Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
K. G. Subramanyan

শিল্পী আর শিক্ষকের সেতু

দক্ষিণের মালাবার অঞ্চলের এক ছোট্ট শহরে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য লেখাপড়ার সূচনা ঘটেছে কিছু দেরিতে। স্বাস্থ্যের কারণেই ছোটবেলায় খেলাধুলার চেয়ে ছবি আঁকার প্রতি টান ছিল বেশি।

K. G. Subramanyan

—ফাইল চিত্র।

সুশোভন অধিকারী
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১০
Share: Save:

বিখ্যাত শিল্পী আর সংবেদী শিক্ষকের সার্থক সহাবস্থান সচরাচর ঘটে না। শিল্পী নিয়ত এগিয়ে চলেন আত্ম-অনুসন্ধানের পথে, অভিব্যক্তি প্রকাশের এক স্বতন্ত্র খোঁজ থাকে তাঁর চলার অভিমুখে। পথের সেই অভিজ্ঞতা, বোধের একান্ত পাঠ শিল্পীর অন্তস্তল আলোড়িত করলেও সে আঁচ সর্বদা অন্যের কাছে পৌঁছতে পারে না, অব্যক্ত রয়ে যায় অন্তরিন্দ্রিয়ের উপলব্ধি। শিষ্যের বীজভাবনাকে আপন চেতনার আলো দিয়ে যিনি সামনের দিকে এগিয়ে দিতে পারেন, তিনিই প্রকৃত গুরু, যথার্থ শিক্ষক।

সদ্য জন্মশতবর্ষের চৌকাঠ স্পর্শ করা শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যন (ছবি) অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার— শিল্পী আর শিক্ষকের মাঝে যিনি সেই সেতুর অনায়াস নির্মাণ করেছিলেন। প্রশ্ন জাগে, চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সুদূর দক্ষিণ থেকে আসা কলাভবনের ছাত্রটি কোন মায়ামন্ত্রে মিশে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রম-পরিবেশের সঙ্গে? পরবর্তী কালে কেমন করেই বা অর্জন করেছিলেন শিল্পাচার্যের সেই দুর্লভ উত্তরাধিকার? বরেণ্য শিল্পী তথা নামী অধ্যাপকের তকমা সরিয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন আশ্রমের ছোট-বড় সকলের কাছের মানুষ, সমগ্র শান্তিনিকেতনের প্রিয় ‘মানিদা’— তার নেপথ্যে ছিল কোন জাদু?

দক্ষিণের মালাবার অঞ্চলের এক ছোট্ট শহরে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য লেখাপড়ার সূচনা ঘটেছে কিছু দেরিতে। স্বাস্থ্যের কারণেই ছোটবেলায় খেলাধুলার চেয়ে ছবি আঁকার প্রতি টান ছিল বেশি। সে দিক থেকে দেখলে শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর শিশুকালের কিছু সাদৃশ্য লক্ষণীয়। ভগ্ন স্বাস্থ্য ও ক্ষীণ দৃষ্টি বিনোদবিহারীকেও ঠেলে দিয়েছিল বই আর শিল্পের দিকে। উভয়ের ক্ষেত্রেই শিল্পের প্রতি শৈশবের অমোঘ টান আজীবন অটুট থেকেছে। তরুণ সুব্রহ্মণ্যন চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন গান্ধীজির আহ্বানে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে কারাবরণ করেছেন।

তবে তাঁর ‘টার্নিং পয়েন্ট’ শান্তিনিকেতন। ১৯৪৪ সালে ছবি আঁকার পাঠ নিতে এলে কলাভবন তাঁকে আমূল বদলে দিয়েছে। যখন প্রথম আসেন, সদ্য প্রয়াত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ সেই পর্বে বিশ্বভারতীর আচার্যের পদে অধিষ্ঠিত। কলাভবনের প্রাঙ্গণে শিল্পী গুরুকে দেখার সেই স্মৃতি আজীবন অমলিন থেকেছে তাঁর মনে। শুধু কি তা-ই? বসন্তশেষের শিমুল-পলাশে রাঙা শান্তিনিকেতন প্রথম দিন থেকেই নিবিড় ভাবে তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। এখানেই দেখা পেয়েছেন তিন শিক্ষক— নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় আর রামকিঙ্কর বেজের। ভাবনা ও বোধের স্বাতন্ত্র্যে তিন জন শিল্পী হিসাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আলাপচারিতার ফাঁকে সুব্রহ্মণ্যনের কথায় বার বার উঠে এসেছে কলাভবনের শিক্ষা আর এই শিল্পগুরুদের প্রসঙ্গ।

ছাত্রবেলার গোড়ার দিকে স্কেচ করতে খুব ভালবাসতেন সুব্রহ্মণ্যন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রায় রামকিঙ্করের ছায়াসঙ্গী। নিজেই বলেছেন সে কথা: “কিঙ্করদার সঙ্গে বহুদিন ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকেছি। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা।” সেই স্কেচের গোছা নিয়ে হাজির হয়েছেন নন্দলালের দরবারে। ছবির বিপুল পরিমাণ দেখে বিস্মিত ‘মাস্টারমশাই’ বলেছেন, “তুমি তো অনেক কাজ করেছ।” উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ছবির খুঁতগুলোও ধরিয়ে দিয়েছেন নন্দলাল। বলেছেন, স্কেচ করার সময় অবজেক্টের অনুপুঙ্খ ডিটেল থেকে চোখ সরিয়ে নিতে। বলেছেন, উপরিতল নয়, সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় বস্তুর ভিতরের কাঠামোর দিকে। কেবল উপদেশ দিয়েই থেমে থাকেননি, পেনসিল বা কলমের সূক্ষ্ম আঁচড়ে স্কেচ করার পরিবর্তে ছাত্রের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন বড় চারকোলের টুকরো, যাতে ডিটেলের ছাঁকনিতে পরিস্রুত হয়ে ছবির মূল আকারটুকু ফুটে উঠতে চায়। নবীন ছাত্রের প্রতি এ-ই আচার্যের স্নেহের উপদেশ। সে অভিজ্ঞতার স্মৃতি সুব্রহ্মণ্যনের কথায়,
“এই প্রথম আমি হাতেনাতে বুঝলাম, দুটো ভাষা কতখানি ভিন্ন। মাস্টারমশাই সেটা আমাকে ধরিয়ে দিলেন।” ছাত্রজীবনের সেই শিক্ষা গভীর ছাপ ফেলেছে মনের মধ্যে।

অন্য দিকে বিনোদবিহারী প্রসঙ্গে বলেছেন, “তিনি আমার কাছে অতুলনীয়।” শিল্প বিষয়ক অপরিসীম জ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যপাঠের আগ্রহে বিস্মিত হয়েছেন সুব্রহ্মণ্যন। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি প্রসঙ্গে বলেছেন, “যে বইটি তিনি পড়ে ফেলেছেন, তার পাতায় পাতায় কী লেখা আছে, বইটি না দেখে অনুপুঙ্খ বলতে পারতেন বিনোদদা।” আর রামকিঙ্কর, কী ভাবে তিনি ছাপ ফেলেছিলেন ছাত্র সুব্রহ্মণ্যনের অন্তরে? মার্কা-দেওয়া পুঁথিগত বিদ্যার অপর প্রান্তে নিজের মতো করে বিদেশি সাহিত্যের প্রতি রামকিঙ্করের উপলব্ধি হতবাক করেছে তাঁকে। জানিয়েছেন, “কিঙ্করদার বাড়িতে যখন নিয়মিত যেতাম, দেখেছি, কী নিবিড়ভাবে তিনি পাঠ নিচ্ছেন ইংরাজি সাহিত্যের।” শেখার অদম্য ইচ্ছার পাশাপাশি রামকিঙ্করের অনুভবশক্তির প্রাবল্যে চমকিত হয়েছেন।

শান্তিনিকেতনের এই তিন মহাশিক্ষকের গভীর সাহচর্য সুব্রহ্মণ্যনের অন্তরে গড়ে দিয়েছিল শিল্প-জিজ্ঞাসার দুর্মর বনিয়াদ। কেবল আঙ্গিকের শিক্ষা নয়, শিল্পের আদর্শ আর দার্শনিক বোধে নিয়ত স্নাত হয়েছেন। তাই বুঝি বারে বারে ফিরে এসেছেন কবির আশ্রমে, তাঁর তিন শিক্ষকের সৃষ্টির লীলাভূমিতে। তবে কখনও শিক্ষক বা গুরুমশাই হতে চাননি, হয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের সহৃদয় বন্ধু, সহশিল্পী। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন আনন্দের উপাসক, জীবনকে দেখেছেন আনন্দের অনন্ত উৎসব রূপে। আবার শিল্পক্ষেত্রে প্রকাশের সহজ স্বতঃস্ফূর্তির সঙ্গে মিলিয়েছেন বিশ্লেষণী মন, ধরতে চেয়েছেন আকারের অখণ্ড মহাযাত্রা। কিন্তু সেই ‘অধরা মাধুরী’কে রং-রেখার ছন্দোবন্ধনে বাঁধতে অনন্ত অপেক্ষায় বসতে রাজি নন তিনি, এক অ-ধৈর্য যেন তাড়া করে বেড়িয়েছে। অভিব্যক্তি ও প্রকাশের এই অসহিষ্ণুতা তাঁকে জাগিয়ে রেখেছিল সারা জীবন।

অন্য বিষয়গুলি:

K. G. Subramanyan artist Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy