টিপু সুলতানের বংশধরদের নাম বহনকারী আনোয়ার শাহ রোড ও তার আশপাশের অলিগলি, সেলিমপুর, যাদবপুর, বাঘা যতীনের মতো এক সময়কার মিশ্র অঞ্চলগুলোর জনবিন্যাস যখন উদ্বাস্তু আগমনের ফলে বদলে গেল, অন্যত্র চলে গেলেন বেশির ভাগ মুসলমান মানুষজন, সে সময়েও হারিয়ে গিয়েছে বেশ কিছু পুরনো সাংস্কৃতিক চিহ্ন। উদ্বাস্তু কলোনি হিসেবে গড়ে ওঠা বিজয়গড় শ্রী কলোনি আজ়াদগড় শহিদনগর অঞ্চলে আবার আর এক ধরনের চিহ্ন তৈরি হয়েছিল সত্তরের দশকে। কয়েকটা পাড়ার মোড়ে নকশাল আন্দোলন-কর্মীদের স্মৃতিতে শহিদ বেদি স্থাপিত হয় ওই সময়। অনেক বেদি আজও আছে। কিন্তু খুব পুরনো মানুষ ছাড়া আজ আর কেউ জানেন না, ওই বেদিগুলোতে খোদাই করা নামগুলোর সঙ্গে পাড়ার মোড়গুলোর সম্পর্ক কী।
আজ কলকাতার মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত পাড়ার চেহারা-চরিত্র খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, লুপ্ত হচ্ছে এক-একটা পাড়ার বিশেষ পরিচয়। যেমন রাসবিহারী-ত্রিকোণ পার্কের পিছনে একটা বাড়ির দোতলায় ঝুলত একশো দশে পা-দেওয়া সন্দেশ পত্রিকার সাইনবোর্ড। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক নলিনী দাশ সপরিবার থাকতেন সেখানে। নবীন ও প্রবীণ ‘সন্দেশী’দের মিলনস্থল ছিল সেটা। ওই ঠিকানায় সন্দেশ পত্রিকার অফিস আজও আছে, কিন্তু নতুন বহুতল ওঠার পর পুরনো সাইনবোর্ডের আর ঠাঁই হয়নি। ‘সন্দেশ-এর বাড়ি’র উল্লেখ করে আর কাউকে পথনির্দেশ দেওয়ার উপায় নেই।
নতুন গজিয়ে ওঠা চিহ্নগুলোর মধ্যে বিশেষ করে চোখে পড়ে বসতবাড়ির আঙিনায় নিত্যনতুন কফি শপ, কখনও কখনও আর্ট গ্যালারি। সত্তর-আশির দশকে পাড়ায় পাড়ায় কফি শপের ধারণা যখন অকল্পনীয় ছিল, তখন পুরনো বাড়িগুলোতে অনেক সময়েই গাড়ি না থাকলেও থাকত একটা গ্যারাজ-ঘর। সেই গ্যারাজ-ঘর অথবা বাড়ির সামনের ঘর থেকে বিনা ভাড়ায় পরিচালিত হত নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিস।
গ্যারাজ-ঘরগুলো কখনও ভাড়া দেওয়া হত দর্জির দোকানকে, কখনও লেটার প্রেসকে, আবার কখনও সুগৃহিণীরা নিজেরাই সেখানে চালাতেন দোকান। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ভালমন্দ খাবার বা শখের সেলাই বিক্রি করে দু’পয়সা রোজগারও হত, আবার সংসারের সব দিকে নজর রেখে চলাও যেত। ধরুন এলগিন রোডে ‘বেবি স্টোর্স’। দেবীপ্রসাদ-কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির এক তলায়। সেখানে হাতে-তৈরি বাচ্চাদের জিনিস ও খেলনার দোকান চালাতেন রেখা চট্টোপাধ্যায়, বাংলায় রুশ সাহিত্যের অন্যতম প্রধান অনুবাদক। কলকাতায় বেবি ফুডের সঙ্কট দেখা দিল ১৯৭০-৭২ নাগাদ। রেখা গোডাউনে গিয়ে গিয়ে বাসে করে বেবি ফুডের টিন আনতেন দোকানের জন্য। কৌটোর দুধ শিশুস্বাস্থ্যের পক্ষে এত খারাপ, তখন কে জানত?
সারা শহরে বদলে যাওয়া সামাজিক জীবনের বহু রকমের গল্প ছড়িয়ে আছে। পাড়ার সামাজিক-ভৌগোলিক মানচিত্রে নানা বদলের গল্প, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার কথা, গোষ্ঠীগত উদ্যোগের গল্প, আরও কত কী! মৌখিক ইতিহাস, ছবি, অন্যান্য স্মারক-চিহ্ন— এ সবের মধ্য দিয়ে এক-একটি মহল্লার ইতিহাস প্রাণ পেতে পারে, পাড়ার মানুষই তৈরি করতে পারেন ‘সাইট-স্পেসিফিক’ আর্কাইভ। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে একটি পাড়ার পুরনো প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটা, ছোট ছোট দলে পায়ে হেঁটে অঞ্চলটির ইতিহাস ফিরে দেখা— এগুলো হয়তো সম্ভব, যদি পাড়ার মানুষ উদ্যোগী হয়ে নিজেদের এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করেন।
পাড়ার মানুষদের অংশীদারিতে বেশ কয়েক বছর হল দিল্লির বাঙালিদের এমন একটি উদ্যোগ ‘নেবারহুড ডায়েরিজ়’ নামে খুবই জরুরি এই কাজটি করে চলেছে। চিত্তরঞ্জন পার্ক, যা কিনা এক সময় ছিল ‘ইস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড পার্সনস’ কলোনি (ইপিডিপি)’, দক্ষিণ দিল্লির সেই একদা-পাথুরে অঞ্চলের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজধানীতে আসা হিন্দু বাঙালিদের নতুন বসতি গড়ে তোলার নানা কাহিনি, যদিও সেই কাহিনিগুলো কলকাতার বাস্তুহারা মানুষদের তৈরি কলোনির থেকে, এবং কলকাতার বাইরে প্রান্তবাসী উদ্বাস্তুদের বসতি স্থাপনের সংগ্রামের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা— কারণ ইপিডিপি কলোনির প্রতিষ্ঠাতারা বেশির ভাগ ছিলেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দিল্লিতে কর্মরত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী।
এখন চিত্তরঞ্জন পার্ক খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত ও অনেকাংশে মিশ্র অঞ্চল। গত ষাট বছরে ওই অঞ্চলের বিবর্তন কী ভাবে ঘটেছে তা নিয়ে ‘নেবারহুড ডায়েরিজ়’ নিয়মিত এলাকার প্রাচীন ও নবীন প্রতিবেশীদের একত্র করে। আমাদের শহরে উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর ইতিহাস নিয়ে অনেক জরুরি বই, সিনেমা, মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প, প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু ‘নেবারহুড ডায়েরিজ়’-এর কাজটা অন্য রকম, কারণ তা পাবলিক হিস্ট্রি প্রোজেক্টের আদলে অঞ্চলের মধ্যে নানা উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণ করে চলে। দু’-তিন জন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীর্ঘ দিন যুক্ত এই কাজের সঙ্গে। বাঙালি উপনিবেশের বাইরে হিন্দু ভদ্রলোক, দিল্লির মধ্যে যে অনেক দিল্লির গল্প আছে, সেগুলো নিয়ে চর্চাও এঁদের উদ্যোগের অংশ। অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবিকতা ও সহ-নাগরিকত্বের বোধ চারিয়ে দেওয়াতে এর ভূমিকা কম নয়। আমরা কলকাতাবাসীরাও ভেবে দেখতে পারি পাড়া-ভিত্তিক ইতিহাসচর্চা করা যায় কি না এবং তা কী ভাবে কাজে লাগানো যায় নিজেদের এলাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বেদখল হওয়া চিহ্নগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে, নতুন করে বেঁধে বেঁধে থাকার পাঠ নিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy